12/05/2025
#বিশ্ব_মা_দিবস_ও_আমার_মা
মা ছোট্ট একটা শব্দ যার গভীরে লুকায়িত আছে হাজারো স্নেহ মায়া মমতা আদর সোহাগ ভালোবাসা ও হৃদয়ের বন্ধন। যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না শুধু অনুভবে উপলব্ধি করা যায়। তাই কথায় আছে,
মা নাই গৃহে যায়, সংসার অরণ্য তার।
দেখিলে মায়ের মুখ, ঘুচে যায় সব দুঃখ।
মা তিনিও একজন মায়ের কন্যা শিশু। বয়সের তারতম্যে যুবতী, নারী তারপর তিনিও হয়ে উঠেন একজন গর্ভজাত সন্তানের গর্বিত মাতৃদেবী। অত্যন্ত ত্যাগময়, দায়িত্বশীল, কঠোর পরিশ্রম, সেবাদানকারী ও ভালোবাসার পরম আশ্রয়স্থল হলো মা। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ও বিপদজনক মুহূর্ত হলো প্রতিটি মায়ের গর্ভকালীন দশমাস দশদিন সময় আর সন্তান জন্মদানের নিদারুন কষ্ট। তারপরও মায়ের আকুল প্রার্থনা, নিজের জীবনের বিনিময়ে যেন সন্তান সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বহুত উন্নতি সাধন করলেও মাতৃ মৃত্যের হার শূন্যের কোটায় এখনো আনতে পারিনি। যে শিশু মাত্র ৭/৮ পাউন্ড ওজন নিয়ে পৃথিবীতে আসে সেই শিশুকে বুকের উষ্ণতায় সেবাযত্নে ধীরে ধীরে পৃথিবীতে আলো বাতাসের সাথে খাপ খাওয়ায়ে চলতে শেখায় একমাত্র মা। মায়ের স্তনপানে সুষম খাদ্যে গ্রহণ করতে শেখে সর্বপ্রথম। তারপর বসা, দাঁড়ানো, আদো আদো কথা বলা, হাঁটা, চলা আয়ত্ব করতে শেখে। কথায় আছে, মাতৃগর্ভ থেকে প্রথম পাঁচ বছর পর্যন্ত মায়ের কাছে সন্তানের হাতে কড়ি, আর জীবনের প্রথম পাঁচ বছরের শিক্ষাকে আজীবন আওয়াতে থাকে, নতুন করে আর কিছু শিখতে হয় না শুধু অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়। যেমন: খাবার গ্রহণ, কথা বলা, হাঁটা, চলা, পোশাক পরিচ্ছেদ, পারিবারিক পরিচয়, আশে পাশের প্রকৃতির সাথে পরিচয়, আত্মীয় স্বজনকে সম্বোধন, সর্বোপরি লেখাপড়ার হাতেকড়ি, নিয়ম শৃঙ্খলা, ধর্মীয় অনুভূতি ও বিনয়ী হওয়ার মহান শিক্ষক মা জননী। মায়ের জীবনের বিনিময়ে এমন নিঃস্বার্থ ত্যাগ, অপ্রেমেয় ভালোবাসা, সেবা আর পরিচর্যা সবটুকু নিমিষে ভুলে যায় যখন সন্তানে মুখ থেকে মায়াভরা আদরমাখা "মা" ডাকটা শুনেন। ইহাতে নারী জীবনের পরম সার্থকতা।
মা -ডাকের মতো সুমধুর শব্দ পৃথিবীর সাহিত্য ভান্ডারে আর নেই বললেই চলে। আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, পৃথিবীর সব ভাষাতে প্রায় একই ভাবে মাকে সম্বোধন করা হয়। যেমন : বাংলায় মা, আরবীতে আম্মু, হিন্দীতে মা বা মাতাজী, ইংরেজীতে মাদার, স্পেনীশে মাম্মা, ইউরোপে মামা, হিব্রুতে উম্ম বা আম্মা -- এমন কাছাকাছি উচ্চারণে বুঝা যায় বিশ্বের সর্বত্র মা আর সন্তানের সম্পর্ক অত্যন্ত মায়াবী আন্তরিক পরম মমতাময়। রক্তের সাথে চিরবন্ধন আজীবন হৃদয়ের আলিঙ্গনে বহমান থাকে। এমন সম্পর্ক প্রতিদিনকার প্রতিমুহূর্তে সজীব ও প্রাণবন্ত। তাই মায়ের জন্য বিশেষ কোন দিনের প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিদিন মা কে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তারপরও প্রতিবছর বিশেষ দিনে অর্থাৎ মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্বে মা দিবস মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। বিশ্ব মা দিবসের ইতিকথা একটু জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, ১৯০৭ সালের ১২ই মে সর্বপ্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে গ্রাফটন শহরে "মাদার্স ডে" বা মা দিবস পালিত হয়। ভার্জিনিয়ার এ্যান নামে একজন নারী অধিকার ও সমাজকর্মী বাস করতেন। তিনি একজন সংগ্রামী ও সচেতন নারী কর্মী হিসাবে নারীদের অধিকার সংরক্ষনে প্রতিষ্ঠা করেন "মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব"। সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব গঠন করেন। নারী সদস্য বাড়ানো ও নারীদের বাক স্বাধীনতাসহ সমাজের নেতৃত্বগুণ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এ্যান একটি কন্যা সন্তানের মা ছিলেন, কন্যার নাম ছিল মারিয়া রিভস জার্ভিস। একদিন এ্যান তাঁর কন্যা সন্তানের সামনে বিনয়ের সাথে করজোড়ে বলেছিলেন, " নারীরা অর্থাৎ মা জাতি প্রতিদিন মানুষের কল্যানে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। আমি বিনীতভাবে প্রার্থনা করি, একদিন কেউ না কেউ, মায়েদের জন্য একটা বিশেষ দিন উৎসর্গ করবে- কারণ এটি হবে মায়েদের অধিকার।" মায়ের এমন প্রার্থনা ছোট্ট আনার হৃদয় কম্পিত হয়। কয়েকবছর পর এ্যানের মৃত্যু হলে, ছোট্ট কন্যা আনা মারিয়া মায়ের মৃত্যুর দিনটি সারা বিশ্বে প্রতিটি মায়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। পরবর্তীতে মায়েদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও ভালোবাসা জানানোর জন্য প্রতি বছর দিনটি বিশ্ব মা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ২৮তম প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে "বিশ্ব মা দিবস" ঘোষনা করেন। সেই থেকে বিশ্বময় মায়ের প্রতি অনন্য ভালোবাসার স্বীকৃতি জানানোর নান্দনিক উৎসব উদযাপিত হয় মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার "আন্তজার্তিক মা দিবস"।
পৃথিবীতে সব সম্পর্কের ইতি টানলেও মা ও সন্তানের সম্পর্ক পবিত্র, শুদ্ধ ও চিরমধুর। মা যেমন সন্তানকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালোবাসেন। নিজে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেন। ঠিক তদ্রূপ সন্তান স্কুল থেকে এসে, বাহির থেকে এসে, কাজ থেকে এসে আগে মাকে খুঁজে। মায়ের আঁচলে যেন সন্তানের পরম আনন্দ, পরম সুখ। মা যেমন করে শাসন করবে করুক পরক্ষনে আবার সব ভুলে মায়ের কাছে যত আবদার। মা শাসন করেন, বকা দেন, মারধর করেন তারপরও ব্যথা পেলে, কষ্ট পেলে, দুঃখ পেলে মনের অজান্তে সন্তান অকপটে বলে উঠে মা....., মা...রে রক্ষা করো শত বিপদআপদ থেকে। তাই কথায় আছে, সন্তানের দুঃখ কষ্ট অন্য কেউ জানার আগে মায়ের মন জানে আগে। মা পৃথিবীতে এমন পরমধন যার আছে সে উপলব্ধি করতে পারে না, যার নাই সে বোবাকান্নায় পার করে আমৃত্যু কাল।
মানব জীবনে যেমন মা সন্তানের অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে থাকে তদ্রূপ প্রকৃতির সমস্ত প্রাণীর মধ্যেও সেইরূপ সম্পর্ক বিরাজমান। ঝড়ের দিনে বৃষ্টির পানি গায়ে না পড়ার জন্য মা পাখির অসুবিধে হলেও ডানা দিয়ে ছোট্ট বাচ্চাকে রক্ষা করে। এভাবে প্রকৃতির সমস্ত প্রাণীর মধ্যে চিরন্তন এক মায়ারবন্ধন রক্তে প্রবাহমান।
তাই মায়ের ত্যাগ, অবদান, দায়িত্ব ও পরিশ্রম অপরিশোধ্য ঋন। যা প্রতিটি ধর্মের শিক্ষা থেকেও আমরা জানতে পারি। ইসলাম ধর্মে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, বৌদ্ধধর্ম ও সনাতন ধর্মে মা-কে স্বয়ং ব্রহ্মা রূপে সেবা করার কথা বলেছেন। খ্রীষ্টান ধর্মে বলা হয়েছে, যারা মায়ের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করবে আমি স্বয়ং ঈশ্বর বলছি, আমি তোমাদের পুরস্কৃত করবো। এভাবে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলে মায়ের অসামান্য অবদানকে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। আজীবন ভরণপোষণ, চিকিৎসা সেবাসহ মায়ের ইচ্ছাপূরণে আপ্রান সন্তানেরা দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন। বিশ্ব মা দিবসে আমেরিকা, ইউরোপসহ সারাবিশ্বে এক বিশাল বাণিজ্য সম্পাদন হয়। মায়েদের উপহার আর ফুলেফুলে আনন্দে উৎসবে দিনটি রঙিন হয়ে উঠে সর্বত্র। মায়ের প্রতি এমন আলিঙ্গন, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান ও স্বীকৃতি প্রতিটি সন্তান পরিবার, সমাজ, সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান থাকুক।
প্রায় ৩২ বছর আমার মা একাকী সংগ্রাম করে আমাদের রক্ষা করেছেন। তিনি একজন সংগ্রামী, মিতব্যয়ী, পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমতী ছিলেন। নিজের যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন, খুব পরিমিত, সাবলীল ও সহজ সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন সততা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে জীবন গঠনের। উপদেশ দিয়েছেন যতটা সম্ভব মানবকল্যানে আত্ম-পরহিতে সেবাধর্মে নিজেদের সম্পৃক্ত করার। মা হারানোর চার মাসে, মা যেন আরো সুগভীরভাবে মম অন্তরে আসীন হয়ে আছে, মা তোমাকে খুব বেশী মনে পড়ে। বিশ্ব মা দিবসে আমার মায়ের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাই।
বিশ্বের সকল মায়ের প্রতি অপার অতল শ্রদ্ধা, প্রণাম ও ভালোবাসা। সন্তানের কাছে প্রতিটি মা আনন্দে বাঁচুক, ভালো থাকুক। মা তেমনই একজন বটবৃক্ষ, যার নিঃস্বার্থ ছায়ায় গর্ভের প্রতিটি ধন হয়ে ওঠে বিদ্ধান, সজ্জন, সামাজিক, আলোকিত ও অতিজাত পুত্রকন্যা।
মা শ্রেষ্ঠ সম্পদ, মা ই শ্রেষ্ঠ।
জয়তু মা, জয়তু বিশ্ব মা দিবস।
ঝর্না বড়ুয়া
প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী
লং বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
তারিখঃ ১২ই মে ২০২৫ ইংরেজী