কায়া-kaya

কায়া-kaya স্বপ্নবোনা কারিগর আমি
হাতে আছে কাগজের তরবারি
চললাম অভিনয়ে বাস্তবতার থিয়েটারে

- কায়া
(2)

 #তপনকাব্যধরণঃ  #সামাজিক_গল্পলেখনীতে কায়াপর্ব-২৬নির্ঝরের এ সমস্ত কথা তার ভয়েস টেপ রেকর্ড এ জমা করে রেখেছিলো। সোহাগি তো চ...
27/09/2025

#তপনকাব্য
ধরণঃ #সামাজিক_গল্প
লেখনীতে কায়া
পর্ব-২৬

নির্ঝরের এ সমস্ত কথা তার ভয়েস টেপ রেকর্ড এ জমা করে রেখেছিলো। সোহাগি তো চিঠি পড়তে পারে না তাই সে জমা করে রেখেছে এতোদিনের না বলা বার্তাগুলো, যদি পারতো সে কতো শত চিঠি তার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতো।

কিন্তু এই টেপ রেকর্ডটি যে সোহাগির ধারে আজো পৌঁছাতে পারে নি। সেদিনের দিঘিরপাড়ে নির্ঝর এই কারণটির জন্যে গিয়েছিলো কিন্তু সোহাগি তাকে বারংবার উপেক্ষায় করে গেলো। তার কথা একটিবারও শুনার প্রয়োজনবোধ করে নি। সোহাগির ভালোবাসা এতোটা নির্বোধ হলো কবে থেকে? যাকে সে মন দিয়েছে তাকে কীভাবে উপেক্ষা করে থাকতে পারে সোহাগি? আজো কি সোহাগি ভালোবাসেছে তাকে? নাকি সম্পূর্ণটায় সোহাগির আবেগী মনের দোষ? হতেও পারে সেটা।

বিছানার উপড় পড়ে থাকা টেপ রেকর্ডটির দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে আছে নির্ঝর। কবে সে সোহাগিকে শুনাতে পারবে এই টেপে নিবদ্ধ থাকা তার বার্তাগুলি? এই কথায় সে ভেবে যায়। তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে প্রশান্ত হাজির হয়। প্রশান্ত তাকে কিছু বলতেই এসেছে। কিন্তু আজ নির্ঝরের খুব একা থাকতে মন চাইছে ঠিক ছেলেবেলায় যে একাকিত্ব তাকে ঘিরে রাখতো আজ সে নিজেই একাকিত্বের সঙ্গী হতে চাইছে। বাহিরে আজ সম্পূর্ণ চাঁদের রূপ ভেসে উঠেছে। গোলাকার রূপালি থালার মতন চাঁদটির আলো বারান্দাতেও এসেছে। স্নিগ্ধ হাওয়া নির্ঝরের ঘরজুড়ে বইয়ে যাইছে কিন্তু নির্ঝরের ভিতরে থাকা তপ্তহৃদয়ে সে হাওয়া স্পর্শও পর্যন্ত করতে পারছে না।

বিছানায় বসে প্রশান্ত নির্ঝরকে বলে," তাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দাও নির্ঝর সবকিছু যে ভাগ্যে মেলে না "

ভাগ্যের কথা প্রশান্তের মুখে শুনে বড়ই অবাক হয়। প্রশান্ত সেই ছেলে যাকে নির্ঝর দেখে এসেছে বিলাসিতার মালঞ্চ দিয়ে সাজানো তার জীবন। প্রশান্ত তো জানে না নির্ঝরের কাছে ভাগ্য বলতে সে সোহাগিনীকেই বুঝে। এতোটাদিন সে শুধু সবার কথায় ভেবে এসেছে। সবার ভাগ্য গড়তে সে আলোর দিশারী হয়ে রয়েছে। যখন সে নিজের ভাগ্যকে গড়তে গেলো সে চারদিকটা শূণ্য মরূদ্যান বাদে কিছুই দেখতে পেলো না। সৃষ্টিকর্তা কি তার ভাগ্যে এতোটুকু প্রাপ্যতা লিখে রাখে নি।

নির্ঝর বলে, " কাউকে কি মনে স্থান দিয়েছো প্রশান্ত? "

নির্ঝরের কথা শুনে প্রশান্ত বাঁকা একফালি হাসি দিয়ে করে বলে," শুধু মনে নয় নয় নির্ঝর, তার জন্য আমি অন্তরে গোটা একটা জগৎ তৈরি করে রেখেছি। যে জগতে সে ছাড়া আর কারো স্থান নেই "

নির্ঝর বলে," কখনো তো সে কথা আমায় বলো নি তুমি "

প্রশান্ত," আমি বললে কি তুমি সেটা শুনতে? "

নির্ঝর বলে," কখনো কি তোমার কোনো কথা আমি ফেলেছি, প্রশান্ত? তোমার মন রাখার তো অনেক চেষ্টায় করলাম "

প্রশান্ত সেই কথার জবাব সে দেয় না। শুধু তাকিয়ে থাকে বিছানার উপর পড়ে থাকা টেপ রেকর্ডটির উপর। তারপর সে নির্ঝরকে বলে," চলো নির্ঝর, বসার ঘরে চলো।ওখানে সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে "

নির্ঝর বলে," কেনো? "

প্রশান্ত বলে," গেলেই তো দেখতে পাবে কিসের জন্য অপেক্ষা করছে তারা "

প্রশান্তের কথায় কৌতুহলী হয়ে নির্ঝরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিসের বার্তা তাকে শুনতে হবে আবার? নির্ঝর তা জানার জন্যেই পা বাড়ায়। এইদিকে বিছানার উপর পড়ে থাকা টেপ রেকর্ডটি প্রশান্ত তার কাছে রেখে দেয়। তারপর সেও বেড়িয়ে পড়ে নির্ঝরের ঘর থেকে।

বসার ঘরে নির্ঝর দেখে তার বাবা, মুন্তাসির, একজন উকিল, তার বোন ময়না আর সঙ্গে আছে ময়নার ননদিনী। তাদের উদ্দেশ্য কী নির্ঝর বুঝে উঠতে পারে না। প্রশান্ত এতক্ষণে এসে সেই স্থানে উপস্থিত হয়।

একটি দলিলের মত কাগজ বের করে উকিল নির্ঝরকে বলে, " দাও নির্ঝর কাগজে স্বাক্ষরটি করে দাও "

নির্ঝর বলে, " কিসের জন্য করবো কোনো স্কুল তৈরি করবে বুঝি?"

নুরুল বলে," তোমার বিয়ের জন্যে তো তোমার স্বাক্ষর লাগবে "

নির্ঝর কিছুটা অবাক হয়ে হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে," তোমরা কি পাগল হয়ে গেলে? আমায় না জানিয়ে তোমরা আমার ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নাও "

নুরুল বলে, " আমি তোমার বাপজান। তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধীকার আমার আছে "

নির্ঝর তাচ্ছিল্য সুরে বলে, " বাপ হওয়ার যোগ্যতা কি তোমার আছে, নুরুল হাওলাদার "

নুরুল এবার যথেষ্ট রেগে যায়। ছেলে তাকে শুরু থেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে অপমান করে এসেছে। নিজের বাপকে যোগ্য সম্মানটুকু দিতে পারে না। সে আবার উচ্চ শিক্ষিত দাবি করে। নিজের সমস্ত জীবন তাদের মানুষ করতেই ব্যয় করে দিয়েছে। লোকেদের কাছে নিজের বাপকে পাপিষ্ঠ প্রমাণ করে নিজেকে মহৎ সাজিয়েছে। আর কী করলে নির্ঝর সুখে থাকবে। একদফা বাপ-ছেলের মধ্যে দ্বন্দ লেগে যায়। নুরুল তাকে কোনো কথা শুনাতে বাদ রাখে নি। নির্ঝরও চুপ থাকে নি নুরুলের প্রতিটা কথার পাল্টা জবাব সে দিয়ে এসেছে।

একটা মূহুর্তে এসে আর কারো কথা সহ্য করতে পারছে না। নির্ঝর চেঁচিয়ে উঠে। ধীরে ধীরে সে ঘরে থাকা একেকটা জিনিস ছুঁড়ে ফেলে। নির্ঝরের আচরণ দেখে উপস্থিত থাকা সকলেই ভরকে যায়। এর আগে কখনো নির্ঝরকে এমন করতে দেখে নি কেউ। ময়না ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। সে নির্ঝরের এমন অস্থির আচরণের সঙ্গে পরিচিত নয়। ধীরে ধীরে নির্ঝরের চোখে এক অনাকাঙ্ক্ষিত উন্মাদনার ঝিলিক দেখা যায়। চোখজোড়ায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। নির্ঝরের নিশ্বাসে কেমন জানি অস্থিরতার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। একে একে সে ঘরের সমস্ত জিনিস ছুঁড়ে ফেলে। কাঁচের তৈরি জিনিসগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কেউই তার কাছে এগিয়ে আসতে সাহস করছে না। হঠাৎ নির্ঝরের কী হলো? কেন এমন করছে সে?

বাহিরে ওই দূরের আকাশে যেখানে পূর্ণিমা চাঁদের আলোর জ্বলকানিতে পরিবেশ ঘুমিয়ে আছে সেখানে নির্ঝরের হৃদয় আজ উন্মাদের মতন অস্থির রূপ ধারণ করে আছে।

ভোর হওয়ার পরপরই গ্রামে গ্রামে লোকেদের মুখে একটি কথা জপে যায় সকলে। নির্ঝর পাগল হয়ে গেছে। পাগল নির্ঝরকে কেউ শান্ত করতে পারছে না। এমন শান্ত ছেলে কীভাবে পাগল হয়ে গেলো কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। দৌলতি পাগলের মতো ছুটে আসে সোহাগিদের বাড়িতে। উঠানে এসে থামে সে। সোহাগিকে জোরে জোরে ডেকে উঠে। দৌলতির মন অস্থির হয়ে আছে। সে হাঁপিয়ে উঠেছে।

সোহাগি ঘরের ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসলে তড়িঘড়ি করে দৌলতি জানায়, " বিলাতি নির্ঝর নাকি পাগল হয়ে গেছে সোহাগি "

সোহাগি কথাটি শুনে চমকে উঠে বলে," কী কইতাছো তুমি এইগুলা? "

দৌলতি বলে," খালি আমি না সারা গেরামের মানুষ একেই কথা কইতাছে "

দৌলতির মুখ থেকে এমন কথা শুনার জন্যে সোহাগি কোনোমতে প্রস্তুত ছিলো না। এ কি কথা শুনালো দৌলতি? সোহাগির ভেতরখান যে দুমড়ে-মুচড়ে গেলো এই কথাটি শুনে। এক রাতের মধ্যে নির্ঝর পাগল হয়ে গেলো কী করে? সোহাগিই কেনো বারবার কষ্ট পায়? তার ভেতরটা একেবারে শূণ্য হয়ে গেলো। এতোদিন যার জন্যে সে পাগলামি করে এসেছে আজ সে পাগল হয়ে গেলো। পাগলামি তো সোহাগি করেছে, পাগল সোহাগির হওয়ার কথা অথচ নির্ঝর পাগল হলো। এই কেমন নিয়তির প্রতিদান সোহাগি যে বুঝে উঠে না। তার এখন কী করা উচিত?

ঘরে সোহাগির একটা মূহুর্তেও শান্তিতে থাকতে পারছে না। সোহাগির ইচ্ছে করছে এখনি ছুটে যায় নির্ঝরের কাছে। কিন্তু সে কীভাবে যাবে? তাকে যে ঘর থেকেই বের হতে দেয় না তাহেরা। ঘরের এক কোণে নীরবে সে কাঁদতে থাকে। তার জীবনে এতো এতো আফসোস কেনো? সে কেনো নির্ঝরের জন্যে কাঁদবে।

বিড়বিড় করে সে বলে," লোকটা সেদিন কতো আশা লইয়া আইছিলো তার কথাখান কইতে। আমি হুনি নাই একটা কথাও। আমার কিসের এতো অভিমাণ অইলো গো মাবুদ? "

সোহাগি আবার নিজেকে বলে, " আমি কেরে বিলেতি সাহেবের কথাডি হুনলাম না। যদি হুনতাম তাইলে তো এতো আফসোস লাগতো না "

সোহাগি বুঝে উঠে না কীভাবে সে নির্ঝরকে এক পলক দেখতে পারবে।

এইদিকে গ্রাম থেকে গ্রামে সবার মুখে এক কথা নির্ঝর পাগল হয়ে গেছে। তাকে ঘরে আঁটকে রেখেছে বাহিরে থাকা কাঁচারি ঘরে । সে ঘরের সবকিছু তছনছ করে ফেলেছে।কারো কথা সে শুনছে না। কত শত লোক নির্ঝরকে দেখতে গেলো ঠিক ওইদিনের মতন যেদিন নির্ঝর বিলেত থেকে গ্রামে ফিরে এসেছিলো। সবার মনে একটাই আফসোস জন্মালো। যাকে গ্রামের সকলেই নেতা মনে করে এসেছে সেই লোকটা আজ পাগল হয়ে গেছে। এখন তাদের পাশে কে থাকবে? নির্ঝরের মতন তো গ্রামের আর কেউ নেই। এমন ভালো ছেলেটির সঙ্গে কেনো এমন হলো? সকলেই নির্ঝরের জন্য খোদার কাছে মিনতি করতে থাকে।

বেলা শেষ হয়ে সূর্য হেলে পড়লো বিকেল নেমে আসে। গ্রাম এখন খুবই শান্ত। এটাই সুযোগ সোহাগির জন্যে। এই ফাঁকে সোহাগি একবার নির্ঝরকে দেখে আসতে পারবে। সে আশায় সে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে। নির্ঝরকে দেখার জন্যে তার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ছিলো। সে গ্রাম পেড়িয়ে ছুটে যেতে থাকে। কোনো কানে সে থামে না। নির্ঝরদের বাড়ির সামনে এসে তবেই সে একটি বড় নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর সাহস করে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে সবার চোখের আঁড়ালে। তারপর সে কাঁচারিঘরের জানালার সামনে এসে খুঁজতে থাকে নির্ঝকে। নির্ঝরকে দেখে সোহাগি বড় অবাক হয়। এমন সুদর্শন পুরুষটিকে দেখে বুঝার উপায় নেয় যে কিছুদিন আগে এই পুরুষটির জন্যে সোহাগি পাগলামি করতো। সে সত্যিই পাগল হয়ে গেছে।তাকে বেঁধে রেখেছে যে। নির্ঝরকে সে ডাকলে নির্ঝরের কান অব্দি তার কথা পৌঁছায় না।

নির্ঝরের কানে সোহাগির ডাক না পৌঁছালেও নুরুল ঠিকই শুনে ফেলে সোহাগির কন্ঠস্বর। নুরুল সেই দৃশ্যটি দেখে ক্রোধে জ্বলতে থাকে। তার চোখ লাল হয়ে যায়। পেছন থেকে নুরুল সোহাগির চুলের মুঠি ধরে বলে, " তাইলে তোর কারণে আমার সরল পোলা পাগল হয়ছে। তুই সব নষ্টের গোঁড়া। আজকে তোদের আমি গ্রামছাড়া করুম না হয় সব আগুনে পুড়ায় ফেলুম "

সোহাগি চুলের মুঠি সে বেশ শক্ত করে ধরে। যার কারণে সোহাগির বড় কষ্ট হতে থাকে। চুলের ব্যাথায় সে অস্ফুট শব্দ করে উঠে। সে বুঝে যায় আজ তাদের শেষদিন। অঝোরে চোখের পানি পড়তে থাকে তার । না জানি তাদের সঙ্গে কী হয়?

চলবে...

 #তপনকাব্যধরণঃ  #সামাজিক_গল্পলেখনীতে কায়াপর্ব-২৫আমি নির্ঝর হাওলাদার।  নুরুল হাওলাদারের  বড় ছেলে নির্ঝর হাওলাদার।    " হা...
26/09/2025

#তপনকাব্য
ধরণঃ #সামাজিক_গল্প
লেখনীতে কায়া
পর্ব-২৫

আমি নির্ঝর হাওলাদার। নুরুল হাওলাদারের বড় ছেলে নির্ঝর হাওলাদার। " হাওলদার " শব্দটি কবে থেকে আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমার দাদাজান হাশেম আলী ছিলো একজন পাট ব্যবসায়ী তার নামের সঙ্গে আমি কখনো হাওলাদার শব্দটি দেখি নি। দাদাজানকে জিজ্ঞেস করার কোনো উপায় তখন ছিলো না কারণ আমি নিজেই অবুঝ শিশু ছিলাম। বুঝ হবার বয়সে বাপজানকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কবে থেকে আমরা হাওলাদার হলাম? কিন্তু বাপজান কখনো আমায় সেই প্রশ্নের উত্তর দেয় নি।

আমায় সে বুঝিয়ে এসেছে আমরা সমাজের বিশেষ স্থানের মানুষ, আমাদের দাপটই ছিলো আলাদা, লোকেরাই আমাদের সম্মানের স্থানটিতে নিয়ে গেছে কিন্তু বড় হওয়ার পরিক্রমায় আমি দেখে এসেছি ওরা সম্মানের চেয়ে বরং ভয়ের চোখে বেশি দেখেছে। যার কারণে আমি একা একা বড় হয়েছি কেউ মেশে নি আমার সঙ্গে, কেউ আপন করে নি আমায় কারণ আমি নুরুল হাওলাদারের ছেলে, সকলেই এড়িয়ে চলতো আমায়। থাকার মধ্যে ছিলো প্রশান্ত আর কাজল। হ্যাঁ, কাজল মোল্লা বাড়ির বড় ছেলে যে কি না আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলো এখনো আছে সে।

কাজলের জীবন সুখের ছিলো না তা হয়তো জেনে গেছো ইতোমধ্যেই। বাকি রইলো প্রশান্ত, প্রশান্ত শেখ ছিলো জমিদার বাড়ির বড় ছেলে। সাধারণ ছেলেরা আমার আড়ালে আমাকে বলতো দালালের ঘরে দুলালি ছেলে। আমি কিন্তু তখন বাপজানের দাপট দেখাতে পারতাম কিন্তু করি নি। আমার বাপজানের সম্পত্তি ছিলো। টাকা ছিলো, সম্মান ছিলো, মা ছিলো সবকিছুই ছিলো তবুও আমি একা কেনো বোধ করতাম? কিসের অভাব ছিলো আমার?

আমার মা ছিলো জমিদার বাড়ির মেয়ে। জমিদার বাড়ির মেয়ে হওয়ায় তার ভাবভঙ্গি বড়ই আলাদা ছিলো। তার রুপের প্রতি যেমন মায়া ছিলো তেমনি অর্থেরও প্রতি মায়া ছিলো। বাপজানের সাফল্যের অবদানে বেশিরভাগ আমার মায় পাশে ছিলো। সুখের বিলাসিতায় মায়ের সংসার সাজানো ছিলো কিন্তু সে সময় গ্রামে অহরহ মানুষ মরেছে ক্যান্সারে। আমার মাও একই রোগে নিজের জীবন হারায়। সেই থেকে আমার ছোটভাই মুন্তাসির ঠিক করেছিলো বড় হয়ে ডাক্তার হবে।

আমি ঠিক করেছিলাম একজন জার্নালিস্ট হবো । আমাদের গ্রামের সমস্ত দুর্ভিক্ষ দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দিবো কিন্তু তা আর হয়ে উঠে নি সে ব্যর্থতা অবশ্য আমি গ্রামকে দিবো না বরং দোষটা আমার নিজেরই, হয়তো কোথাও আমার খামতি ছিলো। আমাদের গ্রামটি ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার একটি ছোট গ্রাম। যেখানে কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই, আর না আছে স্বাস্থ সেবার সুযোগ। গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দেয় তখন বুঝতে পারি আমাদের গ্রামটি অন্ধকারের গোহায় আটকে আছে এতোদিন ধরে। কোথায় শহরের চাকচিক্যময় জীবন আর কোথায় দু বেলা অন্নের অভাবে জীবন যাওয়া আমার গ্রামের মানুষজন।

সে কথা বলে আমি আমার গ্রামকে ছোট করবো না আর । আমি চেষ্টা করেছিলাম, অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম এই গ্রামকে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে কিন্তু পারি নি কেনো পারি নি সেটা নিয়েও নিজের উপর কোনো ক্ষোভ জন্মাতে পারলাম না । আচ্ছা কেনো পারলাম না আমি? কেনো ব্যর্থ হলাম আমি? তারপর আমি আমার স্বপ্নকে পিছনে রেখে মুন্তাসিরের স্বপ্ন পূরণে হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ালাম। তার স্বপ্ন ছিলো তার নামেই গ্রামে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা হবে। তাই আমি প্রসাশনের বিভিন্ন হাঙ্গামা সঙ্গে কাজ করতে থাকি, প্রশান্তকে চেয়ারম্যান বানাতে লেগে পড়েছিলাম বিভিন্ন প্রচারে, শেষে ইংল্যান্ডেও গিয়েছি। কতটুকু করতে পেরেছি আমি জানি না তবে যতদিন পর্যন্ত প্রসাশনের চোখে, দেশের সাংবাদিকদের চোখে,সকলের চোখে এই গ্রামের পরিচয় তুলে ধরতে না পেরেছি ততদিন পর্যন্ত করে যাবো।

দূরের ওই আকাশে যেমন রাত নেমে আসলে চাঁদের পাশে হাজারো তারার মেলা বসে। এই তারাগুলোকে যখন একসাথে দেখে সকলে, তখন তাদের ভিতরে থাকা সমস্ত যাতনা, সমস্ত বেদনা ভুলে গিয়ে অকারণেই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি খেলে যায় মনমন্দিরে অজান্তে ভালো লাগতে শুরু হয়। আমিও চেয়েছিলাম এমন হতে। নক্ষত্র যেমন নিজের সর্বোচ্চ আলো দিয়ে সমস্ত অন্ধকারকে দূর করে রাখে, আমিও চেয়েছিলাম আমার বানানো সমাজে সমস্ত অন্ধকার কাজকে দূরে সরিয়ে দেবো। আকাশের তারাগুলো নিজেকে বিলীন করে জগতের মানুষের কাছে আরাধ্য হয়ে বাঁচে, আমিও তেমনই সমাজের চোখে তারা হয়ে বাঁচতে চেয়েছি। সে পথ যে অতো সহজ নয় তা আমি জানি তবুও আমার গ্রামের লোকদের জন্য সামান্য হলেও আমি কিছু দিয়ে যাবো এইটাই ভেবে এসেছি। এটাই যে আমার স্বপ্ন।

এই অল্প কিছুদিনে আমি তাদের নেতা হয়ে উঠেছি। সে কথা আমি অহংকার করে বলছি না এই সমাজই আমাকে নেতার স্থানে নিয়ে গেছে যে, জানি না কতোদিন তাদের এই আলোর দিশারী হয়ে রবো। এটা বলার কারণ হলো সকলেই বিশ্বাস পাপিষ্ঠ বাপের ঘরে পাপিষ্ঠ ছেলেরই জন্ম হয়।

আমার পথের বিপথ হলো আমার বাপজান। সে চাইতো আমি তার শক্তিকে প্রয়োগ করে সমাজকে হাতে রাখি কিন্তু আমি তা কোনো প্রতিষ্ঠানে শিখি নি। আমার বাবা দালালি করে, অন্যের সম্পদকে ভোগ করে যতটা না নিজের উন্নতি করেছে তারচেয়ে বরং আমার ক্ষতিটায় বেশি করেছে সেই সূক্ষ্ম ক্ষতি তার চোখে পড়ে না আর যদি পড়েও তা কখনো স্বীকারও করে না। আগেও বলেছি আমার অতিরিক্ত সঙ্গী ছিলো না। কিন্তু একদিন আমি কাজলদের গ্রামে গিয়েছিলাম কাজলের খুঁজে। তাদের দিঘিপাড়ে দেখি কিছু ছেলেমেয়েকে খেলতেকোড়ই গাছের তলায়।

তাদের খেলা দেখতে আমার খুব ভালো লেগেছিলো। তখন ভাবতাম ইসস! আমি যদি তাদের সঙ্গে খেলতে পারতাম, তারা যদি আমার সঙ্গে মেশতো আমায় আপন করে নিতো?

হঠাৎ দেখি একজন লোক লাঠি নিয়ে তাদের তাড়া করছে, ছেলেমেয়েগুলো ছুটে পালায় তখন। লোকটাও তাদের পিছু নেয়। আমি যখন দৃশ্য টা আরো কাছ থেকে দেখার জন্যে ওই গাছ অব্দি পৌঁছায় আচমকা গাছ থেকে একটি ছোট মেয়ে পড়ে যায় নিচে। মেয়েটি অনেকটা ভরকে গিয়েছিলো হয়তো মনে করেছিলো আমি কাজল। মেয়েটি খুবই সুন্দর ছিলো। ডাগর ডাগর চোখ, পুতুলের মতন দেখতে সে, গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট তার। আর সেই মেয়েটি হলো আজকের সোহাগি। সেদিনেই সোহাগি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলো আমি কাজল না হলে আমি কে? কিন্তু সেদিন আমি পরিচয় দিই নি। আমি ভেবেছিলাম সোহাগি আমার পরিচয় জানার পর কখনো আমার চোখের সামনে পড়তে চাইবে না তাই আমি পরিচয়হীন রূপে তার খেলার সঙ্গী হয়েছিলাম।

এভাবে আমি সোহাগির অচেনা সঙ্গী হয়ে থাকলাম। বেশিরভাগ সময়টা আমি সোনাগাঁও এ কাটিয়ে দিতাম সোহাগির সঙ্গে। সে বলতো আমায় নাকি তার গল্পের রাজপুত্রের মতো দেখতে লাগি। আমি ওর বাচ্চা বাচ্চা কথায় খুব মজা পেতাম। একদিন তাকে বিদায় না জানিয়ে গ্রাম ছেড়েছিলাম। তারও কারণ আছে, ছোট সোহাগি তখন সাঁতার জানতো না। শাপলাবিলে দুইজনে নৌকায় করে মাঝনদীতে গেলে সোহাগি আমার জন্যে হাত বাড়িয়ে শাপলা ধরতে গিয়ে পড়ে যায়।

তাকে পড়ে যেতে দেখে আমি অনেকটা ভরকে গিয়েছিলাম। মুহুর্তের মধ্যে আমার বুকজুড়ে শীতল হওয়া ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। হৃৎস্পন্দনের ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়। ছোট সোহাগি হাত থাপরাতে থাকে সে পানিতে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলো । তড়িঘড়ি করে আমি পানিতে ঝাপ দিই। অনেক কষ্ট করে মাঝনদী থেকে তাকে ঘাটে নিয়ে শুইয়ে রাখি। দূর থেকে কিছু লোক দৌড়ে আসে। আমি তাদের দেখে ভয় পেয়ে যায় তারা যদি আমায় দেখে তাহলে বাবার কাছে নালিশ যাবে নইলে ওরা হয়তো মারবে, আমায় ভুল বুঝবে তাই সেদিন সোহাগিকে ঘাটের কাছে রেখে লুকিয়ে পড়ি।

ওরা সোহাগিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আড়াল থেকেই দেখতে থাকি ছোট সোহাগিকে। মেয়েটির নাক-মুখ দিয়ে শাপলাবিলে থাকা প্রচুর ঘোলাটে পানি বের হয়েছিলো। আরেকটু দেরি হলে হয়তো মেয়েটার প্রাণনাশ হতো। শুনেছিলাম সোহাগি সুস্থ হতে বেশ সপ্তাহখানেক লেগেছে। ঠিক করেছিলাম আর কখনো তার ধারে যাবো না। আমার কারণে সোহাগি মরতে বসেছিলো যে, কিন্তু আমার এই অবাধ্য মনটা খুব পুড়ছিলো সোহাগিনীর জন্যে। হয়তো সেদিনের পর থেকে আমার জন্যে অনেক অপেক্ষায় ছিলো সে। হয়তো সে প্রতিদিনই অপেক্ষা করতো। হয়তো মনে মনে অনেক বকাও দিতো আমায়।

সেদিন যখন আমি সোহাগিকে বেলগাছ থেকে নামতে দেখলাম আমার ভিতরে থাকা হৃৎস্পন্দনে অস্থিরতা শুরু হয়। ধক ধক শব্দটা বাড়তেই থাকে। তাকে দেখার জন্যে আমার তপ্তহৃদয় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। সেদিন তাকে দেখে আমি চিনতে পারলেও সে চিনতে পারে নি। সোহাগিনী কি তার রাজপুত্রকে ভুলে গিয়েছে? আজো সে জানে না আমিই ছিলাম তার রাজপুত্র। প্রতিবার আমি ছুটে আসি তাকে একপলক দেখার জন্যে। আমি বুঝতাম তার আবেগী মনের আঙিনায় এই বিলেতি নির্ঝর জায়গা করে নিয়েছে। পুতুলের মতন অমন মায়ময় চেহারায় এতোদিনের লাজুক হাসির কারণটা যে আমি ছিলাম তাও আমি বুঝেছি। আমাকে একবেলা দেখার ব্যাকুল হৃদয় যে ছটফট করতো তাও জানতাম।

একদিন সে আমায় দেখতে আসে নি বলে আমি নিজেই তাদের বাড়িতে যায় কিন্তু সে ছিলোনা। ফেরার সময় দেখি সোহাগিনীকে,সেও ফিরে আসছে তাই সেদিন ইচ্ছে করে শাপলাবিলের পথটি পিচ্ছিল করে রেখেছিলাম। আমার জন্যে করা পাগলামিগুলো আমায় আরো বেশি অস্থির করে তুলে সোহাগিনী।

লাজুক সোহাগিনী যে আমায় কখনো তার মনের কথাগুলো বলতে পারবে না তা আমি বুঝে গেছি। সেইজন্যে আমি নিজেই ভেবেছিলাম সোহাগিনীকে বলবো তাকে যে আমি আমার বউ বানাতে চাই। কিন্তু সেদিন পথে দেখলাম কাজলের জন্যে বাতাসির ব্যাকুলতা, বাতাসি যে আমার কাছে বড় মিনতি করে বলেছিলো। ভালো তো আমিও বাসি তোমায়। সেই ভালোবাসা যখন বিশাল জীবনের অপ্রাপ্তি হয়ে থাকবে তখন সে মানুষটার জীবনে সবচেয়ে বড় আফসোস হয়ে দাঁড়াবে প্রাণসঙ্গীকে না পাওয়ার তৃষ্ণা যে তৃষ্ণা কোনোদিন মিটবে না যে সোহাগিনী। ঠিক যেমন তোমায় না পেলে আমি শূণ্য সাগরে মৃত মাঝি হয়ে থাকবো। তুমিই যে আমার গোটা জীবনের প্রাপ্তি সোহাগিনী।

কিন্তু সোহাগিনী, আমার কর্ম যে তোমার ধ্বংস ডেকে আনবে তা কখনো আমি কল্পনাতেও আনিনি। সোহাগিনী,তোমার জীবনক্ষয়ের কারণটা বারবার আমি কেনো হই? আবার আমি তোমায় কষ্ট দিলাম। তোমার মনবাগানের মালি হতে গিয়ে আমি বারবার বিনাশকারী হচ্ছি। আচ্ছা সোহাগিনী, আমি কি শুধু বিনাশই ডেকে আনি? বলো। জানি তুমি বলবে না আমায়। কোনোদিনই হয়তো বলবে না আমায়। তুমি না বললেও আমি আজীবন বলবো, জীবনবিনাশের দাঁড়গোড়ায় এসেও আমি বলবো " আমি তোমায় ভালোবাসি সোহাগিনী "

তুমি ঘৃণা করলেও তোমার রাজপুত্র কখনো তোমায় হৃদয় থেকে ছুঁড়ে ফেলবে না কারণ সে ভাগ্য বলতে তোমায় বুঝে, শুধু তোমাকেই বুঝে সোহাগিনী।

চলবে...

 #তপনকাব্যধরণঃ  #সামাজিক_গল্পলেখনীতে কায়াপর্ব-২৪গ্রামজুড়ে কোথাও বাতাসির খোঁজ মেলে না। শত শত লোকেদের ভীড় জমে গিয়েছে সোহাগ...
25/09/2025

#তপনকাব্য
ধরণঃ #সামাজিক_গল্প
লেখনীতে কায়া
পর্ব-২৪

গ্রামজুড়ে কোথাও বাতাসির খোঁজ মেলে না। শত শত লোকেদের ভীড় জমে গিয়েছে সোহাগিদের বাড়ির আনাচে-কানাচেতে। মধ্য উঠানে বেশ বড় করে বৈঠকখানা করেছে, এবার যে সত্যি সত্যি বড় ধরনের সালিশি হবে তা সকলেই বুঝেছে। কিন্তু শালিসের রায় যে কী হতে পারে সেইটা দেখারই উত্তেজনা লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভর করেছে তাই তো খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে, কাজ-কাম, স্কুল কামায় করে ছোট বড় সবারই গিজগিজানিতে মেলা জমেছে।

বদরু সালিশের কেন্দ্রে ঘাপটি মেরে বসে আছে শুধু সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। সে জানে তাদের দেওয়া রায় বদরুর পরিবারের জন্য শাপ ডেকে আনবে তাও সে নিরুপায়ের মতন থাকে। বারান্দায় নিতাই স্থির দাঁড়িয়ে সালিশি দেখে। অন্দরে মা-মেয়ে আড়ি পেতে বসে রয়েছে চেহারায় তাদের স্পষ্ট ভীতুর চাপ বুঝা যায়। সোহাগির ডাগর ডাগর চোখ জানালার বাহিরে থাকা চেয়ারম্যান ব্যক্তিটির দিকে স্থির হয়ে আছে কারণ যে ওই ব্যক্তিটিই ছিলো রায় দেওয়ার একমাত্র মাতবর। সোহাগির চোখজোড়ায় ভরকে যাওয়ার মতন স্থির হয়ে আছে। কানের কোণ ঘেঁষে গাল বেয়ে নামতে থাকে ঝরঝরে ঘাম ছুটছে আর বুক ধড়ফড় করছে তার। তাহেরাকে দেখে মনে হয় যেনো সে শিলামাটির মতন শক্ত হয়ে আছে। তার কোনো ভাবাবেগ নেয় সবকিছু মাথা পেতে নিবে এমন দেখা তাকে।

নিরবতা ভেঙে নুরুল গম্ভীর মুখে বলে উঠে," বদরু তোমার মাইয়ার উড়নচণ্ডীতার কারণে গ্রামের সকলেই অসহ্য হইয়া গেছিলো কিন্তু তোমারে আমরা ভালোবাসি দেইখা একটা সুযোগ দিছিলাম কিন্তু তলানির মানুষ কোনোদিন ইজ্জত জিনিস বুঝে না হেইডা তো ভুল্লাই গেছিলাম "

বদরু এমন অনেকবার উপহাসের পাত্র হয়ে এসেছে এইটা তার কাছে নতুন নয় অপমান গিলে খাওয়ার ক্ষমতা তার বেশ আছে।

প্রশান্ত বলে," দেখো বদরু, নুরুল পাওনাদার থেকে তোমায় রেহায়ের জন্যে আমি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু তা তো হতে দিলে না এখন পাওনাদার নুরুলের পাওনা মেটানো ছাড়া কোনো উপায় যে নেই "

গ্রামের অন্যান্য লোকেরাও নুরুলের পক্ষ হয়েই বদরুকে কতো যে কথা শুনালো। গ্রামের যে বদনাম করে এখন যাযাবর হয়েছে বেহায়া মেয়েটা। তাহেরার কান অব্দি পৌঁছেছে কিন্তু মায়ের মন যে অতো বদনাম সইতে পারে না। অঝোরে নীরবে চোখের পানি ফেলা বাদে তাহেরার আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। কোনকালে যে তাহেরা পাপ করেছিলো আজ হয়তো তাকে সেই পাপে ধরেছে। তাহেরার যে গর্ভের কলঙ্ককে জন্ম দিলো। মহিলাদের নানা বাহানা কথা ছেলেকে যাদু করেছে, নইলে অমন কালো মেয়ে এমন সুপুরুষকে জুটিয়েছে কীভাবে? সাধে কি ছেলেকে পাগল করেছে? পাগলের যাদু করেছে।

হঠাৎ সোহাগি বাহির থেকে প্রশান্তের সিদ্ধান্তের কথা শুনে চমকে উঠে। সে জানায়, " এক সপ্তাহের মধ্যে পাওনা টাকা তাদের দিয়ে দিতে নইলে যে ভীটে বাড়ি জায়গা জমি ছেড়ে দেশান্তরী হতে হবে "

অতো টাকা বদরু দেবে কোথা থেকে? প্রশান্ত এমন রায় দিতো না যদি সে পাওনাদার হতো কিন্তু পাওনাদেরর দাবি যে মেনে নিতেই হবে এটাই যে নিয়ম। বদরু ভেঙে পড়ে এমন রায় শুনে। ধীরে ধীরে সমস্ত লোকজন বেড়িয়ে যায়। বদরু পড়ে থাকে উঠানের মাঝে। ওদিকে তাহেরা, সোহাগি নিতাই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে এক কোণায়। এবার বদরু কী করবে?

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। বদরু জায়গা থেকে এক পা সরায় নি। এভাবে সে বসে ছিলো মুখটা শুকনো পাতার মতন দেখায় তার । চোখের পাপড়িগুলো স্তব্ধ আর নিশ্চল পড়ে আছে। হঠাৎ কী ভেবে যেনো বদরু নিজের শরীরের উপড় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে সে বাড়ি বাহিরে পা বাড়ায়। তাহেরা আটকায় না, মানুষটা যেখানে যেতে চায় আজ সেখানেই বরং যাক। অন্তত মানসিক যাতনা থেকে তো রেহাই পাবে।

সোহাগিকে জড়িয়ে নিতাই কাঁদতে থাকে। এতোদিন তো সোহাগি কতজনের দুঃখ গিছিয়ে দিয়েছিলো কতো লোককে সে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছে আজ কেনো তার নিজের মাকে কোনো সান্ত্বনার মায়াজালে আটকাতে পারে না। সোহাগির যে নিজেরই জবান বন্ধ হয়ে গেছে। তার বাতাসি বুবু এতকাল বলে এসেছে সে নাকি স্বার্থপর তাহলে আজ কি তার বাতাসি বুবু তার নিঃস্বার্থ হৃদয়বানের পরিচয় দিয়ে গেছে। একেই কি তবে বাতাসির উদারতা বলে? তাহলে এখন কেনো তাদের এতো কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। তাদের তো সুখের জীবন চলার কথা। সব মিথ্যা বাতাসি বুবু তাকে সব মিথ্যা বলেছে। এই দুনিয়ায় কোনোকিছুই নিঃস্বার্থ নয় সবকিছুতে স্বার্থপরতায় ভর্তি। সোহাগিরও কি কোনো স্বার্থ আছে? না থাকলে কেনো সে এখানে পড়ে পড়ে কষ্ট পাবে?

সন্ধ্যা পাড় হয়ে গেলোও বদরু ফিরে আসে না ঘরে। কেনো আসে না সে? মানুষ টা মনে বড় অভিমান নিয়েছে হয়তো। কখনো তো সে তার মেয়েকে কটু কথা বলে নি সকল আবদার পূরণ করলো সে। আর আজ তার মেয়ের কারণে সমাজে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের স্বীকার হলো। জাতে কলঙ্ক লাগলো। কার কাছে সে অভিযোগ করবে? তাই হয়তো সে ফিরছে না তাহেরার মনেও এমনি ধারনা জেগেছে। সহসা শাওনুল মাঝি দূর থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে সোহাগিদের বাড়ির উঠানে এলো। তাহেরা কৌতূহলী মনে শুধায়, " কী হলো মাঝি? "

শাওনুল হাঁপিয়ে যায়। কিছু সময় ঝুঁকে বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলে," চাচি গো কদমতলায় চলো "

" কেন?"

শাওনুল মাঝি কিছু বলার আগেই চোখে অঝোরে অশ্রু গড়ায়। তাহেরার ভিতরে খিঁচ মেরে উঠে। বুক ধড়ফড় করে উঠে। যেটা তার মনে সংশয় জেগেছে তা যেনো সত্যি না হয়। তাহেরা ছুটে যায় শাওনুলের সাথে কদমতলায়। সোহাগি লক্ষ্য করে তার মাকে পাগলের মতো ছুটে যেতে দেখে। সেও মায়ের পিছু পিছু ছুটে। কদমতলায় এসে দেখে কত মানুষের ভীড়। এতো ভীড়ের মধ্য দিয়ে তাহেরা ঠেলে ভিতরে ঢুকে। বিশাল কদমগাছটির সবচেয়ে মজবুত ডালটিতে দড়ির ফাঁসে ঝুলে আছে বদরুর নিশ্চল দেহ। বদরুর ফ্যাকাসে চেহারা, নীলচে ঠোঁট আর আধখোলা চোখ দেখে তাহেরা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। তার মাথায় যেনো গোটা আসমান ভেঙে পড়েছে। গগনবিহারী আওয়াজ তুলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সে কী হারালো? এর দাম সে কীভাবে মেটাবে? দুনিয়াতে তাহেরাকে নিঃস্ব করে বদরু বিদায় নিলো। এতো অভিমান হলো ছিলো অমন আত্মসম্মানহীন ব্যক্তিটির যে কি না শেষপর্যন্ত তাহেরাকে একা করে চলে গেলো।

সোহাগি যখন এই দৃশ্যটি দেখে সে বাক্যহারা হয়ে পড়ে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। এই দুনিয়ায় তার বাপজান আর নেই এই কথা সে মাথায় আনতেই পারছে না। তবে এটাই কি শেষ পরিণতি ছিলো সোহাগিদের। সোহাগি বোন হারালো এখন বাপকেও হারালো। কেনো তার সঙ্গে এমন হলো? এখন সে কী করবে? এভাবে তার বাপ তাদের সাগরের মাঝখানে রেখে একা চলে গেলো। সোহাগি বদরুর নিস্তেজ দেহের সামনে এসে বদুরুর ঝুলন্ত পা জড়িয়ে কেঁদে উঠে। অসহায়ের বাণীর মতন হয়ে উঠে তার কান্নার শব্দ। এই বিনষ্ট কে ডেকে আনলো তাদের জীবনে?
চারপাশে সবাই তাদের অসহায়ত্বের ক্রন্দন শুনে কিন্তু এগিয়ে আসে না। তারা নাকি সমাজের কলঙ্ক হয়ে গেছে। তাদের থেকে দূরে থাকায় লোকেদের মঙ্গল মনে করছে। সান্ত্বনা পর্যন্ত দিতে কেউ এলো না তাদের কাছে। সোহাগির বুক ফাঁটা কারো কাছে কি মায়া লাগে নি?

তাহেরার দেহে প্রাণ আছে তবুও তাকে নিস্তেজ প্রাণীর মতো দেখায় । তার শরীরে কোনো বল আর বেঁচে নেই। চোখজোড়া পাথরের মতো রূপ নিয়েছে। তাহেরা বড্ড একা হয়ে গেছে যে। মাঝিরা ধরাধরি করে বদরুকে নামায়। গ্রামের সকলেই দেখতে আসে তাদের। বদরুকে দাফন করানো হয় সোহাগিদের ঘরের পিছনে। সোহাগিদের জীবনে অন্ধকার নেমে এলো যে। এই অন্ধকারে কি কখনো আলো আসবে না?

নুরুলের কানে যখন বদরুর মরণের কথা পৌছায় সেও এসে দেখে যায়। দুঃখ প্রকাশ করলেও শেষে তার পাওনা টাকার মাপ করে না। সোহাগি বুঝে উঠে না তাহেরা এই ভাঙা মন নিয়ে কীভাবে টাকা শোধ করবে? সোহাগিদের উপড় কি একটুও মায়া করতে পারে না নুরুল লোকটি? অথচ তারই ছেলেকে মন দিয়ে বসেছে সোহাগি। ছোট সোহাগির কি দুঃখ ভোগে একটুও ছাড় নেই?
গ্রামের কিছু মহিলা আর দৌলতি বাদে কেউ তাদের একবেলা দেখতে আসে নি সবাই শুধু বদরুর নিস্তেজ দেহকে আগ্রহ ভরে দেখেছিলো।

জোসনার মা সোহাগিকে বলে," সোহাগি তোমার মায়ের অবস্থা ভালা না, মানুষ টা যদি আয় রোজগার না করে খাইবা কী তোমরা? একবেলা না হয় আমরা আইনা দিলাম। নিতাইরে কামে দিও কাইল থাইকা "

সোহাগির কথা বলার শক্তি যে আজ আর নেই। সারাদিন তাদের মুখে অন্ন যায় নি যে । সত্যি তো বলেছে জোসনার মা, সোহাগির মা যে একেবারে নেতিয়ে গেলো এবার যে সোহাগিদেরই কিছু করতে হবে। কিন্তু সে কী করবে?

রাত গভীর থেকে গভীর হয় সোহাগিদের চোখে ঘুম নেই। তাহেরা যে এখনো নিস্তেজ হয়ে আছে তার কোনো হেলদোল নেই। সোহাগি বাহিরে অর্ধচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সোহাগির কী হতে কী হয়ে গেলো একদিনে বোন হারালো, বাবা হারালো আর কী কী হারাবে সে? এই ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সোহাগি উপড়ের চন্দ্র ছাড়া কেউ তা দেখে নি।

ভোর হতেই সূর্য যবে উদয় হলো তবে সোহাগির নয়নজোড়া সজাগ হয়। সোহাগি সজাগ হতে খুঁজতে থাকে তার বাবাকে কিন্তু সে কিছুমূহুর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিলো যে গতকাল তার বাবা তাদের থেকে বিদায় নিয়ে গেছে। ঘরে একফোঁটা পানিও ছিলো না কলসিতে তাই সে কলসি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দিঘির পাড়ে।

দিঘিরপাড়ে যখন সোহাগি পৌঁছায়। কলসিভর্তি পানি নিয়ে যবে সে ঘাট ছেড়ে উপড়ে উঠবে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তার সামনে নির্ঝর এসে উপস্থিত হয়। চোখ মেলে তাকাতে সোহাগি প্রায় ভরকেই গিয়েছিলো। নির্ঝরকে দেখে সোহাগির তেমন ভাবাবেগ দেখা যায় নি। স্বাভাবিকভাবেই সে এড়িয়ে আসতে গেলে নির্ঝর ধীর কন্ঠে তাকে শুধায়, " তোমায় আমার কিছু বলার আছে সোহাগিনী "

সোহাগির কানে যখন নির্ঝরের বার্তা টি পৌঁছায় সে অনেকটা চমকে যায়। " সোহাগিনী " এই ডাকটা আচমকা নির্ঝরের মুখ থেকে শুনে সোহাগি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। কখনো তো এই নামে ডাকে নি বিলেতি সাহেব। হঠাৎ এমনভাবে সম্মোধন করলো কেন? বিলেতি সাহেবের কী এমন কথা আছে সোহাগিকে বলার? কিন্তু নির্ঝরের কথা শুনার ইচ্ছে কি আজো সোহাগির আছে। যে ছেলের বাপ কি না সোহাগিদের গ্রামছাড়া করার ব্যবস্থা নিতেছে সে ছেলের জন্যে কিনা সোহাগির মন পুড়বে? সোহাগি কি এতোটাই মায়ায় পড়বে?

নির্ঝর আবার বলে," আমার উপর রেগে থেকো না সোহাগিনী। "
এই কথাটি যখন সোহাগির কান পর্যন্ত যায় তখন তার ধ্যান ভাঙে।
বিলেতি সাহেব কেনো এই কথা বলেছে সোহাগি খুব ভালো করে জানে। সেদিন রাতে বাতাসির গাঁয়ে হলুদে বিলেতি সাহেবকে দেখেছিলো সোহাগি। সেদিন তাকে তো কম আদর যত্ন করেনি তার ঘরের মানুষজন। সোহাগি দেখেছিলো আড়ালে থেকে তাদের খাবারে কিছু মেশাতে তবুও সোহাগি চুপ করেছিলো। সে যদি জানতো ও খাবারটি তাদের এই কাল এনে দিবে তাহলে সেদিনই খাবারখানা ফেলে দিতো। আর না তারা বোন হারাতো না তারা তাদের বাবাকে হারাতো।

সোহাগি মাথা নিচু করে ধীর কন্ঠে বলে," কী কইবেন? "

নির্ঝর বলে, " আমি জানতাম না সোহাগিনী, আমার কর্মের ফল যে তোমার বাবার জীবন নিয়ে নেবে। "

সোহাগি কোনো উত্তর দেয় না। দিতেও পারে না। কী উত্তর দিবে? কথা বলার ন্যূনতম শক্তি তার মাঝে নেই। নির্ঝর যে বড়ই অপরাধী হয়ে গেলো সোহাগির কাছে।সে কি আর কখনো সোহাগির মনের আঙিনায় জায়গা করে নিতে পারবে? নাকি এই স্রোতে তাদেড় ভেসে যেতে হবে?

নির্ঝর মায়া মায়া চাহনিতে সোহাগির দিকে তাকায় সে বুঝে মেয়েটি কত বড় আঘাত পেয়েছে তার জন্যে। সে কি আর কখনো সোহাগির চোখে তার ভালোবাসা দেখতে পাবে না? ওই পুতুলের মত চেহারায় লাজুক হাসি নির্ঝর আর দেখতে পাবে না। নির্ঝরের বুক যে বড্ড শূণ্য শূণ্য লাগছে।

আর কোনো কথা না বলে সোহাগি চুপচাপ দিঘির পাড় ছেড়ে হেঁটে যায়। পিছনে তাকায় না সে। শুধু তার চোখদুটোই ছলছল করছে অশ্রুতে

চলবে...

 #তপনকাব্যধরণঃ  #সামাজিক_গল্প লেখনীতে কায়া পর্ব-২৩পুরোপুরি সূর্য এখনোও উদয় হয়নি।  বাহিরের আধো আধো অন্ধকার ছেয়ে থাকলেও ফজ...
23/09/2025

#তপনকাব্য
ধরণঃ #সামাজিক_গল্প
লেখনীতে কায়া
পর্ব-২৩

পুরোপুরি সূর্য এখনোও উদয় হয়নি। বাহিরের আধো আধো অন্ধকার ছেয়ে থাকলেও ফজরের আযান কিছুক্ষণ আগেই বাতাসি শুনতে পেয়েছিলো। সেই চেনা পরিচিত আযানের ধ্বনি বাতাসির কান পর্যন্ত পোঁছালে সে জেগে উঠে। বাহিরে বিদ্যমান স্থির দাঁড়িয়ে থাকা আধারে আচ্ছাদিত গাছগাছালি থেকে ধীরে ধীরে পাখিদের গুঞ্জন ভেসে আসে বাতাসের সঙ্গে। আশেপাশে সবকিছু নিরব নিস্তেজ হয়ে আছে নিরব থাকে না শুধু বাতাসির তপ্তহৃদয়। বাহিরে কোনো তপ্ত হাওয়া বইছে না অথচ ঘরের ভিতরে আবদ্ধ থাকা বাতাসির হৃদয়ে উত্তাপ ক্রোধের ঝড় বইতে থাকে। বাতাসির মুখে এতোদিনের সমস্ত চঞ্চলতা হারিয়ে গিয়েছে একদিনের ঘটনায়। আহা! মেয়েটার এতোদিনের আশা আজ জমিনে পিষে ফেলেছে গ্রামের প্রভাবশালীরা।

আকাশে ভেসে আসা আযানের ধ্বনির সঙ্গে তার ভিতরেও অপ্রকাশিত সেই আর্তনাদের বাণীগুলো উড়ে যায় খোদার দরবারে। দূরের ওই আকাশের পানে তাকিয়ে বাতাসির মনের ক্ষোভটা হয়তো উপরের খোদার কাছেই প্রকাশ করেছে। তার ঠোঁট দুটো শুধু থরথর করে কেঁপে উঠে আর চোখে অশ্রুতে টগবগ করে।

অসহায়ের মতন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে, " আমার জীবন লইয়া কোনো অভিযোগ নাই গো মাবুদ, আমার সমস্ত অভিযোগ তোমারে লইয়া। এতোদিন হুনছি আত্মহত্যা মহাপাপ কিন্তু আইজ কেন জানি এই পাপটা করতে খুব মনে লইতাছে। এই পাপের লাইগা আমারে তুমি মাফ কইরা দিও গো মাবুদ "

সমস্ত ঘর নিরব ঘরের মানুষজনও নিরব তাদের যেনো আজ ঘুৃম ভালো করে গ্রাস করেছে এইটাই যে বাতাসির চরম সৌভাগ্য অন্তত শান্তিতে সে দুনিয়া ছাড়তে পারবে। কিন্তু বাতাসি কি জানে সে কার কাছে অভিযোগ করেছে? আজো কি তার নিয়তি এইখানে ইতি টানবে? বাতাসি যেমন সমস্ত আশাকে মুছে দিয়ে মরণকে আপন করে নিতে চাইছে তেমনই যে তার ঘরের জানালায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিও তাকে আপন করতে এসেছে। কী মায়া মায়া কন্ঠে বাতাসিকে ডেকে চলেছে।

বাতাসির কানে সেই চেনা পরিচিত ডাকটি স্পর্শ করতেই সে চমকে উঠে। বুকে তার ধুকধুকানি বেড়ে যেতে থাকে। মুহূর্তেই তার তপ্ত হৃদয় অস্থির হয়ে উঠে। জানালার ধারে গিয়ে সে যখন অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তে কাঙ্ক্ষিত পুরুষটিকে দেখে বাতাসির আর সুখের সীমা থাকে না।

" কাজী সাহেব "

কাজল তার ক্লান্ত স্বরে বলে, " আমায় দেখে কাঁদছো যে? অথচ এই কাজল তোমার চোখে কখনো এমন অশ্রু দেখতে চায় নি "

বাতাসি কেঁদে কেঁদে বলে," এতো নিষ্ঠুর কেন আপনে? " ওর হয়তো আরো অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠদ্বয়ে তার মনের শব্দগুলো বের হয় না।

" আজ তোমার বিয়ে অথচ তুমি এখনো বউ সাজলে না। "

" আমি বউ সাজুম না, এই বিয়া আমি যে করতে পারুম না কাজী সাহেব "

" সত্যি তো! আমায় বিয়ে করবে না ? কী হলো বলো, আমার বউ সাজবে না? "

বাতাসি হঠাৎ এই কথা শুনে চমকে যায়। তার হৃদপিণ্ড যেনো এই মুহূর্তে থমকে গেছে। এই মাত্র কাজী সাহেব কী বললো? সে কি ঠিক শুনেছে?

অবাক হয়ে সে বলে, " মানে! "

" এতো মানে বলতে পারবো না তোমায় সূর্য উদয় হলে গ্রাম সজাগ হয়ে যাবে। এরমধ্যে আমাদের ট্রেন ধরতে হবে যে বাতাসি "

বাতাসি কান্না থামিয়ে বলে, " নিয়ে যাবেন আমায় আপনার সঙ্গে?"

" আগে সুন্দর করে বউ সাজো কাজী সাহেবের জন্যে তারপর সঙ্গে নিবো আমি বউ তুলে নিয়ে যেতে এসেছি কোনো কোড়ই গাছের পেত্মীকে তো নয় অন্তত আমার মানটা রাখো "

কাজলের এমন রসিকতায় দুঃখী মেয়েটার মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠে। বাতাসির মনে আবার আশার আলো জেগেছে এবার সে আর কাজী সাহেবকে হারাতে দিবে না। অতি উৎসাহে সে বউ সাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সোহাগির কেনা চন্দন, পাউডার, কাজল, চুড়ি আর শেষে আলতা পড়ে নেয়। মন ভরে বাতাসি আজ সাজে।

এইদিকে কাজলের হাতে থাকা মাতুল দিয়ে ঘরের থালা ভাঙতে শুরু করে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কেউই সে শব্দ শুনতে পায় না কারো কানে দরজা ভাঙার শব্দ পৌঁছায় না।
কাজল মিনমিন করে বলে, " ঠিক কি বেঠিক আল্লাহ আমি জানি না আমি শুধু আমার মনের কথা শুনছি ভুল হলে মাফ করে দিও খোদা এই আমার আর্জি তোমার কাছে "

ইতোমধ্যে বাতাসি লাল টুকটুকে বধু সেজে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। বাতাসিকে বধূ বেশে দেখে কাজলের চোখে মুগ্ধতায় ছেয়ে যায়। বাতাসি অতোটাও সুন্দর নয় কিন্তু কেনো জানি না তার বধু সাজ টা কাজলকে বড্ড আকর্ষণ করেছে হয়তো এটা ভালোবাসার সৌন্দর্য হয়তো বা কাজলের এতোদিনের মায়া। কাজল এই প্রথম বাতাসিকে তৃপ্তি ভরে দেখে। কিন্তু সবটা সময় তো চোখের দেখাতে শেষ করা যাবেনা। সূর্য পুরোপুরি উদয় হওয়ার আগেই গ্রাম ছাড়তে হবে। বাতাসির হাত শক্ত করে ধরে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে ছুটতে থাকে। বধু বেশে বাতাসিকে ছুটে যেতে বেশ ভালো দেখাচ্ছে। খালি পায়ে বাতাসি ছুটে। কাটাকে উপেক্ষা করে কাদামাটিকে উপেক্ষা করে সে কাজলের সাথে তাল মিলিয়ে তিব্র বেগে ছুটতে থাকে। কাজল এই প্রথম তার প্রাণসঙ্গীর হাত ধরে সারা গ্রাম ছুটে।

শেষে তারা শাপলাবিলের ধারে এসে পৌঁছায়। ঘাটের কাছে আজ কোনো নৌকা নেই আছে শুদু একটি নৌকা যে নৌকার মাঝি হলো শাওনুল। সে যে তাদের জন্যেই ভোর থেকে অপেক্ষার পথ গুনছিলো।

কাজল শাওনুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, " শাওনুল মাঝি বেলা শেষ হওয়ার আগেই নৌকা টানো "

বাতাসিকে নিয়ে কাজল নৌকাতে উঠে পড়ে। কত পথ যে তাদের পাড়ি দিতে হবে তারা নিজেরাও জানে না। শাওনুল মাঝি তার নৌকা ছেড়ে দেয় নদীর বুকে যেতে থাকে নৌকা বহুদূরে। নৌকার এক প্রান্তে মাঝি বৈঠা নিয়ে চলেছে আরেক প্রান্তে কাজল সঙ্গে তার সঙ্গীকে নিয়ে পাড়ি দেওয়ায় অপেক্ষায় আছে । বাতাসির ভিতরে এখনো অস্থির হৃদয়ের ধুকপুকানির শব্দ হয়। বাতাসি সত্যি আজ জাত হারিয়েছে জাতের বিনিময়ে পেয়েছে তার মনের মানুষটিকে। সে জানে না কতটুকু সুখ তার কপালে জুটবে তবুও সে শান্তি অনুভব করে সে ব্যাখ্যা বাতাসির কাছে নেই।

বাতাসি কাজলকে জিজ্ঞেস করে, " কই যাইতাছি কাজী সাহেব? "

" জানি না কোথায় আমাদের শেষ পথ কোথায় আমাদের ঠিকানা শুধু জানি আমাদের যেতে হবে "

কিছুক্ষণ পর বাতসি শাওনুল মাঝিকে শুধায়," দৌলতির খবর কী গো মাঝি ভাই "

মাঝি বলে, " আছে সে ভালোই। তবে বোইনডারে এইবার বিয়া দিমু "
কাজল বলে, " সে তুমি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছো শাওনুল "

মাঝির হৃদয় বড় ছটফট করতে থাকে তাদের জন্য। এতোদিনে গ্রামে থাকা মানুষ দুইজন চলে যাবে। ব্যাকুল হয়ে সে বলে, " গেরাম তো তোমরা গেলেগা গেরাম যে বড় খালি খালি লাগবো গো। এই গেরামে বাতাসির লাগান কি আর কেউ আছে? "

কাজল বলে, " আমাদের কিছু করার নেই যে শাওনুল বড় মায়া লাগবে তোমার জন্য "

মাঝি অনেকটা অভিমান স্বরে বলে," দুইজন ভালা মানুষ গেরাম ছাইড়া যাইতাছেগা মায়া কি আমগোর লাগব নো কাজল ভাই?

কাজল আর কিছু বলে শাওনুল মাঝিকে। তার কথা শুনে কাজলেরও খারাপ লাগে কিন্তু বাতাসির জন্যে তার এতটুকু ত্যাগ যে করতেই হবে।

বাতাসি তো জানে না যে তার কাজী সাহেবের শুধু বাতাসি ছাড়া আজ নিজের বলতে কিছুই নেই। ভীটা-বাড়ি, জায়গা-জমি সমস্ত কিছুর বিনিময়ে কাজল শুধু বাতাসিকে বেছে নিয়েছে।

সদরে পৌঁছে কাজল আর বাতাসি শাওনুল মাঝিকে বিদায় জানায়। বিদায় জানানোর আগে বাতাসি শাওনুল মাঝিকে শুধায়," যাইগা গো মাঝি ভাই, আর হয়তো এই গেরামে ফিরতাম না ভালো থাইকো তোমরা"

বাতাসি বারবার শুধু ফিরে চায় সেই নৌকার পানে ততক্ষণ পর্যন্ত দেখে যতক্ষণ পর্যন্ত না নৌকার ছায়া দূরের ওই দিগন্তের সাথে মিলিয়ে যায়। বাতাসির যে বড্ড বুক পুঁড়ছে। কার জন্য পুঁড়ছে, সোহাগির জন্যে? মেয়েটা যে সোহাগিকে বড় ভালোবাসতো ছেলেবেলা থেকে আগলে রেখেছে। কী জানি তার ভাগ্যে কী আছে। সোহাগিযে বড়ই সরল মেয়ে বাতাসিকে ছাড়া কোনোদিন সে একা থাকে নি।

অনেকটা সময় পাড় হয়ে গেলে ট্রেন এসে দাঁড়ায় যাত্রীর জন্যে। সেই ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলো দুই যাযাবরের জীবন। বাতাসি অনেকবার ট্রেনের নাম শুনেছে এমনকি বইয়ের পাতায় ট্রেনের ছবিও দেখেছে কিন্তু এই প্রথম ট্রেন নামক বাহনটি বাতাসি নিজ চোখে দেখে চমকে যায় । খুব কৌতুহল জাগে বাতাসির মনে। ট্রেনে উঠে কাজল একটি নির্দিষ্ট বেঞ্চে বসে আর বাতাসি কাজলের বুকে মাথা রেখে সে গুটিসুটি হয়ে থাকে। তার ভিতরে বড্ড ভয় লাগছে আশেপাশের অচেনা মানুষদের দেখে। কখনো যে সে সোনাগাঁও ছাড়া কোথাও পা বাড়ায় নি, একবার সে ঝাউপাড়া গিয়েছিলো সেটাই তার শেষ যাওয়া ছিলো। আর কখনো গ্রামের বাহিরে কোথাও যাওয়ার নাম পর্যন্ত বাতাসি মুখে নেয় নি।

ট্রেনে থাকা নতুন নতুন মানুষগুলো বাতাসির দিকে বারংবার তাকায়। মনে হয় যেনো এর আগে এমন গেঁয়ো মেয়ে তারা দেখে নি। এমন সাধাসিধা বউ সাজ যেনো তারা আজ প্রথম দেখেছে। বাতাসির ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি লাগে বারংবার সে কাজলের চাহনিতে চোখ রাখে। কাজল বুঝে বাতাসির কেমন অনুভব হচ্ছে তাও নীরবতায় সে মুখ গুজে আছে। খানিকক্ষণ পর ট্রেন ছাড়ার ঘোষণা দিলে বাতাসি আতকে উঠে। তার বুক ধুকপুক করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর ট্রেনকে চলতে দেখে বাতাসি মুহুর্তের মধ্যে ভয় পেলেও পরে তার বেশ ভালো লাগে।

কাজল বাতাসিকে বলে, " গ্রামের জন্য কি তোমার একটুও মায়া হবে না? "

বাতাসি বলে, " হইবো কিন্তু আপনের লগে সব জায়গায় থাকতে পারুম "

কাজল বলে, " আমার কিন্তু থাকার কোনো জায়গা নেই বাতাসি "

বাতসি বলে, " আপনে যেইখানে যেমনে রাখবেন হেইনই এমনে থাকতে পারুম "

বাতাসির কথা শুনে কাজল মনে হয় অনেকটা শান্তি অনুভব করে। জানে না তারা কোথায় শেষ হবে গন্তব্য। ট্রেনের মতোই হয়তো তাদের জীবন অতিবাহিত থাকবে। তবুও জীবনের কখনো কোথাও না কোথাও তাদের পথচলা স্থির হবে। কাজলের শূন্য হৃদয়ের সঙ্গে অবশেষে জড়িয়ে গেল বাতাসির তপ্ত হৃদয়ের আজীবনের মতো মিলনে। " তপনকাব্য" গল্পে আজ তপনছায়ায় তাদের গল্প আপাতত সমাপ্ত হলো। যদি কখনো দরকার হয় তাহলে না হয় অন্য সময় তাদের গল্প আবার বলবো।

চলবে...

Address

Chittagong

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when কায়া-kaya posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share