27/09/2025
#তপনকাব্য
ধরণঃ #সামাজিক_গল্প
লেখনীতে কায়া
পর্ব-২৬
নির্ঝরের এ সমস্ত কথা তার ভয়েস টেপ রেকর্ড এ জমা করে রেখেছিলো। সোহাগি তো চিঠি পড়তে পারে না তাই সে জমা করে রেখেছে এতোদিনের না বলা বার্তাগুলো, যদি পারতো সে কতো শত চিঠি তার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতো।
কিন্তু এই টেপ রেকর্ডটি যে সোহাগির ধারে আজো পৌঁছাতে পারে নি। সেদিনের দিঘিরপাড়ে নির্ঝর এই কারণটির জন্যে গিয়েছিলো কিন্তু সোহাগি তাকে বারংবার উপেক্ষায় করে গেলো। তার কথা একটিবারও শুনার প্রয়োজনবোধ করে নি। সোহাগির ভালোবাসা এতোটা নির্বোধ হলো কবে থেকে? যাকে সে মন দিয়েছে তাকে কীভাবে উপেক্ষা করে থাকতে পারে সোহাগি? আজো কি সোহাগি ভালোবাসেছে তাকে? নাকি সম্পূর্ণটায় সোহাগির আবেগী মনের দোষ? হতেও পারে সেটা।
বিছানার উপড় পড়ে থাকা টেপ রেকর্ডটির দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে আছে নির্ঝর। কবে সে সোহাগিকে শুনাতে পারবে এই টেপে নিবদ্ধ থাকা তার বার্তাগুলি? এই কথায় সে ভেবে যায়। তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে প্রশান্ত হাজির হয়। প্রশান্ত তাকে কিছু বলতেই এসেছে। কিন্তু আজ নির্ঝরের খুব একা থাকতে মন চাইছে ঠিক ছেলেবেলায় যে একাকিত্ব তাকে ঘিরে রাখতো আজ সে নিজেই একাকিত্বের সঙ্গী হতে চাইছে। বাহিরে আজ সম্পূর্ণ চাঁদের রূপ ভেসে উঠেছে। গোলাকার রূপালি থালার মতন চাঁদটির আলো বারান্দাতেও এসেছে। স্নিগ্ধ হাওয়া নির্ঝরের ঘরজুড়ে বইয়ে যাইছে কিন্তু নির্ঝরের ভিতরে থাকা তপ্তহৃদয়ে সে হাওয়া স্পর্শও পর্যন্ত করতে পারছে না।
বিছানায় বসে প্রশান্ত নির্ঝরকে বলে," তাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দাও নির্ঝর সবকিছু যে ভাগ্যে মেলে না "
ভাগ্যের কথা প্রশান্তের মুখে শুনে বড়ই অবাক হয়। প্রশান্ত সেই ছেলে যাকে নির্ঝর দেখে এসেছে বিলাসিতার মালঞ্চ দিয়ে সাজানো তার জীবন। প্রশান্ত তো জানে না নির্ঝরের কাছে ভাগ্য বলতে সে সোহাগিনীকেই বুঝে। এতোটাদিন সে শুধু সবার কথায় ভেবে এসেছে। সবার ভাগ্য গড়তে সে আলোর দিশারী হয়ে রয়েছে। যখন সে নিজের ভাগ্যকে গড়তে গেলো সে চারদিকটা শূণ্য মরূদ্যান বাদে কিছুই দেখতে পেলো না। সৃষ্টিকর্তা কি তার ভাগ্যে এতোটুকু প্রাপ্যতা লিখে রাখে নি।
নির্ঝর বলে, " কাউকে কি মনে স্থান দিয়েছো প্রশান্ত? "
নির্ঝরের কথা শুনে প্রশান্ত বাঁকা একফালি হাসি দিয়ে করে বলে," শুধু মনে নয় নয় নির্ঝর, তার জন্য আমি অন্তরে গোটা একটা জগৎ তৈরি করে রেখেছি। যে জগতে সে ছাড়া আর কারো স্থান নেই "
নির্ঝর বলে," কখনো তো সে কথা আমায় বলো নি তুমি "
প্রশান্ত," আমি বললে কি তুমি সেটা শুনতে? "
নির্ঝর বলে," কখনো কি তোমার কোনো কথা আমি ফেলেছি, প্রশান্ত? তোমার মন রাখার তো অনেক চেষ্টায় করলাম "
প্রশান্ত সেই কথার জবাব সে দেয় না। শুধু তাকিয়ে থাকে বিছানার উপর পড়ে থাকা টেপ রেকর্ডটির উপর। তারপর সে নির্ঝরকে বলে," চলো নির্ঝর, বসার ঘরে চলো।ওখানে সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে "
নির্ঝর বলে," কেনো? "
প্রশান্ত বলে," গেলেই তো দেখতে পাবে কিসের জন্য অপেক্ষা করছে তারা "
প্রশান্তের কথায় কৌতুহলী হয়ে নির্ঝরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিসের বার্তা তাকে শুনতে হবে আবার? নির্ঝর তা জানার জন্যেই পা বাড়ায়। এইদিকে বিছানার উপর পড়ে থাকা টেপ রেকর্ডটি প্রশান্ত তার কাছে রেখে দেয়। তারপর সেও বেড়িয়ে পড়ে নির্ঝরের ঘর থেকে।
বসার ঘরে নির্ঝর দেখে তার বাবা, মুন্তাসির, একজন উকিল, তার বোন ময়না আর সঙ্গে আছে ময়নার ননদিনী। তাদের উদ্দেশ্য কী নির্ঝর বুঝে উঠতে পারে না। প্রশান্ত এতক্ষণে এসে সেই স্থানে উপস্থিত হয়।
একটি দলিলের মত কাগজ বের করে উকিল নির্ঝরকে বলে, " দাও নির্ঝর কাগজে স্বাক্ষরটি করে দাও "
নির্ঝর বলে, " কিসের জন্য করবো কোনো স্কুল তৈরি করবে বুঝি?"
নুরুল বলে," তোমার বিয়ের জন্যে তো তোমার স্বাক্ষর লাগবে "
নির্ঝর কিছুটা অবাক হয়ে হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে," তোমরা কি পাগল হয়ে গেলে? আমায় না জানিয়ে তোমরা আমার ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নাও "
নুরুল বলে, " আমি তোমার বাপজান। তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধীকার আমার আছে "
নির্ঝর তাচ্ছিল্য সুরে বলে, " বাপ হওয়ার যোগ্যতা কি তোমার আছে, নুরুল হাওলাদার "
নুরুল এবার যথেষ্ট রেগে যায়। ছেলে তাকে শুরু থেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে অপমান করে এসেছে। নিজের বাপকে যোগ্য সম্মানটুকু দিতে পারে না। সে আবার উচ্চ শিক্ষিত দাবি করে। নিজের সমস্ত জীবন তাদের মানুষ করতেই ব্যয় করে দিয়েছে। লোকেদের কাছে নিজের বাপকে পাপিষ্ঠ প্রমাণ করে নিজেকে মহৎ সাজিয়েছে। আর কী করলে নির্ঝর সুখে থাকবে। একদফা বাপ-ছেলের মধ্যে দ্বন্দ লেগে যায়। নুরুল তাকে কোনো কথা শুনাতে বাদ রাখে নি। নির্ঝরও চুপ থাকে নি নুরুলের প্রতিটা কথার পাল্টা জবাব সে দিয়ে এসেছে।
একটা মূহুর্তে এসে আর কারো কথা সহ্য করতে পারছে না। নির্ঝর চেঁচিয়ে উঠে। ধীরে ধীরে সে ঘরে থাকা একেকটা জিনিস ছুঁড়ে ফেলে। নির্ঝরের আচরণ দেখে উপস্থিত থাকা সকলেই ভরকে যায়। এর আগে কখনো নির্ঝরকে এমন করতে দেখে নি কেউ। ময়না ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। সে নির্ঝরের এমন অস্থির আচরণের সঙ্গে পরিচিত নয়। ধীরে ধীরে নির্ঝরের চোখে এক অনাকাঙ্ক্ষিত উন্মাদনার ঝিলিক দেখা যায়। চোখজোড়ায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। নির্ঝরের নিশ্বাসে কেমন জানি অস্থিরতার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। একে একে সে ঘরের সমস্ত জিনিস ছুঁড়ে ফেলে। কাঁচের তৈরি জিনিসগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কেউই তার কাছে এগিয়ে আসতে সাহস করছে না। হঠাৎ নির্ঝরের কী হলো? কেন এমন করছে সে?
বাহিরে ওই দূরের আকাশে যেখানে পূর্ণিমা চাঁদের আলোর জ্বলকানিতে পরিবেশ ঘুমিয়ে আছে সেখানে নির্ঝরের হৃদয় আজ উন্মাদের মতন অস্থির রূপ ধারণ করে আছে।
ভোর হওয়ার পরপরই গ্রামে গ্রামে লোকেদের মুখে একটি কথা জপে যায় সকলে। নির্ঝর পাগল হয়ে গেছে। পাগল নির্ঝরকে কেউ শান্ত করতে পারছে না। এমন শান্ত ছেলে কীভাবে পাগল হয়ে গেলো কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। দৌলতি পাগলের মতো ছুটে আসে সোহাগিদের বাড়িতে। উঠানে এসে থামে সে। সোহাগিকে জোরে জোরে ডেকে উঠে। দৌলতির মন অস্থির হয়ে আছে। সে হাঁপিয়ে উঠেছে।
সোহাগি ঘরের ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসলে তড়িঘড়ি করে দৌলতি জানায়, " বিলাতি নির্ঝর নাকি পাগল হয়ে গেছে সোহাগি "
সোহাগি কথাটি শুনে চমকে উঠে বলে," কী কইতাছো তুমি এইগুলা? "
দৌলতি বলে," খালি আমি না সারা গেরামের মানুষ একেই কথা কইতাছে "
দৌলতির মুখ থেকে এমন কথা শুনার জন্যে সোহাগি কোনোমতে প্রস্তুত ছিলো না। এ কি কথা শুনালো দৌলতি? সোহাগির ভেতরখান যে দুমড়ে-মুচড়ে গেলো এই কথাটি শুনে। এক রাতের মধ্যে নির্ঝর পাগল হয়ে গেলো কী করে? সোহাগিই কেনো বারবার কষ্ট পায়? তার ভেতরটা একেবারে শূণ্য হয়ে গেলো। এতোদিন যার জন্যে সে পাগলামি করে এসেছে আজ সে পাগল হয়ে গেলো। পাগলামি তো সোহাগি করেছে, পাগল সোহাগির হওয়ার কথা অথচ নির্ঝর পাগল হলো। এই কেমন নিয়তির প্রতিদান সোহাগি যে বুঝে উঠে না। তার এখন কী করা উচিত?
ঘরে সোহাগির একটা মূহুর্তেও শান্তিতে থাকতে পারছে না। সোহাগির ইচ্ছে করছে এখনি ছুটে যায় নির্ঝরের কাছে। কিন্তু সে কীভাবে যাবে? তাকে যে ঘর থেকেই বের হতে দেয় না তাহেরা। ঘরের এক কোণে নীরবে সে কাঁদতে থাকে। তার জীবনে এতো এতো আফসোস কেনো? সে কেনো নির্ঝরের জন্যে কাঁদবে।
বিড়বিড় করে সে বলে," লোকটা সেদিন কতো আশা লইয়া আইছিলো তার কথাখান কইতে। আমি হুনি নাই একটা কথাও। আমার কিসের এতো অভিমাণ অইলো গো মাবুদ? "
সোহাগি আবার নিজেকে বলে, " আমি কেরে বিলেতি সাহেবের কথাডি হুনলাম না। যদি হুনতাম তাইলে তো এতো আফসোস লাগতো না "
সোহাগি বুঝে উঠে না কীভাবে সে নির্ঝরকে এক পলক দেখতে পারবে।
এইদিকে গ্রাম থেকে গ্রামে সবার মুখে এক কথা নির্ঝর পাগল হয়ে গেছে। তাকে ঘরে আঁটকে রেখেছে বাহিরে থাকা কাঁচারি ঘরে । সে ঘরের সবকিছু তছনছ করে ফেলেছে।কারো কথা সে শুনছে না। কত শত লোক নির্ঝরকে দেখতে গেলো ঠিক ওইদিনের মতন যেদিন নির্ঝর বিলেত থেকে গ্রামে ফিরে এসেছিলো। সবার মনে একটাই আফসোস জন্মালো। যাকে গ্রামের সকলেই নেতা মনে করে এসেছে সেই লোকটা আজ পাগল হয়ে গেছে। এখন তাদের পাশে কে থাকবে? নির্ঝরের মতন তো গ্রামের আর কেউ নেই। এমন ভালো ছেলেটির সঙ্গে কেনো এমন হলো? সকলেই নির্ঝরের জন্য খোদার কাছে মিনতি করতে থাকে।
বেলা শেষ হয়ে সূর্য হেলে পড়লো বিকেল নেমে আসে। গ্রাম এখন খুবই শান্ত। এটাই সুযোগ সোহাগির জন্যে। এই ফাঁকে সোহাগি একবার নির্ঝরকে দেখে আসতে পারবে। সে আশায় সে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে। নির্ঝরকে দেখার জন্যে তার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ছিলো। সে গ্রাম পেড়িয়ে ছুটে যেতে থাকে। কোনো কানে সে থামে না। নির্ঝরদের বাড়ির সামনে এসে তবেই সে একটি বড় নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর সাহস করে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে সবার চোখের আঁড়ালে। তারপর সে কাঁচারিঘরের জানালার সামনে এসে খুঁজতে থাকে নির্ঝকে। নির্ঝরকে দেখে সোহাগি বড় অবাক হয়। এমন সুদর্শন পুরুষটিকে দেখে বুঝার উপায় নেয় যে কিছুদিন আগে এই পুরুষটির জন্যে সোহাগি পাগলামি করতো। সে সত্যিই পাগল হয়ে গেছে।তাকে বেঁধে রেখেছে যে। নির্ঝরকে সে ডাকলে নির্ঝরের কান অব্দি তার কথা পৌঁছায় না।
নির্ঝরের কানে সোহাগির ডাক না পৌঁছালেও নুরুল ঠিকই শুনে ফেলে সোহাগির কন্ঠস্বর। নুরুল সেই দৃশ্যটি দেখে ক্রোধে জ্বলতে থাকে। তার চোখ লাল হয়ে যায়। পেছন থেকে নুরুল সোহাগির চুলের মুঠি ধরে বলে, " তাইলে তোর কারণে আমার সরল পোলা পাগল হয়ছে। তুই সব নষ্টের গোঁড়া। আজকে তোদের আমি গ্রামছাড়া করুম না হয় সব আগুনে পুড়ায় ফেলুম "
সোহাগি চুলের মুঠি সে বেশ শক্ত করে ধরে। যার কারণে সোহাগির বড় কষ্ট হতে থাকে। চুলের ব্যাথায় সে অস্ফুট শব্দ করে উঠে। সে বুঝে যায় আজ তাদের শেষদিন। অঝোরে চোখের পানি পড়তে থাকে তার । না জানি তাদের সঙ্গে কী হয়?
চলবে...