
28/09/2025
==========================
কৃষ্ণপূজা এবং দুর্গাপূজা কি এক?
===========================
অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন কিছু লোক "অল্পমেধসাম"(গী.৭/২৩) -যারা নিজেদের মহাপন্ডিত বলে লোক ঠকায়, তারা সমস্ত দেবদেবীকে ভগবানের বিভিন্ন রূপ বলে মনে করে এবং তাদের ভ্রান্ত প্রচারের ফলে জনসাধারণও সেকথা সত্য বলে মনে করে। প্রকৃতপক্ষে, এসমস্ত দেবদেবী ভগবানের বিভিন্ন রূপ নন, তাঁরা হচ্ছেন ভগবানের বিভিন্ন অংশবিশেষ। ভগবান হচ্ছেন এক, আর অবিচ্ছেদ্য অংশেরা হচ্ছেন বহু। বেদে বলা হয়েছে, নিত্যনিত্যানাম ভগবান হচ্ছেন এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর।” বিভিন্ন দেবদেবীও হচ্ছেন শক্তিপ্রাপ্ত যাতে তাঁরা এই জড় জগৎকে পরিচালনা করতে পারেন। এসমস্ত দেবদেবী হচ্ছেন জড়জগতের বিভিন্ন শক্তিসম্পন্ন জীব (নিত্যানাম্), তাই কোনো অবস্থাতেই তাঁরা ভগবানের সমকক্ষ হতে পারেন না। শুক্লযজুর্বেদ (৩২/৩) ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৪/১৯) তাই বলা হয়েছে, ন তস্য প্রতিমা অস্তি অর্থাৎ তাঁর (পরমেশ্বর ভগবানের) সমান বা তুল্য কেউ নেই। যে মনে করে যে, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীনারায়ণ ও বিভিন্ন দেবদেবী একই পর্যায়ভুক্ত, তার কোনোরকম শাস্ত্রজ্ঞান নেই। এমনকি দেবাদিদেব মহাদেব এবং আদি পিতামহ ব্রহ্মাকেও ভগবানের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। প্রকৃতপক্ষে শিব, ব্রহ্মা আদি দেবতারা ভগবানের সেবা করেন (শিববিরিঞ্চিনুতম্); কিন্তু তা সত্ত্বেও মানব সমাজে অনেক নেতা আছে, যাদের মূর্খ লোকেরা ‘ভগবানে নরত্ব আরোপ’- এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে অবতার জ্ঞানে পূজা করে। কিন্তু ভগবান শ্রীনারায়ণ, শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর, তিনি এ জড় জগতে নাম, বিগ্রহ বা স্বয়ংরূপে আবির্ভূত হলেও জড় জগতের তত্ত্ব নন। তিনি জড় জগতের অতীত চিন্ময় জগতে নিত্য অবস্থান করেন।
এমনকি মায়াবাদ দর্শনের প্রণেতা শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য বলে গেছেন, নারায়ণ অথবা শ্রীকৃষ্ণ এই জড় জগতের অতীত। কিন্তু সাধারণ লোকেরা (হৃতজ্ঞান) তা সত্ত্বেও তাৎক্ষণিক ফল লাভ করার আশায় বিভিন্ন জড় দেবদেবীর পূজা করে চলে। এসমস্ত অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা বুঝতে পারে না, বিভিন্ন দেবদেবীকে পূজা করার ফলে যে ফল লাভ হয়, তা অনিত্য। যিনি প্রকৃত বুদ্ধিমান, তিনি ভগবানেরই সেবা করেন। তুচ্ছ ও অনিত্য লাভের জন্য বিভিন্ন দেবদেবীকে পূজা করা নিষ্প্রয়োজন। জড়া প্রকৃতির বিনাশের সঙ্গে-সঙ্গে এসমস্ত দেবদেবী এবং তাঁদের উপাসকেরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। দেবদেবীদের দেওয়া বরও হচ্ছে জড় এবং অনিত্য। জড় জগৎ, জড় জগতের বাসিন্দা, এমনকি বিভিন্ন দেবদেবী এবং তাঁদের উপাসকেরা সকলেই হচ্ছে মহাজাগতিক সমুদ্রের বুদবুদের ন্যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এজগতের মানবসমাজ ভূসম্পত্তি, পরিবার পরিজন, ভোগের সামগ্রী আদি অনিত্য জড় ঐশ্বর্য লাভের আশায় উন্মাদ। এই প্রকার অনিত্য বস্তু লাভের জন্য মানবসমাজে কেউ-কেউ বিভিন্ন দেবদেবীর অথবা শক্তিশালী কোনো ব্যক্তির পূজা করে। কোনো রাজনৈতিক নেতাকে পূজা করে যদি ক্ষমতা লাভ করা যায়, সেটিকে তারা পরম প্রাপ্তি বলে মনে করে। তাই তারা সকলেই তথাকথিত নেতাদের দ-বৎ প্রণাম করছে এবং তার ফলে তাদের কাছ থেকে ছোটখাটো কিছু আশীর্বাদও লাভ করছে। এসমস্ত অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা জড় জগতের দুঃখকষ্ট থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত হবার জন্য ভগবানের শরণাগত হতে আগ্রহী নয়। পক্ষান্তরে, সকলেই তাদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করার জন্য ব্যস্ত এবং তুচ্ছ একটু ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার জন্য তারা দেবদেবীর আরাধনার প্রতি আকর্ষিত হয়। খুব কম মানুষই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণের শরণাগত হয়। অধিকাংশ মানুষই সর্বক্ষণ চিন্তা করছে- কীভাবে আরো বেশি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করা যায়। আর এসমস্ত ভোগবাসনা চরিতার্থ করার জন্য তারা বিভিন্ন দেবদেবীর কাছে গিয়ে ‘এটা দাও’, ‘ওটা দাও’ বলে কাঙ্গালপনা করে তাদের সময় নষ্ট করছে।
এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত শ্লোকটি প্রণিধানযোগ্য-
যথা তরোর্মূলনিষেচনেন
তৃপ্যনিন্ত তৎস্কন্ধভুজোপশাখাঃ।
প্রাণোপহারচ্চ যথেন্দ্রিয়াণাং
তথৈব সর্বার্হণমচ্যুতেজ্যা ॥
(ভাগবত ৪/৩১/১৪)
-বৃক্ষমূলে জলসেচন করলে যেমন সেই গাছের কান্ড, ডাল, উপখাশা প্রভৃতি সকলেই তৃপ্তিলাভ করে এবং উদরে আহার্যদ্রব্য প্রদানের দ্বারা যেমন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি হয়, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলে সমস্ত দেবতার পূজা হয়ে যায়। তখন ভগবানের বিভিন্ন অংশ দেবতারাও আপনা থেকেই তৃপ্ত হন। তাই কখনো দেবদেবী-পূজাকে ভগবদ্ভক্তির সমকক্ষ মনে করা উচিত নয়।
পরমেশ্বর ভগবানকে বাদ দিয়ে দুর্গাপূজার ফলে খুব বেশি হলে কৈলাশধাম প্রাপ্ত হওয়া যেতে পারে, কিন্তু বৈকুণ্ঠ বা গোলোকধামে গমন সম্ভব নয়।
মাহেশ্বরা রাজসী চ বলিদানসমন্বিতা। শাক্তাদয়ো রাজসাশ্চ কৈলাসং যান্তি তে তয়া ॥ (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখ- ৬৪.৪৮॥ তাই দেবী দুর্গারই নির্দেশে সুরথ রাজা অন্তিমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই আরাধনা করেছিলেন এবং ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
শাক্তগণ বলেন, “যিনি কালী বা দুর্গা, তিনিই কৃষ্ণ”। শাস্ত্রানুসারে, দেবী কালী ভগবানের শক্তি, আর শ্রীকৃষ্ণ হলেন সর্বশক্তিমান পরমেশ^র ভগবান। আগুন তাপ ও আলো উভয় শক্তির উৎস। অর্থাৎ, তাপ ও আলো শক্তি দুটো আগুনের প্রকাশ- আগুন শক্তিমান, তাপ ও আলো শক্তি। তেমনি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনন্তশক্তির মধ্যে তিনটি প্রধান শক্তি হলো অন্তরঙ্গা, বহিরঙ্গা ও তটস্থা শক্তি। দেবী কালী হলেন শ্রীকৃষ্ণের বহিরঙ্গা মায়াশক্তি দুর্গার উগ্ররূপা প্রকাশ, যার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ সংহারকার্য সম্পাদন করেন।
ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে-
সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়সাধনশক্তিরেকা ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভর্তি দুর্গা।
ইচ্ছানুরূপমপি যস্য চ চেষ্টতে সা গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ॥
বঙ্গানুবাদঃ
“স্বরূপশক্তি বা চিৎশক্তির ছায়া-স্বরূপা প্রাপঞ্চিক জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-সাধিনী মায়াশক্তিই ভুবনপূজিতা ‘দুর্গা’, তিনি যাঁর ইচ্ছানুরূপ চেষ্টা করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখন্ডে (১.৯০) কালী সম্পর্কে বলা হয়েছে-
‘কৃষ্ণভক্তা, কৃষ্ণতুল্যা তেজসা বিক্রমৈর্গুণৈঃ।
কৃষ্ণভাব নয়া শশ্বৎ কৃষ্ণবর্ণা সনাতনী’।
অর্থাৎ, “দেবীকালী তেজ ও গুণ বিক্রমে কৃষ্ণতুল্যা হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি কৃষ্ণ ভক্তিপরায়ণা তথা শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত (বৈষ্ণবী)। এই সনাতনী নিরন্তর কৃষ্ণের ভাবনাবশত কৃষ্ণবর্ণ হয়েছেন।”
ভক্তের মধ্যে ভগবানের সমস্ত দিব্যগুণ বিকশিত হয়, তথাপি ভক্ত ও ভগবান দুই ভিন্ন সত্ত্বা। ভগবান সেব্য, আর ভক্ত হলেন তাঁর সেবক। তেমনি দেবীকালী হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবিকা।
একেলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য।
যারে যৈছে নাচায়, সে তৈছে করে নৃত্য ॥
সুতরাং, কালী তথা দুর্গা ও কৃষ্ণ এক নয়। দূর্গা ও কালী শ্রীকৃষ্ণের ভৃত্য।
©শ্রী পতিত উদ্ধারণ গৌর দাস
©অমৃতের সন্ধানে