23/09/2025
শিক্ষার মর্যাদা অর্থের তুলনায় শ্রেষ্ঠ
এতো এতো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করে কত টাকা বেতন পাও? সিঙ্গারা বিক্রি করে মাসে তোমার চেয়ে বেশি আয়! সিএনজি চালকরাও প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার প্রাথমিক বেতনের চেয়ে বেশি উপার্জন করে। বিদেশে শ্রম বিক্রি করে কতজনই তো স্ত্রীকে ভরিতে ভরিতে সোনা-দানা দেয়। চাকরি করে জীবনে আর কী করলে?—এমন কথায় মনটা বিষিয়ে ওঠে। তবে কি পড়াশোনার মূল্য একেবারেই অর্থবিত্তের বাজারে টিকল না?
অনেকে আবার চাকরি ছেড়ে কচুর লতি চাষ করে লাখ টাকা আয় করছে, কেউ বা ফুচকা বিক্রি করেই কোটিপতি! এসব মন ভোলানো তুলনায় কান দিলে সর্বনাশ ছাড়া কিছুই নেই। শিক্ষার সাথে টাকা-কড়ির সরল তুলনা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
ধরা যাক, প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবীর প্রবেশনকালের বেতন একজন মুচির মাসিক আয়ের সমান কিংবা কম। তা শুনে কি মন খারাপ করা উচিত? কিন্তু যদি মুচিজী তার আয় দ্বিগুণ করতে চান তবে তাঁকে কাজের সময় ও পরিশ্রমও দ্বিগুণ করতে হবে। অথচ চাকরিজীবীর আয় দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ করতে একই অনুপাতে পরিশ্রম বা কর্মক্ষেত্রে সময় ব্যয় বাড়ানো লাগে না। অপেক্ষা করতে হয়, সময়কে সুযোগ দিতে হয়। শিক্ষার যে ভিন্নতর মূল্য আছে, শিক্ষিতের যে সমাজে স্বীকৃতি আছে, তা হাতে-কলমে বোঝা যায়। জীবনের কোনো শিক্ষা কখনোই বৃথা যায় না।
তাহলে কেন মানুষ চাকরির জন্য এত হাপিত্যেশ করে, যদিও ভ্যানচালকের আয় বেশি? উত্তর একটাই—সম্মান। আত্মসম্মান না থাকলে যে কাউকে যে কোনো মুহূর্তে আত্মসমর্পণ করতে হয়। কোনো পেশাকেই খাটো করা হচ্ছে না, তবে শিক্ষার আলো যে পথ উন্মোচন করে তা জীবনের দিশা বদলায়। অশিক্ষিতের হাতে বিপুল অর্থ দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক সমন্বয়।
জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষের কাজ ক্ষুদ্র হতে পারে, আয় সীমিত হতে পারে, পরিবেশ প্রতিকূলও হতে পারে, কিন্তু সে জীবনের জয়যাত্রার অংশ হয়ে ওঠে। অর্থসম্পদ-ই জীবনের একমাত্র চাওয়া নয়—জ্ঞান ও জ্ঞানীর ছায়াই জীবনের প্রকৃত আশ্রয়।
অন্যের আয়ের সাথে তুলনা করে নিজের অবস্থান পরিমাপ করা কখনো বুদ্ধিদীপ্ত নয়। পেশাগত সম্মান জীবনের জন্য অক্সিজেনের মতো অপরিহার্য। কত ছোট কাজ করছো বা কত বেতন পাচ্ছো—তার চেয়ে জরুরি হলো জীবনের জটিলতা কত সহজে মোকাবিলা করতে পারছো।
জ্ঞানের আলো ছাড়া কাউকে আলোকিত করা অসম্ভব। একজন রিকশাচালক অর্থের বিনিময়ে সেবা দেন, আর একজন জ্ঞানী চিন্তার বিনিময়ে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেন। কোনটা শ্রেষ্ঠ—তা নির্ধারণ করতে হয় নিজের বিবেক দিয়ে। তবে শিক্ষার মূল্য সর্বদাই অতুলনীয়। জ্ঞানীর জীবন অভাবে কেটে যেতে পারে, কিন্তু সেই অভাবেও সুখ আবিষ্কারের বিস্ময় থাকে।
অন্যের আয়ের প্রতি লোভী হয়ে নিজের বোধ-বুদ্ধি, চিন্তা ও চেতনা বিসর্জন দেওয়া অনুচিত। কেউ যদি গোবর নেড়ে কোটি টাকা আয়ও করে—তবু তার সাথে তুলনা করা স্বভাববিরুদ্ধ হওয়া উচিত। বেশি আয় করার পথ সবার সামনে উন্মুক্ত; যার প্রয়োজন বেশি সে চেষ্টা করবে। তবে শিক্ষা ও সার্টিফিকেটের সাথে বিদেশি শ্রম বিক্রির তুলনা করা কেবলই গোস্তাখি।
চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করতে না পারলে মানবিক গুণাবলি অর্জনও সম্ভব নয়। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি অর্থ গ্রহণ না করেন—তাহলেই প্রমাণ হয় শিক্ষা আসল সম্পদ, আর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।
অন্যের সম্পদ দেখে লোভে ভেসে গেলে কিংবা সারাক্ষণ তুলনায় ব্যস্ত থাকলে মন খারাপই দীর্ঘায়িত হবে। বরং ব্যস্ততা বাড়ুক দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে। জীবনে সম্পদ থাকুক এতটুকুই, যা সহজভাবে সময় কাটাতে সাহায্য করে। অবশিষ্ট সময় থাকুক শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো অর্জনে প্রস্তুত মন নিয়ে।
সম্মান অর্জনের পথ খুঁজে নেওয়াই আসল করণীয়। অর্থ-প্রাচুর্যে চেয়ার কেনা যায়, কিন্তু যোগ্যতা ও সম্মান কেনা যায় না।