13/04/2024
ইতিহাসের কষ্টিপাথরে নববর্ষ ও মংগল শোভাযাত্রা
ড. চৌধুরী আবদুল হালিম
অনেক শিক্ষিত লোককেই বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা নববর্ষ এবং মংগল শোভাযাত্রাকে গুলিয়ে ফেলতে দেখি। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কিছু সাংস্কৃতিক মোড়ল(!) হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অথচ ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায় বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাস আবহমানকালের, বাংলা নববর্ষের ইতিহাস প্রায় ৭০০ বছরের আর মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ৩৪ বছরের।
বাংলা সংস্কৃতি বলতে আবহমান কালের গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিকে বোঝায়। লোকগীতি পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, কবি গান, শরীয়তী, মারফতি, ভাওয়াইয়া, জারী, সারি, রাখালিয়া বাঁশির সুর, মৌসুমী হরেক রকম পিঠাপুলি, কৃষকের লাঙ্গল টানা, ধান কাটা, ধান ভাঙ্গা, শীতের সকালে খেজুর রস, পল্লী বাংলা, নকশি খাতা, নৌকা বাইচ,হাডুডু, দারিয়াবান্ধা, গম্ভীরা এসবই হচ্ছে আবহমান বাংলা সংস্কৃতির অংশ। প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃতির চর্চা হয়েছে স্থানীয়ভাবে নিজস্ব ঢঙে। পল্লী কবি জসীমউদ্দীন কাব্যে রচিত "পল্লী জীবন" জীবনানন্দের "রূপসী বাংলা" নজরুলের "গ্রাম বাংলা" রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে, অপরূপভাবে উঠে এসেছে বাংলা সংস্কৃতির অবয়ব। হাজার হাজার বছর ধরে এই সংস্কৃতি চর্চা চলে আসছে।
আর বাংলা নববর্ষ? ভারত বর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটেরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা পণ্য দিয়ে আদায় করতেন। কিন্তু হিজরী,সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না। অনেক সময় ফসল তোলার আগে খাজনা পরিশোধের সময় চলে আসতো। এতে কৃষকদের অসুবিধা হতো। এই অসুবিধা দূরীকরণার্থে খাজনা আদায়ের সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মোঘল সম্রাট আকবর বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার করে বাংলা সনের প্রবর্তনের আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী তৎকালীন বাংলার রাজস্ব কর্মকর্তা আমির ফতেউল্লা সিরাজী এর উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের বিনির্মান করেন। ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ই মার্চ থেকে এর অফিসিয়ালী গণনা শুরু হয়। এটিই উপমহাদেশে বাংলা নববর্ষের ইতিহাস। যদিও কারো কারো মতে বাংলা পঞ্জিকার উদ্ভাবক সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্ককে মনে করা হয় কিন্তু ইতিহাস বিশ্লেষণ এর ব্যাপ্তি বা সমর্থনও নেই।
তবে পরীক্ষামূলকভাবে এই গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর তারিখ থেকে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহের তারিখ থেকে। প্রথমে আকবরের পঞ্জিকার নাম ছিল "তারিখ-এ- ইলাহী" আর ওই পঞ্জিকার মাসগুলো আর্যাদিন, কাজিন বেসুরা তীর ইত্যাদি নামে থাকলেও পরবর্তীতে চাঁদের বিভিন্ন নক্ষত্রে অবস্থান পূর্বক যে নক্ষত্রে পূর্ণরূপ(পূর্ণিমা) দেখায় সেই নক্ষত্রের নাম অনুসারে বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়।যে মাসে চাঁদ রাশিচক্রের বিশাখা নামের নক্ষত্রে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা দেখায় সেটি বৈশাখ মাস, একইভাবে জ্যৈষ্ঠ মাসে চাঁদ পূর্ণিমা দেখায় জ্যেষ্ঠ নক্ষত্রে দাঁড়িয়ে,ভাদ্র মাসে ভাদ্রপদা নক্ষত্রে, আশ্বিন মাসে অশ্বনি নক্ষত্রে, কার্তিক মাসে কৃতিকা নক্ষত্রে, আষাঢ় মাসে পূর্বাশা নক্ষত্রে শ্রাবণ মাসে শ্রবনা নক্ষত্রে, অগ্রায়ন মাস মৃগশিরা নক্ষত্রে, পৌষ মাস পূষ্যা নক্ষত্রে, মাঘ মাস মঘা নক্ষত্রে, ফাল্গুন মাস ফাল্গুনী নক্ষত্রে এবং চৈত্র মাস চিত্রা নক্ষত্রে থেকে দাঁড়িয়ে চাঁদ পূর্ণিমা দেখায়। বলা হয়। আকবরের শাসনামল থেকে উপমহাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। আকবরের আমলে প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সবাই খাজানা-মাশু- শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতো। এর পরের দিন পহেলা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টান্ন বিতরণ করতেন, আপ্যায়ন করাতেন, সংস্কৃত অনুষ্ঠান হতো। সবমিলিয়ে উৎসবের সূচনা হয়ে যায়। সে সময় থেকে যা ধীরে ধীরে বাঙালির একটা সার্বজনীন লোক উৎসবে পরিণত হয়। এর আগে উৎসবের আমেজ ছিল না।
হালখাতার প্রচলন সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকে। এই হচ্ছে উপমহাদেশে নববর্ষ/পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস। আমাদের এই বাংলায় এর বিকাশ ঘটে আরো পরে ১৬০৮ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে সুবেদার ইসলাম খাস চিশতি ঢাকাকে যখন রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন তখন থেকে। রাজস্ব আদায় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা বছরের পহেলা বৈশাখে উৎসবের দিন হিসেবে পালন করা শুরু করেন। এভাবে চলতে থাকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত। হিন্দুরা বাংলা পঞ্জিকাকে তাদের সামগ্রিক কাজে প্রয়োগে সচেষ্ট থাকে। মুসলমানেরা শুধু পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে কিছু ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বাংলা সনকে ব্যবহার করতে থাকেন, সামগ্রীকভাবে ইংরেজি সৌর বর্ষকে কাজে লাগায়। আবেগ অনুভূতিতে হিজরী সনকে কিছুটা ধারণ করে। এভাবে চলতে চলতে ভাবটা এমন দাঁড়ায় বাংলা পঞ্জিকা হিন্দুদের মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবাংলার হিন্দুরাও বাংলা নববর্ষকে (কিছু কিছু বিষয়ে ধর্মীয় মিথের সাথে মিল থাকায়) হিন্দু সংস্কৃতির অবয়বে পালনে উৎসাহিত হয়। ফলে ১৯৪৭ সালে বাংলাভাগের পর এই অঞ্চলে( বাংলাদেশে) বাংলা নববর্ষ /পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যে মেলা উৎসব তা সার্বজনীন হলেও হিন্দুদের বিচরণ বেশি থাকে। মুসলমানেরা মূলত: জিনিসপত্র কেনা-কাটার জন্য, ঘোড়- দোড়, বলি খেলা দেখার জন্য এই সব মেলায় অংশ নেয়। ১৯৪৭ সালের তৎকালীন জাতীয় সংসদে মুসলিম লীগের খানে সবুর পহেলা বৈশাখ উদযাপন ও রবীন্দ্র সংগীত কে হিন্দু সংস্কৃতির অংশ বলে মন্তব্য করেন। শুরু হয় বিতর্ক। ১৮ জন বুদ্ধিজীবী ২৫ জুন১৯৬৭ সনে এর বিরোধিতা করে বিবৃতি দেন। এই বিবৃতির বিরোধিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন শিক্ষক ২৭ জুন পাল্টা আর একটি বৃত্তিতে দেন। ২৯ জুন প্রতিযশা আরও ৪০ জন বুদ্ধিজীবী ১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতির প্রতিবাদে পাল্টা বিবৃতি দেন। এতে তারা বলেন" যে তমদ্দুনিক স্বতন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা উপরোক্ত বিবৃতিত (১৮ জনের) মেনে নিলে সে ভিত্তি অস্বীকৃত হয়। পরবর্তীতে তারা( ৪০ জন বুদ্ধিজীবী) ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্সে এক সভা আয়োজন করে নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলা হয় "রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাব ভাষা, সুরের ঐশ্বর্য ও কৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানের তমুদ্দিনের বিপরীত।" বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশের সমর্থন পেয়ে পাকিস্তান সরকার আগষ্ট ১৯৬৭ সাল থেকে (২২ শ্রাবণের পূর্ব মুহূর্তে)বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়। তবে ব্যক্তি বা সাংগঠনিক পর্যায়ে রবীন্দ্র সংগীত চর্চা করতে নিষিদ্ধ করিনি। এই অবস্থায় ছায়ানট, বুলবুল ললিত কলা একাডেমী ও ঐকতান নিজ নিজ উদ্যোগে রবীন্দ্র সংগীতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ প্রেক্ষিতে এই বাংলায়,( পূর্ব পাকিস্তানে) সংগঠন পর্যায়ে সর্বপ্রথম পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষকে বরণ করা হয়েছে ১৯৬৬ সালে রবীন্দ্র সংগীত "এসো হে বৈশাখ এসো হে" দিয়ে। তবে তখন খুব সীমিত সংখ্যক লোকজন ছিল। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তানের শাসকদের রবীন্দ্র সংগীত সংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন চুপসে যায়। এরপর ৭০ নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বর্ষবরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল শুক্রবার সকাল সাতটায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের সাংস্কৃত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সানজিদা খাতুনের নেতৃত্বে। এছাড়া মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় মোনাজাত ও প্রার্থনায় দেশে জাতির কল্যাণ কামনা করা হয়। এরপর থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে, সংগঠন পর্যায়ে শহরে গ্রামে নববর্ষ উপলক্ষে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে থাকে। নববর্ষের মূল উদ্দেশ্য হালখাতার কিছু চর্চা ও চলতে থাকে। তবে জনতার বৃহৎ অংশ মেলায় গিয়ে কেবল প্রয়োজন কিছু জিনিসপত্র, ঐতিহ্যবাহী খাবার, পিঠা-পুলি, শিশু খেলনা কেনা-কাটার মধ্যে সীমিত ছিলেন। চট্টগ্রাম ও সীমিত কিছু অঞ্চলে বলি খেলা উপভোগ্য ছিল। এভাবেই চলতে থাকে ।
১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুর সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৮৪ সালে এক রাষ্ট্রীয় ভাষণে এই আবেগী রাষ্ট্রপতি শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার বিরোধিতা করেন।এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে অনেকে। সামরিক শাসনের মাঝেও এর প্রতিবাদ শুরু হয়। শুরু হয় সোচ্চার বিরোধী আন্দোলনও। নিষেধ সত্ত্বেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অনির্ধারিত ও অঘোষিতভাবে স্বৈরাচার বিরোধী তাৎক্ষণিক মিছিল করে সরে পড়ে। স্বৈরাচার বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এই সুযোগে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সার্বিক সহযোগী দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ে তৎপর হয়ে উঠে। রাজনৈতিক দলগুলোও সামরিক শাসনের মাঝেও, মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় অনির্ধারিত সংক্ষিপ্ত মিছিল ও স্বল্পকালীন পথ সভা করতে থাকে। সমগ্র দেশে শহরগুলোতে এভাবে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক প্রতিবাদ চালাতে থাকে। এই অবস্হা চলতে থাকে। ১৯৮৬ সালের পহেলা বৈশাখ যশোরের চারু পিঠের শিল্পী ও শিক্ষার্থীরা শোভাযাত্রার সূত্রপাত ঘটায়। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ১৯৮৬ শিক্ষাবর্ষের কিছু শিক্ষার্থীর উদ্যোগে ২৯ ডিসেম্বর জয়নুল উৎসব ব্যানারে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু করে। এখানে তখনও বিতর্কিত তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু ১৯৮৯ সালের পহেলা বৈশাখ তারা বিজাতীয় সংস্কৃতির সংমিশনে শুরু করে মঙ্গল শোভার। এর অন্যতম সংগঠক ছিল শিল্পী তরুণ ঘোষ। পশ্চিম বাংলার বারোদার Art Institute এর ছাত্র ছিল সে। বারুদায় যেভাবে নতুন বছরকে বরণ করার জন্য নানান ফোক মোটিভ, মুখোশ, খেলনার আয়োজন করে সেই কনসেপ্ট আমদানি করে তরুণ ঘোষ এটাকে সাজায়। পরবর্তীতে সেকুলার, বাঙালি জাতীয়তাবাদী বিশ্বাসে বাম ঘরনার কিছু বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভা যাত্রার নাম পরিবর্তন করেন। এটাকে আরো হিন্দুয়ানী করে নাম দেয়া হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। ক্রমান্বয়ে সেবিকৃতরুপে উপস্হাপন করা হয়।এই ভাবে ১৯৮৯ সন থেকে বাংলা নব বর্ষেকে বরণের আবরনে কেন্দ্রীয়ভাবে শুরু হয় মংগল শোভাযাত্রার।
এই যে বাংলা নববর্ষের ইতিহাস বিবৃত হল তাতে দেখা যাচ্ছে এই উপমহাদেশে অর্থাৎ ভারতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস হচ্ছে ১৫৫৬ সাল থেকে। এই অঞ্চলে অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস ১৬০৮ সাল থেকে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন এর ইতিহাস ২০১৬ সাল থেকে।আর মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস অঞ্চল পর্যায়ে হাজ১৯৮৬ সাল থেকে এবং কেন্দ্রীয়/ রাজধানী পর্যায়ের ১৯৮৯ সাল থেকে। সুতরাং বাংলা সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে কিংবা ৭০০ বছরের নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাসের সাথে মাত্র ৩২ বছর আগে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা অবিচ্ছেদ্য হতে পারে না।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা দূর অতীতের হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ।। এটি কখনো বাংলা সংস্কৃতি নয় বাংলাদেশী সংস্কৃতি নয়। হিন্দুদের জন্য পহেলা বৈশাখ হল ঘর পূজার দিন। হিন্দুদের চৈত্র সংক্রান্তিতে সারা রাত পাড়ায় পাড়ায় কীর্তন করতো। নগর দেবতা, হিন্দুদের নানান দেবতা, আর্য দেবতা, শিব পারবর্তী কীর্তন হতো।এমনকি গোয়ালঘর, উঠোন গোবর দিয়ে লেপা হতো। সকালে গোয়াল থেকে গরু বের করে গোসল করানো হতো। দুপুরে নিরামিষ রান্নাবান্না হতো।মুড়ি মাওয়া, পিঠাও বানানো হতো। ইতিহাস বিশ্লেষনে দেখা যায় সুদূর অতীত থেকে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদের গাজন ও হরি উৎসবের সময় এরকম কিছু আচার পালন করত দেখা যায়। গাজনের মেলায় মেথর ডোম ও চান্ডাল শ্রেণীর হিন্দু লোকেরাই নানাবিধ বহুরূপী সং সেজে তাদের উৎসব করত। এখন এইসব কাজে আরো হিন্দুয়ানী অনুষঙ্গ যোগ করে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে হাজার বছরের সংস্কৃতি বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা মংগল শোভাযাত্রা যে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব,হিন্দু সংস্কৃতির লালন ও বিকাশ তা আরো পরিস্কার করে লিখেছে-
১৪২৫ এর বৈশাখে অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১ লা বৈশাখে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। শিরোনাম " ঢাকার পহেলা যেন অষ্টমীর এক ডালিয়া"। অর্থাৎ রমনা বটমূলে বৃন্দ্ব গান আর পেঁচা ময়ূর সিংহ বাঘ হাঁস, অসুর,সূর্য দেবতা ইত্যাদি নানা মূর্তি ভাস্কর্য /প্রতিকৃতি মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে ঢাকায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন যেন অষ্টমীতে কলকাতা একডালিয়ার পূজা মন্ডপে উদযাপনের মতই। প্রতিবেদনের ভাষায় পুজো বসন্ত উৎসবের মিলেমিশে একাকার ঢাকার নববর্ষের সকাল।
একডালিয়া এভারগ্রীন নামে কলকাতার সবচেয়ে বড় ও ঝাঁকজমকপূর্ণ পূজা মন্ডপ রয়েছে অষ্টমী হচ্ছে হিন্দু ধর্ম অবলম্বীদের শারদীয় দুর্গাপূজার আর কুমারী পূজার মধ্যে দিয়ে পালন করে তারা বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ উদযাপন কে কলকাতার হিন্দুদের সেই একডালিয়ার পূজা মন্ডপে অষ্টমী উদযাপনের সাথে তুলনা করেছে আনন্দবাজার পত্রিকা।
সময় এসেছে ঐসব জ্ঞানপাপী ইতিহাস বিকৃতিকারী ও সংস্কৃতি মোড়লদের জঘন্য মিথ্যাচার এবং চাপিয়ে দেওয়া ভিন-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশীদের কথা বলার। এই অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে মুসলমানগণ তাদের ধর্মীয় অনুভূতিগুলো যেমন শান্তির প্রেম-ভালোবাসা এবং সহানুভূতির সাথে পালন করেছে তেমনি হিন্দুরাও তাদের ধর্মীয় পর্বগুলো সুন্দর ভাবে পালন করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিকে জোর করে সার্বজনীন সংস্কৃতি বলে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়ার যে হীন ষড়যন্ত্র সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে। কথিত স্যাকুলারদের এইসব উদ্দেশ্য প্রণোদিত কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকান্ড প্রকৃত হিন্দু জনেরাও পছন্দ করেন না।
দুঃখজনক হচ্ছে আমাদের সাধারণ মানুষের অর্থ দিয়ে গঠিত রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ সকল ভিন-দেশীয় সংস্কৃতি লালন ও বিকাশ এবং চাপানো হচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা মঙ্গল প্রদীপ সরাসরি হিন্দু মিথের সাথে, হিন্দু সংস্কৃতির সাথে প্রাচীনকাল থেকে সংশ্লিষ্ট। ৮% লোকের ধর্মীয় বিশ্বাসের সংস্কৃতি ৯০% লোকের উপর কেন চাপানো হচ্ছে, যারা প্রদীপকে মঙ্গল-অমঙ্গলের বাহন মনে করে না? তারা মনে করে মঙ্গল-অমংগলের একমাত্র মালিক মহান আল্লাহ।
অস্কার জয়ী একটি ম্যূভি "Life of Pi" এর একটা দৃশ্যের গল্প বলি। ম্যুভির নায়ক ‘পাই প্যাটেল’ ছোটবেলায় একসাথে তিনটি ধর্ম পালন করত। সে প্রথমে মন্দিরে গিয়ে পূজা করে, তারপর মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে, অতঃপর গির্জায় গিয়ে যীশুর মূর্তির সামনে প্রার্থনা করে! তার ধারনা এভাবে সে সকল ধর্মের গড/দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হবে!
প্যাটেলের এমন উদ্ভট কার্যকলাপ দেখে তার বাবা মন্তব্য করেন- “মানুষ কখনো একসাথে দুইটা ধর্মে বিশ্বাস করতে পারে না। একসাথে একাধিক ধর্ম পালন করার মানে হল- তুমি আসলে কোনটাই বিশ্বাস করছ না। এভাবে তুমি সবগুলো ধর্মের সাথেই প্রতারনা করছ।”
আমাদের কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল ও মডারেট মুসলিমরা তাই করে চলছে!
নাম নিয়ে আমার কথা নেই। মংগল শোভাযাত্রায় সিংহ ভাগ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন থাকলে কিংবা বিশ্বাসের পরিপন্থী কিছু না থাকলে, মানুষের কল্যানধর্মী হলে তবে এতসব কথা আসতো না। অন্যদিকে আমাদের দেশের মংগল শোভাযাত্রার প্রতি বছরের থিম বাণী লক্ষ্য করলে দেখা যাবে একটি দলের রাজনৈতিক মোটিভকে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিবচনা করে থিম ঠিক করা হয় এমন কী ঐ দলের প্রতীকও ব্যবহার করা হয় যা কখনো সার্বজনীন হতে পারে না। মংগল শোভাযাত্রা কখনো বাংগালী সংস্কৃতি বা বাংলাদেশী সংস্কৃতি ছিল না।১৯৮৯ সনের আগে এর অস্তিত্বই ছিল না। হাজার বছরেরতো প্রশ্নই আসে না।
এ অবস্থায় এই প্রজন্মের কাছে মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎস বিকাশ ও হীনের উদ্দেশ্য তুলে ধরতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সার্বজনীন রূপ দেয়ার জন্য বারবার লিখতে হবে, বলতে হবে, বিকল্প গ্রহণীয় সংস্কৃতি চালু করতে হবে। এইজন্য চিন্তাশীল, গবেষক এবং সাহসী লেখকদের এগিয়ে আসতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে দেশ প্রেমিক সচেতন মানুষের।দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে, নিজেদের বিশ্বাসকে কলুষমুক্ত রাখতে সর্বপরি আমজনতার কল্যানার্থে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যহত রাখতে হবে। নতুবা এদের পরবর্তী টার্গেট "রাজনৈতিক আগ্রাসন"। সম্প্রতি বাংলাদেশকে অখন্ড ভারতের অংশ করে ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে দেয়া মানচিত্র তারই ইংগিত প্রকাশ করছে।
🖊️ লেখক- শিক্ষাবিদ ও সংস্কতি কর্মী।