16/09/2025
অফিস থেকে ফিরে আমি তখন রান্নাঘরে রাতের রান্না করছি। আর কল্যাণ রান্নাঘর লাগোয়া ডাইনিং এ বসে মোবাইলে খুট খুট করছে। এমন সময় শাশুড়িমা এসে ছেলেকে বললেন " হ্যাঁরে বাবু, কদিন ধরেই যে বলছি আমার জিনিসকটা এনে দিতে? তোর বাবার জামাকাপড়গুলোও লণ্ড্রিতে দেওয়া আছে। দুবেলা বাজারের ওপর দিয়ে যাওয়া আসা করছিস, একটু এনে দিতে পারিস না? "
কল্যাণ ফোন থেকে মুখ তুলে বলল " হুঁ? ওহ, তুমি ফর্দ দিয়েছিলে না? হ্যাঁ বাবাও অবশ্য বলছিল একবার লন্ড্রি হয়ে আসতে। আসলে কি বলোতো মা, মাসের শেষদিক তো, একটু টানাটানি চলছে, তাই আরকি! খুব আর্জেন্ট তো কিছু নয়, দিচ্ছি এনে দু চারদিন পর" বলেই আবার মোবাইলে ডুবে গেল।
শাশুড়িমা মুখটা ভার করে বললেন " তা বাবা এত টানাটানি। এদিকে দু দিন অন্তর সিনেমা দেখা, বাইরে খাওয়া, কোনোটাই তো বাকি কিছু নেই? পকেটের যত টানাটানি কি মা - বাবার বেলায় হয়ে যায়? সামান্য একটা কারখানায় ছোট চাকরি তোর বাবার, আমি তোকে কম কষ্ট করে তো মানুষ করিনি? আজ মাস দুয়েক হল লক্ষ্য করছি আমি বা তোর বাবা কিছু আনার কথা বললেই তোর কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব। বিয়ে করেছিস, সংসার বেড়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু মা বাবা হিসাবে তোর ওপর কি আমাদের কোনো দাবী নেই?"
কল্যাণ এই কথাটাতে এবার সিরিয়াস হয়ে নড়েচড়ে বসল। ধীর গলায় মৃদু হেসে বলল, " এই কথাটাই তো তোমাকে আগে পইপই করে বোঝাতে চেয়েছি মা। তুমি কিভাবে রিয়্যাক্ট করেছিলে মনে আছে? বিয়ের আগে-পরে তো দূরের কথা,, জীবনের যে কোনো পরিস্থিতিতে সন্তানের ওপর বাবা মায়ের অধিকার বা বাবা মার প্রতি সন্তানের কর্তব্য কখনও কমে না, বরং বেড়ে যায়। সেটা ছেলে হোক বা মেয়ে...."
শাশুড়িমা গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।
কল্যাণের কথাটা শুনে আমার ঠোঁটের ওপর একটা তৃপ্তির হাসি খেলে গেল। বুঝতে বাকি রইল না কল্যাণ সেদিনের ঘটনার উত্তরটা আসলে হাতে না মেরে ভাতে মারলো।
আমি নিশা। সরকারি চাকরি করি। স্বামী কল্যাণ স্কুল টিচার। দেখাশোনা করে বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত মাস হতে চললো। বিয়ের পর মাস মাইনে পেয়ে অভ্যাস মত মায়ের হাতে সংসারের খরচ, ওষুধপত্র কিনে দিয়ে এসেছিলাম। বাড়িতে বলেই এসেছিলাম। পরের মাসে মাইনে পেয়ে চারটে ছাপা শাড়ি,ব্লাউজ এনে তার থেকে দুটো শাশুড়িমাকে দিলাম, উনি খুব খুশি হলেন। বললেন" আমার মনের মত রং আর ছাপা হয়েছে। ছেলেটা কিসব শাড়ি আনে, আমার একদম পছন্দ হয় না".. তখন আমি খুব আনন্দ পেয়ে ব্যাগ থেকে আরও দুটো শাড়ি বের করে দেখিয়ে বললাম "এগুলো কেমন হয়েছে দেখো তো? "
উনি হাতে নিয়ে বললেন " বাহঃ খুব মিষ্টি রং। নতুন বিয়ে হয়েছে, তোমাকে খুব মানাবে "।
আমি বললাম " না না মা, এগুলো আমার মায়ের জন্য নিয়েছি। এ মাসের মুদিখানা বাজার, ওষুধ দিতে যাব তো, একেবারে দিয়ে আসব। এই রবিবার যাব। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?" হঠাৎ লক্ষ্য করলাম উনি অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন " অ.. ঠিক আছে। না আমার যাওয়া হবেনা গো"।
আমিও আমারই মনের ভুল ভেবে ঘরে চলে গেলাম। আমার নিজের উপার্জন, আমার বাবা মা। তাদের দেখাশোনা করব এটা তো খুব স্বাভাবিক। রিয়্যাক্ট করার প্রশ্নই নেই। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে থমকে গেলাম। শুনলাম মা কল্যাণকে বলছেন " দেখ্ বাবু, ও এখন বাড়ির বৌ। এ বাড়ির প্রতি ওর বেশি নজর দেওয়া উচিৎ। কেন আমাদের কি বিয়ে হয় নি? আমরা শ্বশুর বাড়িতে থেকে, খেয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে সব ধরে দিয়ে এসেছি? আমাদের মা বাবা মেয়ের থেকে কিছু নিতেনও না। এ আবার কেমনধারা শিক্ষা ! বাবা মাই তো বারণ করবে। প্রত্যেকমাসে কাপড় জামা, জিনিসপত্র এমনকি গ্যাস সিলিণ্ডারের টাকাটাও দিয়ে আসতে হয়? বিবাহিত মেয়ের টাকা হাত পেতে নিতে লজ্জা করে না?".... মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল আমার। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু তাতে তুমুল বাগবিতণ্ডা, ঝগড়া অশান্তি,এমনকি কথা বন্ধ হয়ে গেল। বাড়িতে একটা দমবন্ধকর পরিবেশ। তার দুদিন পর হঠাৎ কল্যাণ মা আর আমাকে মুখোমুখি বসিয়ে বলল " বেশ, মায়ের যখন পছন্দ নয়, তখন তুমি ওবাড়ির ভাগের সংসার খরচের পুরো টাকাটাই আমার মায়ের হাতে তুলে দেবে। এতে সব শান্তি বজায় থাকবে "। আমি কিছু বলতে গেলে হাত দিয়ে থামিয়ে বলল " আমি বলছি এতে শান্তি থাকবে, যেটা বলছি শোনো"। দেখলাম শাশুড়িমায়ের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি, মনে শান্তি, মুখে মধু ঝরছে। আমার মাথায় ঢুকলোনা ও কেন এমন করল! অনেক জিজ্ঞাসা করেও আমাকে খুলে কিছু বললনা। এভাবেই কেটে গেছে আরও চারটে মাস। জানিনা বাবা মায়ের কিভাবে চলছে। জিজ্ঞাসা করলেই মা শুধু বলে "আমাদের ঘরে জিনিস উপচে পড়ছে। এত চিন্তা কেন করিস তুই? কল্যাণ খুব ভালো ছেলে, মন দিয়ে সংসার কর।"
একটু পরেই রাতের টেবিলে খাবার দিলাম। খেতে খেতে শ্বশুর মশাই কল্যাণকে বললেন " আজকাল তোমার বড্ড বেশি টানাটানি যাচ্ছে শুনছি। এখনই জমানোর বয়স।উল্টোপাল্টা টাকা বেশি খরচ কোরো না। কোথায় কি করছো বলোতো? যথেষ্ট পরিমাণে মাইনে পেয়েও মাসের শেষে তোমার হাতে টাকা থাকে না? সংসার খরচ তো অর্ধেকের বেশিটা বৌমাই দেয়। তারপরেও এত শর্ট হয় কিভাবে? "
কল্যান অম্লানবদনে বলল " শ্বশুরবাড়িতে দিয়েছি" ! শ্বশুরমশাই হতবাক হয়ে বললেন "মানে?"
আমিও শুনে ততটাই অবাক হয়ে গেলাম ! কি বলছে এই লোকটা?
-- ও আরও বলছে " নিশার যদি বিয়ের পরে এ বাড়ির দায়দায়িত্বটাই বড় হয়, তাহলে একই ফর্মুলায় আমারও তো ওবাড়ির প্রতি দায়-দায়িত্ব আছে। তাই আমি ঠিক করেছি এখন থেকে এ বাড়ীর যাবতীয় দায়িত্ব নিশা পালন করবে, আর ওবাড়ির আমি। তাহলে তো আর তোমাদের অভিযোগের কোন জায়গা থাকবে না?"
শ্বশুরমশাই ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে আহত চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। কিন্তু কথা বললেন শাশুড়ি মা।
উনি কাঁপা কণ্ঠে বললেন " বুঝেছি। আসলে কি বলতো বৌমা, দোষটা আমাদেরই। আমাদের তো নিজের কোন আয় ইনকাম ছিলনা, আমাদের সময় এটাই রেওয়াজ ছিল মেয়ে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে মানে তুমি পরঘর হয়ে গেছো। নমাসে ছমাসে মা বাবাকে চোখের দেখা দেখতে যাবে, যেটুকু হাতে দেওয়ার স্বামী দিলে সেটুকু দেবে, না দিলে দেবে না।বাবা মায়ের কষ্ট দেখে বুক ফেটে গেলেও সেসব মনে নেবে না। এই চিন্তাধারাটা থেকেই আমরা শাশুড়িরা বের হতে পারিনি। তাই এখনকার মেয়েদের বাপের বাড়ি প্রীতি দেখলে আমরা সহ্য করতে পারি না। "
আমি হেসে বললাম " আপনার এই মনে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক মা,কারণ আপনারা ওই ভাবেই অভ্যস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু একটা জিনিস ভাবুন, ছেলের মত মেয়ে কেও তো একজন মা-বাবা একইরকম কষ্ট করে মানুষ করে। ছেলের বাবা মার মত তারাও অথর্ব হয়। ছেলের বাবা মার মত তাদেরও সাপোর্ট দরকার হয়। সাবালক হয়ে সেই মেয়ের কি কর্তব্য নয় বাবা মাকে দেখে রাখা? আপনিও তো কারোর মেয়ে ছিলেন, আপনার কি একবারও মনে হয়নি মা-বাবাকে হাতে করে কিছু তুলে দিতে? আর আমি তো নিজে উপার্জন করি, আমি আমার মা বাবাকে দেখব না? এতে অন্যায়টা কি বলুন না? "
শ্বশুর মশাই এমনিতে খুব মজার মানুষ..ইমোশনাল সিন হয়ে যাচ্ছে দেখে ছেলেকে বললেন " শ্বশুর বাবাকে দেখাশোনা করছো খুব ভালো কথা, সঙ্গে নিজের বাবাটাকেও একটু মনে রেখো।"
কল্যাণ হাত মুঠো করে ওপরে তুলে বলল " সে যাইহোক, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ !"
আমরা সবাই হেসে উঠলাম....
উচিত জবাব
#গৃহবধূ #হাউজওয়াইফ গল্প ও কবিতায় কন্ঠে বর্ষা