28/09/2025
গান হারাম – নাকি আমাদের মনোভাব হারাম?
সমাজে একটি বহুল আলোচিত প্রশ্ন – “গান হারাম কি না?” কেউ কেউ জোর দিয়ে বলে – গান হারাম, বাদ্যযন্ত্র হারাম, শিল্প হারাম! কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, এই আলোচনা অনেক সময় একপেশে এবং অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে।
কুরআনে এমন কোনো আয়াত নেই যেখানে সরাসরি বলা হয়েছে – গান বা বাদ্যযন্ত্র হারাম। তবে কিছু আয়াতে এমন জীবনযাত্রা থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে, যা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ করে বা পাপের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এখানে লক্ষ্য করা দরকার – গান যদি অশ্লীলতায় ভরপুর হয়, যদি মানুষের চরিত্র নষ্ট করে বা অন্যায়কে উৎসাহিত করে – তবে অবশ্যই তা নিন্দনীয় এবং ক্ষতিকর। কিন্তু সব গান কি এমন?
ইতিহাস বলছে, নবীজি ﷺ সাহাবীদের মাঝে এমন সময় ছিল যখন তারা বৈধ আনন্দ, কবিতা, ও গজল পরিবেশন করতেন। হাদিসে এমন ঘটনাও আছে যেখানে নবীজি ﷺ দুই কিশোরীর গান শুনে হাসিমুখে তা গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ, গানের মূল উদ্দেশ্য যদি পবিত্র হয়, মানবিক হয়, আর মানুষের হৃদয়ে শান্তি আনে – তবে তা হারাম হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আমাদের আসল সমস্যা কোথায়?
সমস্যা গানে নয়, সমস্যা আমাদের মানসিকতায়। আমরা ছোট বিষয়ে বড় বিতর্ক করি, কিন্তু বড় গুনাহগুলোকে স্বাভাবিক করে ফেলি। কুরআন-হাদিসে যতবার গানকে নিষিদ্ধ করার মতো আলোচনা এসেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে –
গীবত (পরনিন্দা) – যা খোলা পাপ।
চুগলখুরি – যা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে।
মানুষের হক মেরে খাওয়া – যা অন্যায়ের শামিল।
অহংকার ও প্রতারণা – যা ঈমান ধ্বংস করে দেয়।
সুদ ও ঘুষ - মানুষের আমল নষ্ট করে,
অন্যের প্রতি খারাপ ব্যবহার – যা ইসলামের সৌন্দর্য নষ্ট করে।
আজকের সমাজে এসব অপরাধ এতটাই সাধারণ হয়ে গেছে যে মানুষ বুঝতেই পারে না – এগুলো ভয়ঙ্কর গুনাহ। প্রতিদিন অফিসে, বাজারে, এমনকি পরিবারেও আমরা কারো হক মেরে ফেলি, কারো মানহানি করি, মিথ্যা বলি – অথচ এসব নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই।
কিন্তু যখন কেউ গান গায় বা বাদ্যযন্ত্র বাজায়, তখনই সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠে বলা হয় – “গান হারাম!”
এটা কি ন্যায্য? আমরা নিজে সঠিক না হয়ে অন্যদের বেলায় শিক্ষকতা করি। চুরি ডাকাতির বিষয়ে কাউকে ভালো ভুমিকা রাখতে তেমন চোখে পরে না।
গানের প্রকৃত মূল্য
গান হলো আবেগ প্রকাশের মাধ্যম। এটি হতে পারে –
অনুপ্রেরণার উৎস – মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশাত্মবোধক গান মানুষকে লড়াইয়ের শক্তি দিয়েছে।
ভালোবাসার বার্তা – মানবতা, শান্তি, ও সহমর্মিতার শিক্ষা দিয়েছে।
সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার – অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সুর তুলেছে।
তাহলে, যদি গান মানুষকে ভালো পথে ডাকে, মানবিক করে তোলে, আল্লাহর মহিমা স্মরণ করায় – সেটি কেন হারাম হবে???
একটি শিল্পি ও সংস্কৃতি ধারার মানুষ কোনো অন্যায় কাজ করার আগে দশ বার ভাবে, তুলনা করলে দেখা যায় একটি সাধারণ মানুষের তুলনায় সংস্কৃতি ধারার মানুষের অপরাধ খুবই নঘন্য।
আমাদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার
আমাদের উচিত – ছোটখাটো বিতর্কে না জড়িয়ে বড় গুনাহগুলো থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা।
আসল হারাম গান বা সুরে নয়, আসল হারাম লুকিয়ে থাকে আমাদের আচরণে, কথায়, আর অন্যের প্রতি অন্যায় ব্যবহারে।
যদি গান অশ্লীল হয় – তা বর্জন করবো।
যদি গান মানুষকে সৎ পথে ডাকতে সাহায্য করে – তা গ্রহণ করবো।
আর নিজের জীবন থেকে গীবত, চুগলখুরি, প্রতারণা, অহংকার মুছে ফেলবো।
এভাবেই আমরা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে পারবো, যেখানে গানও থাকবে কল্যাণের হাতিয়ার হিসেবে।
(লেখা সংগ্রহ)