28/08/2024
বঙ্গ, বাঙালী, বাংলাদেশ ও আদিবাসী
-শক্তিপদ ত্রিপুরা
পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষ, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী- বাঙালী-আদিবাসী, আর্য, অষ্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় সবাই- এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, ও প্রান্ত থেকে এ প্রান্ত চষে বেড়িয়েছে জীবন ও জীবিকার তাগিদে। কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন ও পশু পালন বিদ্যা অর্জনের আগে মানুষের জীবন ছিল যাযাবর। মানুষ যখন ফল-মূল উৎপাদন করতে শিখল এবং বনের পশু-পাখি লালন পালনের বিদ্যা অর্জন করলো তখন থেকে মানব সমাজের স্থায়ীভাবে বসবাসের যাত্রা শুরু হল। তথাপি মানুষ ভাগ্যান্বেষনে পৃথিবীর এ প্রান্ত ও প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছে এখনো। জীবন-জীবিকার তাগিদে বা কোন ঐতিহাসিক কারণে একই জনগোষ্ঠীর মানুষ মূল জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নূতন জাতি গঠন করেছে আবার বহু জাতি মিলে এক নূতন জাতি গঠিত হয়েছে- এমন দৃষ্টান্ত মানব সমাজের ইতিহাসে পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতির ইতিহাস যদি খতিয়ে দেখি তাহলে এর সত্যতা মিলবে। ভারত উপমহাদেশের গারো, ত্রিপুরা কোচ, বোড়ো বর্তমানে- এক একটি পৃথক জাতি অথচ একসময় তারা সবাই এক জাতির মানুষ ছিল। অপরদিকে কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা ইত্যাদি এবং আর্য-অনার্য রক্তের সংমিশ্রণে বর্তমান বাঙালী জাতি জন্মলাভ করেছে। মানব সমাজের ক্রমবিকাশে এ ধরণের উত্থান-পতন, গঠন- ভাঙন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বিশেষ। অনাদিকাল ধরে মানব সমাজে এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
প্রসঙ্গ: বঙ্গ, বাঙালী ও বাংলাদেশ:
‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন ভূখন্ডের জন্ম ১৯৭১ সালে। বাঙালী জাতির মধ্যে অনেকেই মনে করেন ‘বাংলাদেশ’- শুধুমাত্র বাঙালীর দেশ। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হল- বাংলাদেশে বহু জাতি ও বহু ধর্মের লোক বাস করে। বর্তমান বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডটি পূর্বে বিভিন্ন নামে বহু খন্ডে বিভক্ত ছিল। এ অঞ্চল পূর্বে গৌড়, রাঢ়, সুক্ষ্ম, হরিখেল, সমতট, বঙ্গ, বরেন্দ্র ইত্যাদি নামে খ্যাত ছিল। এইসব অঞ্চলে শত হাজার বছর ধরে বহু আদিবাসী জাতি বসবাস করে আসছে। এই অঞ্চলে বাঙালী জনগোষ্ঠীও শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে। এই নিবন্ধে এইসব বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্টা থাকবে বিশেষত: বিভিন্ন ঐতিহাসিক, গবেষক ও লেখকের বক্তব্যের আলোকে।
ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, “বঙ্গ, বাঙালী- এই অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় আধুনিক কালের। প্রাচীন কালে বঙ্গ বা বাঙালী জনগোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া যায় না। প্রাচীনকালে এই অঞ্চল গৌড়, রাঢ় ও পুন্ড্রু নামে পরিচিত ছিল। তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে গৌড় রাঢ় পুন্ড্রু এর পাশাপাশি সুক্ষ্ম, হরিখেল, কামরূপ, সমতট, বঙ্গ, বরেন্দ্র ইত্রাদির নাম পাওয়া যায়। বঙ্গ অঞ্চলটি ঢাকা, পাবনা ও ময়মনসিংহ; হরিখেল অঞ্চলটি পার্বত্য ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে; বরেন্দ্র- বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার, মিথিলা নিয়ে; সমতট- কুমিল্লা ও নোয়াখালী নিয়ে; গৌড়- রাজশাহী, মালদহ, রাজমহল, মুর্শিদাবাদ; রাঢ়- বর্ধমান বিভাগ নিয়ে গঠিত।” [ বাংলা, বাঙালী ও বাঙালীত্ব- আহমদ শরীফ, পৃষ্ঠা- ৯, ১১।]
মমতাজুর রহমান তরফদার বলেন, “সুদুর অতীতে পূর্ব ভারতে কোন একভাষিক রাষ্ট্রস্বত্তা বা একভাষিক জাতিসত্ত্বা ছিল না। ------------ একটি বিশেষ নামে পরিচিত কোন নিরবিচ্ছিন্ন ভৌগলিক এলাকাও ছিল না। এখানে ছিল কতগুলো খন্ড খন্ড জনপদ এবং অষ্ট্রিক, দ্রাবিড় ও তিব্বতী-চীনা ভাষাভাষি বহু কোম বা বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর লোকজন। ------------- বাংলা বা বাঙালী জনগোষ্ঠী নামে তখনো কোন অঞ্চল অভিহিত হয়নি। সেকালের বঙ্গ গড়ে উঠেছিল বর্তমান ঢাকা, ফরিদপুর এবং খুব সম্ভব খুলনা ও বরিশালের অংশগুলি নিয়ে।” [ সূত্র- প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙালী সংস্কৃতি(প্রবন্ধ), মমতাজুর রহমান তরফদার, বাঙালীর আত্ম পরিচয়, সম্পাদনা- মুস্তাফা নুর উল ইসলাম, পৃষ্ঠা- ৫৫ ]
মাহবুবুল আলম তার ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন, “বর্তমান বাঙালী জনগোষ্ঠী বহুকাল ধরে নানা জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। এর মূল কাঠামো----- সমগ্র বাঙালী জনগোষ্ঠীকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ক. প্রাক আর্য বা অনার্য জনগোষ্ঠী ও খ. আর্য নরগোষ্ঠী। এদেশে আর্যদের আগমনের আগে অনার্যদেরই বসতি ছিল। ঐ প্রাক আর্য জনগোষ্ঠী বাঙালী জীবনের মেরুদন্ড। তিনি আরো বলেন,বৈদিক যুগে আর্যদের সংগে বাংলাদেশবাসীর কোন সম্পর্ক ছিল না। বৈদিক গ্রন্থাদিতে বাংলার নর নারীকে অনার্য ও অসভ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলার আদিম অধিবাসী আর্য জাতি থেকে উদ্ভূত হয়নি। আর্য পূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত: নেগ্রিটো, অষ্ট্রিক, দ্রাবিড় ও বোট-চীনিয়- এই চার শাখায় বিভক্ত ছিল।”
সুনীতি কুমার ঘোষ বলেন, “বিভিন্ন জনগোষ্ঠী রক্তের সংমিশ্রনে বাঙালী জাতির উদ্ভব হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে তিনটি নর গোষ্ঠী প্রথম- সাঁওতাল. কোল, মুন্ডা ইত্যাদির পূর্ব পুরুষ অষ্ট্রিক ভাষাভাষি বাংলার আদিম অধিবাসী, দ্বিতীয় দ্রাবিড় ভাষাভাষি ভূমধ্য সাগরীয় নরগোষ্ঠী- যারা ভারতে প্রবেশ করে হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। এবং তৃতীয় আর্য ভাষাভাষি আলপীয় নরগোষ্ঠী। বাঙালী জাতি গঠনে সাওঁতাল, কোল ভিল ও মুন্ডা নরগোষ্ঠী অংশগ্রহন সবচেয়ে বেশী।”
‘বাংলার ইতিহাসের ধারা’ গ্রন্থে ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রনে গঠিত বাঙালীর জাতির মধ্যে মিশ্রনের হার এভাবে দেখিয়েছেন: বাঙালী রক্তের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ অষ্ট্রেলীয়, ২০ ভাগ মঙ্গোলীয়, ১৫ ভাগ নেগ্রিটো, ৫ ভাগ অন্যান্য নানা জনগোষ্ঠীর রক্ত মিশেছে। নিষাদ, কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা, মাল পাহাড়ী প্রভৃতি হল আদি-অষ্ট্রেলীয় এবং কিরাত, রাজবংশী , কোচ, মেচ, মিজ্জার, কুকি, চাকমা, আরাকানী প্রভৃতি হচ্ছে মঙ্গোলীয়।”
ঐতিহাসিক কৈলাস চন্দ্র সিংহ তাঁর ‘রাজমালা’ গ্রন্থে বলেন- “চন্দ্রবংশীয় সুবিখ্যাত নরপতি যযাতির চতুর্থ পুত্র অনুবংশে ‘বলি’ নামে এক নরপতি ছিলেন। বলিরাজ পতœী মহর্ষি দীর্ঘতমার ঔরসে পাঁচটি পুত্র লাভ করেন। বলির ক্ষেত্রজ পুত্রগণ- অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুক্ষ্ম ও পুন্ড্রু আখ্যাপ্রাপ্ত হন। তাহারাই পূর্ব ভারত পাঁচ ভাগে বিভক্ত করিয়া এক একটি প্রদেশে রাজদন্ড ধারণ করেন। স্থাপয়িতার নামানুসারে সেই রাজ্য অঙ্গ. বঙ্গ. কলিঙ্গ. সুক্ষ্ম ও পুন্ড্রু আখ্যায় পরিচিত হইয়াছিল।”
তিনি আরো বলেন প্রাচীন সুক্ষ্ম বা ত্রিপুরার পরিমাণ ৭৫০০০ বর্গমাইল অপেক্ষা ন্যুন ছিল না বলিয়া বোধ হয় না। তৎকালে সমগ্র কুকি প্রদেশ, মিতাই রাজ্য, কাছাড়, শিলহট্ট (শ্রীহট্ট), চট্টগ্রাম ও নওয়াখালী ঐ সুক্ষ্ম বা ত্রিপুরার অন্তনিবিষ্ট ছিল।” [ সূত্র: রাজমালা, কৈলাশ চন্দ্র সিংহ, পৃষ্ঠা- ৫৭ ]
মাহবুবুল আলম তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন, “রাঢ়, সুক্ষ্ম, পুন্ড্রু, বঙ্গ প্রভৃতি শব্দের সাহায্যে বিশেষ জাতি বা উপজাতি বুঝানো হত। ------ রাঢ় বলতে পশ্চিম বঙ্গ, সুক্স¥ বলতে দক্ষিণ বঙ্গ, পুন্ড্রু বলতে উত্তর বঙ্গ, বঙ্গ বলতে পূর্ব বঙ্গ, সমতট হরিকেল বলতে পূর্ব বঙ্গের দক্ষিনাঞ্চল প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ স্থানকে বুঝায়।”
শ্রী পূর্ণ চন্দ্র দেববর্মা বলেন, “প্রাচীন আর্যগণ কামরূপ ও আরাকানের (রাক্ষেয়াং) মধ্যবর্তী চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরাকে সুক্ষ্মদেশ বলিতেন। এক সময়ে এই রাজ্য উত্তরে তৈরঙ্গ নদী হইতে দক্ষিণ রোশাং (রাক্ষেয়াং) দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্রক্ষ্ম ভাষায় ইহাকে পাটিকারা বলে। হিউয়াং তাঁহার ভ্রমণ বৃত্তান্তে ‘সিউকি’ নামক গ্রন্থে এই দেশকে কমলাঙ্ক ও চট্টলকে সিউলি চটলো বা শ্রীচটলো উল্লেখ করিয়াছেন। ” [ সূত্র: চট্টগ্রামের ইতিহাস- পূর্ণচন্দ্র বেববর্মা ]
পূর্ণচন্দ্র দেববর্মা আরো বলেন, “পুরাতত্ত্ব আলোচনায় প্রতীয়মান হয়, আর্যগণ ভারতে আসিবার পূর্ব্ব হইতে এই দেশ পরাক্রান্ত ‘কিরাত’ নামক এক জাতির বাসস্থান ও কিরাত রাজার শাসনাধীন ছিল। রাজা ‘ত্রিপুর’ কিরাত জাতির নামের পরিবর্তে স্বীয় নামানুসারে স্বীয় রাজ্যের নাম ‘ত্রিপুরা’ এবং স্বীয় জাতির নাম ‘ত্রিপুরা জাতি’ বলে প্রচার করেন। তখন ত্রিপুরা রাজ্য ও ত্রিপুরা জাতি প্রতিষ্ঠা পায়। [ সূত্র: চট্টগ্রামের ইতিহাস- শ্রী পূর্ণ চন্দ্র দেববর্মা ]
গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বলেন. “সেই প্রাচীন কালে যে আদিবাসীরা এ অঞ্চলে বাস করতেন, তাদের রক্ত এখনো আমাদের ধমণীতে বহমান। তিনি আরো বলেন, সত্যি বলতে কি, বাংলা ভাষার বয়স এক হাজার বছর হয়েছে কি না সন্দেহ।”
বিষ্ণু পুরাণের অনুবাদক উইলসন বলেন, “ত্রিপুরা, নোয়াখালী ও আরাকান প্রদেশ নিয়ে পুরাকালে ‘সুক্ষ্ম দেশ’ গঠিত হইয়াছিল। [সূত্র: চাকমা জাতি- সতীশ চন্দ্র ঘোষ, পৃষ্ঠা- ২৪ ]
ত্রিপুরা মহারাজারা প্রাচীন কালে ‘ফা’ উপাধি গ্রহণ করতেন। রতœফার আমল থেকে ত্রিপুরা মহারাজারা ‘মানিক্য’ উপাধি ধারণ করেন। মহারাজ হামতরফা বীর রাজ ৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরোহন করেন। এ মহারাজার রাজত্বকালে প্রথম বর্তমান চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনবসতি গড়ে উঠে ও আবাদ করা হয় বলে জানা যায়। এবিষয়ে চিটাগাং গেজেটিয়ার- এ উল্লেখ আছে- `King Bira Raja of Tippera (Tripura) was the founder of Chittagong Hill Tracts in 590.’ তিনি ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ জয় করেন এবং শেষার্ধে আরাকান রাজ্য জয় করে ত্রিপুরার সীমানা সম্প্রসারিত করেন। [ সূত্র: ত্রিপুরা জাতির মানিক্য উপাখ্যান- প্রভাংশু ত্রিপুরা, পৃষ্ঠা- ৪৮ ]
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হোটেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় এক ফোল্ডার প্রকাশ করা হয়। ঐ ফোল্ডারে উল্লেখ করা হয় যে, `Historically Chittagong was a small fishing village in the ancient kingdom of Tippera.’
P Sandy’s view in AD 590: `The Tripura Raj comprised the present British district to Chittagong, Noakhali, Tippera, Sylhet, Kachar, the Garo Khasi Gaintia Hills, Lushai land and the Chittagong Hill Tracts Tripura, Saigal (1917; 494)
Imperial Gezetteer of India Provincial Series Estern Bengal and Assam- এর ৬৬ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে যে, The ancient Kingdom of Tippera at various times extended its rules from the Sunderban in the west to Burma in the east and north was as far as Kamarup.’
সতীশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, “ষোড়শ শতাব্দির প্রারম্ভে (১৫১২ খ্রি:) চট্টগ্রামের আধিপত্য লইয়া বিবিন্ন শক্তির মধ্যে তুমুল বিপ্লব উপস্থিত হইয়াছিল। তাহাতে হিন্দু, মুসলমান ও মঘ জাতিত্রয়ের রুধিধারায় চট্টগ্রাম রঞ্জিত হয়। ত্রিপুরা মহারাজা ধন্যমানিক্যের -------- সেনাপতি রায় চয়চাগ ------------, বঙ্গদেশের সুপ্রসিদ্ধ সুলতান হুসেন শাহ ----------- এবং প্রবল পরাক্রান্ত আরাকানাধিপতি মেং রাজার ---------- চট্টলের সমর ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। শেষ ফলে মুসলমান ও মঘদিগের ভূজগর্ব খর্ব করিয়া সেনাপতি চয়চাগ চট্টলবক্ষে বিজয়-বৈজয়ন্তী সংস্থাপন করেন।” [ সতীশ চন্দ্র ঘোষ- চাকমা জাতি, পৃষ্ঠা- ২৪ ]
সতীশ চন্দ্র ঘোষ আরো বলেন, “১৫২২ খ্রিস্টাব্দে মঘরাজ গজাবদিগকে পরাজিত করত: চট্টগ্রাম অধিকার করেন । কিন্তু ইহার কিছুদিন পরে হুসেন শাহের উপযুক্ত পুত্র সুলতান নাসির উদ্দিন নছরতসাহা স্বর্গগত পিতৃদেবের সন্তোষ সাধনের নিমিত্ত-------- বাহুবলে চট্টগ্রাম পনু:রুদ্ধার করিয়াছিলেন।”
সতীশ চন্দ্র ঘোষ আরো বলেন, “১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয় মানিক্য রাজা হইয়া চট্টগ্রাম পুনর্বার অধিকার করেন।”
উপরে বর্ণিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও লেখকের উক্তি ও বক্তব্য থেকে এটি পরিস্কার যে, বাঙালী জাতি সৃষ্টি হবার আগে এই অঞ্চলে আদিবাসীরা বসবাস করত। মূলত: আদিবাসী জাতিসমূহের সংমিশ্রণে বাঙালী জাতি সৃষ্টি হয়েছে; যদিওবা এ জাতির রক্তে পাঠান, ইরানসহ বিভিন্ন জাতির রক্তও মিশ্রিত রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বিভিন্ন সময়ে তখনকার সুক্ষ্ম দেশ (পার্বত্য ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, এবং আরাকান), সমতট(কুমিল্লা/ত্রিপুরা), গৌড় ও বর্তমান সিলেট, মংমনসিংহ প্রভৃতি এলাকা আদিবাসী রাজাদের শাসনাধীনে ছিল। ঐতিহাসিক কৈলাশ চন্দ্র সিংহের মতে, ‘বঙ্গ’ নামটি এক আদিবাসী রাজার ৫টি ছেলের ১টি ছেলের নাম। ‘বঙ্গ’ নামক রাজপুত্র যে অঞ্চলটি শাসন করেন সেই রাজার নামানুসারে পরবর্তীতে সে অঞ্চলের নাম ‘বঙ্গ’ নামে খ্যাত হয়।
স্বাধীন বাঙালী জাতির আত্মপ্রকাশ (১৯৪৭-১৯৭১):
দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসী বাঙালী ও মুসলমান বিধায় এ অঞ্চলটি স্বাভাবিক কারণে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রে এককভাবে বাংলা ভাষাভাষির সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ‘বাঙলা’কে উপেক্ষা করে ‘উর্দু’-কে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা প্রদানের কারণে বাঙালী জাতি এর প্রতিবাদ জানায় এবং বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণার দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। ভাষা আন্দোলনকে স্তব্দ করার জন্য পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারী করে। বাংলার ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এ আন্দোলনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার শহীদ হন। আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনে। বাংলার মানুষ পরিস্কারভাবে উপলদ্ধি করতে পারল যে, পাকিস্তানে বাঙালী জনগণের অধিকার সংরক্ষিত হবে না। এই উপলদ্ধি থেকে বাঙালী জাতি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকে। ’৫২- এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২- এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, ’৬৯- এর গন অভুত্থান এবং সর্বশেষ একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে প্রথম বাঙালী জাতির স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। এই প্রথম বাঙালী জাতি একটি স্বাধীন জাতি পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হল।
আদিবাসী ও আদিবাসিন্দা- এক নয়:
কে বা কারা ‘আদিবাসী’- এনিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক চলছে। জোরালোভাবে বিতর্ক শুরু হয় তখন, যখন তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি বলেন, “ বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। বাংলাদেশে যারা বসবাস করে তারা উপজাতি, নৃ-গোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে কয়েকশ’ বছর ধরে বসবাস করছে। তারা অর্থনৈতিক প্রয়োজনে এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য এদেশে এসেছে। আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়াতে সেখানকার আদিবাসীরা যে অর্থে আদিবাসী, সে অর্থে বাংলাদেশের আদিবাসীরা ‘আদিবাসী’ নয়। আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়াতে আদিবাসী অস্তিত্বের সাথে ঔপনিবেশিক অনুপ্রবেশকারী ইউরোপীয়দের নৃশংসতা সম্পর্কিত।” তিনি আরো বলেছেন,“বাঙালীরাই এদশের প্রকৃত আদিবাসী।” [সূত্র: সাপ্তাহিক রোববার, ৭আগস্ট ২০১১, পৃষ্ঠা- ১১]
আমি মনে করি রাজনীতিক দিপু মনি বাঙালী জাতির উৎপত্তির ইতিহাস ও আদিবাসী সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই অথবা তিনি ইচ্ছেকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃতি করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যা কোনটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে না।
শব্দগত অর্থে ‘আদিবাসী’ ও আদি-বাসিন্দা- এর অর্থ সমার্থক হলেও প্রায়োগিক অর্থে এক নয়। বাঙালী-আদিবাসী সবাই এ অঞ্চলের আদি-বাসিন্দা, কিন্তু সবাই ‘আদিবাসী’ নয়। কারণ জাতিসংঘের দৃষ্টিতে ‘আদিবাসী’ বলতে একই সাথে ‘আদি-বাসিন্দা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী’-কে বুঝানো হয়। অপরদিকে কোন জনগোষ্ঠী আদিকাল থেকে কোন অঞ্চলে বসবাস করেছে এবং বর্তমানেও বসবাস করছে সে ধরণের জনগোষ্ঠীকে ‘আদি-বাসিন্দা বলা হয়। সে দৃষ্টিকোন থেকে বাঙালী জাতি ‘আদি-বাসিন্দা’ হলেও ‘আদিবাসী’ নয়। কারণ বাঙালী জাতি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নয়, বর্তমানে বাঙালী জাতি একটি স্বাধীন জাতি এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সুতরাং বাঙালী জাতি এ অঞ্চলের ‘আদি-বাসিন্দা’ হলেও সার্বিক বিচারে ‘আদিবাসী’ অভিধার মধ্যে পড়ে না।
সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মনি ‘ইন্ডিজিনাস পিপল’ বা আদিবাসী সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির উপনিবেশ, নির্যাতন বিষয়সমূহের যুক্ততার কথা উল্লেখ করেছেন তা এক্ষেত্রে যথাযথ ও প্রযোজ্য নয়। আদিবাসী বা ইন্ডিজিনাস পিপল বলতে কাদের বুঝায় তা জাতিসংঘের ভাষ্যে পরিস্কার। জাতিসংঘ ভাষ্যমতে আদিবাসী জনগোষ্ঠী হল- (১) যে জনগোষ্ঠী আদি-বাসিন্দা অথচ প্রান্তিক, অধিকারহারা এবং আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়কালে যাদের কোন ভূমিকা ছিল না, কিংবা প্রান্তিক ভূমিকা, (২) যে জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় আইনের চাইতে প্রথাগত আইনের মাধ্যমে সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকে, (৩) যাদেও মধ্যে ধমীয় বহু মাত্রিকতা রয়েছে, (৪) যাদের ভূমির সাথে আধ্যত্মিক ও আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং জাতিসংঘ কর্তৃক আদিবাসী জনগোষ্ঠী নির্ধারণে যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মনির ধারণা বা কল্পনার কোন সামঞ্জস্য নেই। এসব বৈশিষ্টের আলোকে সংজ্ঞায়িত করতে চাইলে বাঙালী জাতিকে কোনভাবে ‘আদিবাসী’ বর্গে ফেলানো যায় না। সুতরাং ডা. দিপু মনি যে দাবী করেছেন বাঙালীরাই এদেশের প্রকৃত ‘আদিবাসী’ জাতিসংঘ ভাষ্যমতে তা সঠিক ও যথাযথ নয়, তবে বাঙালীরা অবশ্যই এ অঞ্চলের আদি-বাসিন্দা তা নিসন্দেহে স্বীকার করা যায়। ডা. দিপু মনি এখানে ‘আদিবাসী’ ও ‘আদি-বাসিন্দা’ শব্দ দু’টিকে সম অর্থে ব্যবহার করেছেন। এই দু’টি শব্দের শাব্দিক অর্থ একই হলেও প্রায়োগিক অর্থে একই অর্থ বুঝায় না।
বাঙালী জাতি- এ অঞ্চলের আদি-বাসিন্দা:
বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালী ব্যতিত ভিন্ন ভাষাভাষি আদিবাসী জাতিসমূহকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশে বাঙালী জাতি অ-আদি-বাসিন্দা হয়ে যায় না। বাঙালী জাতিও এই বাংলার আদি-বাসিন্দা। বাঙালী জাতি এ অঞ্চলে দু’দিক থেকে আদি-বাসিন্দা- (১) শংকর জাতি হিসেবে ও (২) ভূমিজ সন্তান হিসেবে। সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকগণ বলেছেন- বিভিন্ন জাতির সংশিশ্রনে বাঙালী জাতির সৃষ্টি। ভূপেন্দ্র নাথ বলেছেন- এ সংমিশ্রণে শতকরা ৬০ ভাগ অষ্ট্রেলীয়, ২০ ভাগ মঙ্গোলীয়, ১৫ ভাগ নেগ্রিটো, ৫ ভাগ অন্য নানা নরগোষ্ঠীর রক্ত মিশ্রিত। নিষাদ, কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা, মাল পাহাড়ী প্রভৃতি হল আদি অষ্ট্রেলীয় এবং কিরাত, রাজবংশী, কোচ, মেচ, ত্রিপুরা, মিজ্জার, কুকি, চাকমা, আরাকানী প্রভৃতি হচ্ছে মঙ্গোলীয় । [ সূত্র: বাংলার ইতিহাসের ধারা- ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত ] এইসব উল্লেখিত জাতিসমূহ সবাই আদিবাসী বর্গের জনগোষ্ঠী। সুতরাং বাঙালী জাতির রক্তে ৮০ভাগ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রক্ত মিশ্রিত। শংকর জাতি হিসেবে বিবেচনায় বাঙালী অবশ্যই এ অঞ্চলের একটি আদি-বাসিন্দাজাত জাতি। অপরদিকে ভূমিজ সন্তান হিসেবেও বাঙালী জাতি এ অঞ্চলে ‘আদি-বাসিন্দা’ হিসেবে বিবেচনার দাবী রাখে। প্রায় হাজার বছর আগে বাঙালী জাতির সৃষ্টি। এই অঞ্চলে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রনে বাঙালী জাতি সৃষ্টি হয়েছে। জাতি হিসেবে বাঙালী জাতি এই অঞ্চলে সৃষ্টি এবং বাঙালী জাতির প্রথম প্রজন্ম এই অঞ্চলে জন্মলাভ করেছে ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। সুতরাং বাঙালী জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলের ভূমিজ সন্তান। ভূমিজ সন্তান হিসেবেও বাঙালী জাতি এই অঞ্চলের আদি-বাসিন্দা।
আদিবাসী স্বীকৃতির প্রশ্নে ভীতি ও বিভ্রান্তি:
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ‘আদি-বাসিন্দা’ বা ‘আদিবাসী দু’দিক থেকে এদেশের আদিবাসীরা ‘আদিবাসী’ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ সরকার এদেশের আদিবাসীদের কখনো ‘আদিবাসী’ কখনো ‘উপজাতি’, ‘নৃ-গোষ্ঠী’ ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত করেছে। বাংলাদেশের কোন কোন আইনে, নীতিমালায় ‘আদিবাসী’ বলা হয়েছে, কোন কোন আইনে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’, ‘উপজাতি’ ইত্যাদি বলা হয়েছে। এ থেকে পরিস্কার যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র আদিবাসী স্বীকৃতির বিষয়ে এখনো বিভ্রান্তি ও দুদুল্যমানতায় ভূগছে। আদিবাসী স্বীকৃতির প্রশ্নে কোন ভীতি কাজ করছে কি? আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হলে ভূমি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে আদিবাসীদের বেশী বেশী অধিকার প্রদান করতে হবে? অনেকে অযথা সংশয় প্রকাশ করেন যে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের ভূখন্ড বিপন্ন হয় কী না। কিন্তু প্রশ্ন হল- যেসব দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, সেসব দেশের ভূখন্ড বিপন্ন হয়েছে কি? যেসব দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে এবং তাদের ভূমি, শিক্ষাসহ যেসব অধিকার প্রদান হয়েছে তার কারণে দেশের মূল জনগোষ্ঠী কিংবা ভূখন্ড কি বিপন্ন হয়েছে? পৃথিবীতে কোথাও এমন কোন নজির নেই। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে আদিবাসীরা ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃত নয়, কিংন্তু তারা আদিবাসীদের ন্যায় ভূমি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অধিকার ভোগ করছে। যেমন পাশ^বর্তী দেশ ভারতের মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল ইত্যাদি প্রদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃত নয়, কিন্তু সেদেশে আদিবাসীরা প্রথাগত ভূমি অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসহ বিভিন্ন অধিকার ভোগ করছে। বাংলাদেশের আদিবাসীরা বৃটিশ আমল থেকে এবং বাংলাদেশ আমলেও বিভিন্ন আইনে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীৃকত কিন্তু প্রথাগত ভূমি অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসহ শিক্ষা, সংষ্কৃতি ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। তবে এখানে এটিও উল্লেখ্য যে, বৃটিশ প্রণীত আইন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন ও নীতিমালায় বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি থাকলেও সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদেরকে উপজাতি, নৃ-গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন- ২০১০ এ বাংলাদেশের আদিবাসীদের ‘নৃ-গোষ্ঠী’ ‘উপজাতি’ বলা হয়েছে। এই আইন প্রনয়নের সময় বাংলাদেশের খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী এইচ এফ আরেফিন, সাদেকা হালিম, মেসবা কামাল ও আইনুন নাহার প্রমূখ বাংলাদেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সমাজবিজ্ঞানীদের প্রস্তাবকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানে পরিত্যাজ্য শব্দ ‘উপজাতি’ এবং জাতির পরিচয় দানের ক্ষেত্রে সাযুজ্যহীন শব্দ ‘নৃ-গোষ্ঠী’ আইনে সন্নিবেশিত করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, উক্ত আইনে আদিবাসী শব্দেরও ব্যবহার করা হয়েছে। এইসব আইন প্রনয়নের পূর্ব থেকে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মনিসহ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ বলতে শুরু করেন- বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। এখান থেকেই পরিস্কার যে, বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী স্বীকৃতির প্রশ্নে নানা বিভ্রান্তি, হীনমন্যতা ও দুদুল্যমানতায় ভূগছে। বাংলাদেশের আদিবাসীরা জাতিসংঘ ভাষ্য মতে এবং এতিহাসিকভাবেও ‘আদিবাসী’ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন, নীতিমালা ও কোর্টের বিভিন্ন রায়ে এদেশের আদিবাসীরা ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে। তাহলে বাংলাদেশের সংবিধান ও নতুন আইন সমূহে দেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধা কোথায়?
আত্ম-পরিচয়ের অধিকার মানবাধিকার:
কোন জাতির নাম পরিবর্তন করা, কটুক্তি করা বা কোন জাতিকে নিয়ে মিথ্যার বেসাতি করা কাম্য নয়। কিন্তু সাবেক পররাষ্ট্র দিপু মনিসহ কোন কোন লেখক যেভাবে আদিবাসীদের প্রতি কটুক্তি, অপমানজনক ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান করেছেন ও করছেন তা সত্যিই দু:খজনক। সরকারের একজন দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে এটি আশা করা যায় না। বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারের বিষয়গুলি স্বীকৃত। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার কিংবা সরকারের কোন দাত্বিশীল ব্যক্তি কর্তৃক কোন জনগোষ্ঠীর মানবাধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ একেবারে কাম্য নয়। এটি সংবিধান ও অনুস্বাক্ষরকৃত সনদের সুস্পষ্ট লংঘন। প্রত্যেকটি জাতির আত্ম-পরিচয়ের অধিকার স্বীকৃত। এটি মানবাধিকারের অংশ। বাংলাদেশে ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতি রয়েছে। তারা শত ও হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশের এসব জাতিরা নিজেদের আদিবাসী মনে করে। আদিবাসী অঞ্চলের বাঙালী জনগণও এতদিন জেনে আসছে এরা আদিবাসী। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীরাও বলেছেন এরা উপজাতি বা নৃগোষ্ঠী নয়- এরা আদিবাসী। তাহলে আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে কিসের এত দ্বিধা? কিসের কার্পণ্য ? কিসের এত ভয়? আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে কি কোন জাতি স্বাধীনতা দাবী করার অধিকার রাখে? না কি তাদের এমন অধিকার দিতে হয় যা কোন দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়ে যায়? যেসব দেশ আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সে দেশের স্বার্থ কি ক্ষুন্ন হয়েছে? সেসব দেশের স্বাধীনতা কি বিপন্ন হয়েছে? আদিবাসী স্বীকৃতির সাথে কিছু ক্ষেত্রে ভূমি, শিক্ষা ও চাকরি সংক্রান্ত অধিকারের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু যেসব রাষ্ট্রে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সেসব দেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে?
‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি নেই সেসব দেশের নাগরিকেরাও তাদের দেশে ভূমি, শিক্ষা ও সস্কৃতির অধিকার ভোগ করছে। যেমন- ভারত। ভারতের আদিবাসীরা সে দেশে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃত নয়; কিন্তু সেদেশের আদিবাসীরা জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত ভূমি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি অধিকার এবং এমন কি তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বহু অধিকার ভোগ করে থাকে। যেমন- মেঘালয়, মিজোরাম ও অরুণাচলের আদিবাসীরা ভূমি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অধিকার ভোগ করে থাকে।
বাংলাদেশ সরকার অনুদার না হীনমন্যতাবশত: দেশের আদিবাসীদের অধিকার প্রদান কিংবা আদিবাসী স্বীকৃতি প্রদানে দ্বিধান্বিত হচ্ছে। দ্বিধান্বিত বলছি একারণে যে, সরকার একদিকে বহু আইনে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আবার সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বলছে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই- আছে উপজাতি ও নৃ-গোষ্ঠী। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহু বাণী দিয়েছেন এবং সেসব বাণীতে তাঁরা এদেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। যেখানে প্রধানমন্ত্রীদ্বয় বাণী প্রদানের মাধ্যমে দেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি দিয়েছেন সেখানে সংবিধান বা আইনে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা বা দুদুল্যমানতা থাকবে কেন? জাতীয় সংসদে বর্তমান সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ আসন রয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। এই ধরণের সুযোগ বার বার আসে না। এই ঐতিহাসিক সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার দেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে দুরদর্শিতার পরিচয় দেবে- এটি আদিবাসীদের প্রত্যাশা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন:
৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান ও বাঙালী-আদিবাসী পাকিস্তানী সাম্প্রদায়িক-সামরিক শাসনের বিপরীতে একটি অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ও শোষনমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন হল এবং ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা করা হল। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যখাযথভাবে ধারণ করতে পারেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী-আদিবাসী সকলেই অংশগ্রহণ করেছে, জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা স্বীকার করা হয়নি। এটি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভংগীরই বহি:প্রকাশ। বাংলাদেশের সংধিানে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার সহ তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রদান করা হয়নি। তাই প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের সংবিধান গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারেনি। সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকার কারণে স্বাধীনতার পর বিশেষত: ৭২-৭৫ সালে আদিবাসীরা তাদের চিরায়ত ভূমি হাতছাড়া হয়। এসময়ে সমতল অঞ্চলের আদিবাসীরা অধিক পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আদিবাসীদের জুমভূমি, দখলীয় ভূমি, বন্দোবস্তী কিংবা লীজ নিয়েছে ভূমিখেকো বাঙালীরা আদিবাসীদের অজান্তে। ভূমির ওপর আদিবাসীদের সামাজিক মালিকানা পদ্ধতি সংবিধানে স্বীকৃত না থাকার কারণে ভূমি খেকোরা তথাাকথিত লীজ বা বন্দোবস্ত করার মাধ্যমে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করতে সম্ভব হয়েছে। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, আদিবাসীদের ভূমি মালিকানা ব্যবস্থা আলাদা। আদিবাসীদের ভূমি মালিকানা সামাজিক মালিকানার ওপর প্রতিষ্ঠিতি। ভূমির ব্যক্তি মালিকানা বা বন্দোবস্তি আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনা স্বীকার করে না। সেকারণে আদিবাসীরা ব্যক্তির নামে ভূমি বন্দোবস্তী বা লীজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। বৃটিশ আমলে ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক মালিকানা স্বীকৃত ছিল বিধায় সেসময়ে আদিবাসীরা ভূমি হারায়নি। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর ভারতের সংবিধানে বিভিন্ন প্রদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হলেও পাকিস্তানের সংবিধানে ্আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হযনি। ১৯৭২ সালের সংবিধানেও আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমির অধিকার- ‘সামাজিক মালিকানা’ পদ্ধতি স্বীকার করে নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যক্তি মালিকানা, সরকারী মালিকানা ও সমবায় মালিকানা- এই তিন ধরণের মালিকানা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে মাত্র। আদিবাসীদের সামাজিক মালিকানা পদ্ধতি সংবিধানে স্বীকৃত না থাকায় স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি দেশের বিবেকহীন সম্পদ লোভী ভূমি খেকোরা আদিবাসীদের চিরায়ত ভূমি বেদখল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ’৭৫- এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিশেষত: ’৭৯-’৮০ সালে জিয়াউর রহমান কর্তৃক সেটেলার পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক হারে ভুমি বেদখল, বনসম্পদ ধ্বংস ও সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়। এই সাম্প্রদায়িক হামলার কারণে আদিবাসীরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নিজেদের গ্রাম ছেড়ে ভূমি, বাগান বাগিচা ছেড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরে যেতে বাধ্য হয়। হাজার হাজার পাহাড়ীকে দেশের বাইরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এসময় সেটেলার বাঙালীরা আদিবাসীদের ভূমিতে বসতিস্থাপন করে। এভাবে সেটেলার বাঙালীরা আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করে রেখেছে।
১৯৯৭ সালে পাবৃত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আদিবাসীদের বেদখলকৃত ভূমি ফেরত দেওয়ার কথা রয়েছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন না করে বরং চুক্তি লংঘন করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে চলেছে। এলক্ষে সরকার সেটেলার বাঙালীদের আদিবাসীদের জায়গায় পুনর্বাসন করছে, রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনে উৎসাহ জোগাচ্ছে এবং আশ্রয়সহ নানা সহযোগিতা প্রদান করছে, রাস্তার দু’ধারে সেটেলার পুনবূাসনের লক্ষে নূতন নূতন রাস্তা নির্মাণ করছে, শিক্ষিত বাঙালী সেটেলার পুনর্বাসনের লক্ষে মেডিকেল কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিপরীতে বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের জাতিগত নির্মূলীকরণের কার্যক্রম জোরদার করছে।