11/10/2025
শিক্ষক–শিক্ষার্থীর সম্পর্ক: শ্রদ্ধা কমে গেল কেন?
একসময় শিক্ষককে বলা হতো “আলোকবর্তিকা”—যিনি নিজের জ্ঞান, নীতি ও আদর্শের আলোয় সমাজকে আলোকিত করেন। ছাত্ররা তাঁদের দেখলে মাথা নিচু করে সালাম দিত, কথা বলত শ্রদ্ধার সঙ্গে, তাঁদের উপস্থিতিতে নীরবতা নামত শ্রেণিকক্ষে। কিন্তু আজ সেই দৃশ্য অনেকটাই বদলে গেছে। এখন অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষককে বন্ধু ভাবছে, সমানভাবে মিশছে—যা একদিকে ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত দিলেও, অন্যদিকে শ্রদ্ধার সম্পর্ককে দুর্বল করছে। প্রশ্ন হলো, এর জন্য দায়ী কে বা কী?
বর্তমান সমাজে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও পরিবেশ—দুটোই বদলে গেছে। একসময় শিক্ষা মানে ছিল চরিত্র গঠন, আদর্শ শেখা ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরি করা। এখন শিক্ষা হয়ে গেছে মূলত চাকরিমুখী বা নম্বরকেন্দ্রিক। স্কুল বা কলেজ এখন অনেকটা সার্টিফিকেট পাওয়ার জায়গা, শিক্ষক হয়ে গেছেন “ক্লাস নেওয়ার লোক”—এমন ধারণাই গড়ে উঠছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে।
এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পরিবার ও সমাজের পরিবর্তন। পরিবারে বাবা-মা যদি শিক্ষককে সম্মান না করেন, তাঁদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন, তাহলে সন্তানও একইভাবে ভাবতে শেখে। একসময় পরিবারে “শিক্ষক মানেই গুরুজন” বলে শিখানো হতো। এখন অনেক অভিভাবক সন্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন—যা সন্তানদের মনে শিক্ষক সম্পর্কে শ্রদ্ধার জায়গা নষ্ট করে দিচ্ছে।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবও কম নয়। এখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর যোগাযোগ অনেক সময় অনলাইন ভিত্তিক। সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষককে “ফ্রেন্ড” করে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে মন্তব্য করে, মজা করে, এমনকি বিতর্কেও জড়ায়। এতে সম্পর্কের সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ যত বাড়ছে, শ্রদ্ধা ও দূরত্বের প্রয়োজনীয়তা তত কমে যাচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও প্রশাসনিক দুর্বলতাও দায়ী। অনেক জায়গায় শিক্ষকদের যোগ্যতা, পেশাদারিত্ব বা নৈতিক মান প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষকরা যদি নিজেরা দায়িত্বশীল, আদর্শবান ও নীতিবান না হন, তাহলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আশা করাও কঠিন। শ্রদ্ধা আদায় করতে হয় চরিত্র ও আচরণের মাধ্যমে—পদবি দিয়ে নয়।
অন্যদিকে, সমাজে “শিক্ষক পেশা”র মর্যাদা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। কম বেতন, রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম—সব মিলিয়ে অনেক শিক্ষক নিজের পেশার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কেও আন্তরিকতার বদলে আনুষ্ঠানিকতা বেড়ে যাচ্ছে।
তবে সব কিছুই নেতিবাচক নয়। অনেক জায়গায় এখনো এমন শিক্ষক আছেন, যাঁরা শিক্ষার্থীদের ভালোবাসেন, উৎসাহ দেন, এবং নিজের আচরণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা অর্জন করেন। শিক্ষার্থীরাও যাঁদের থেকে মানবিকতা ও আন্তরিকতা পায়, তাঁদের প্রতি আজও গভীর শ্রদ্ধা রাখে।
তাই দায় শুধু একপক্ষের নয়—শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পরিবার ও সমাজ—সবাই মিলেই এ অবক্ষয়ের জন্য দায়ী।
সমাধানও তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভব।
পরিবারে সন্তানকে শেখাতে হবে, শিক্ষক মানে শুধুই পাঠদানকারী নয়—তিনি জীবনের পথপ্রদর্শক।
শিক্ষককেও মনে রাখতে হবে, তাঁর দায়িত্ব শুধু পাঠ নয়, আচরণ দিয়েও শিক্ষা দেওয়া।
শিক্ষা যদি হয় মানুষের উন্নতির মাধ্যম, তবে সেই উন্নতি শুরু হতে হবে শ্রদ্ধা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভালো, তবে শ্রদ্ধাহীন সম্পর্ক কখনো ফলপ্রসূ নয়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দূরত্ব নয়, সম্মানজনক ভারসাম্যই এই সম্পর্কের আসল সৌন্দর্য।
✍️ লেখক: সংগ্রাম