14/05/2023
ঘূর্ণিঝড় মোখার আতঙ্কে কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিতে থাকা দুই লাখ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনসহ সকল সংস্থা একযোগে কাজ করায় স্বস্তিতেও রয়েছেন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত মানুষ। আর আশ্রয়কেন্দ্রে জোরদার করা হয়েছে পুলিশি নিরাপত্তা।
ঘূর্ণিঝড় মোখা প্রবল শক্তি নিয়ে আঘাত হানতে যাচ্ছে কক্সবাজার উপকূলে। মহাবিপদ সংকতের কারণে দিনব্যাপী চলে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার তোড়জোর। জীবন বাঁচাতে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে এসেছেন উপকূলের বাসিন্দারা। একই সঙ্গে আশ্রয় হয়েছে গবাদিপশুরও। আশ্রয়কেন্দ্রে নারী-পুরুষদের রাখা হয়েছে আলাদা কক্ষে। ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানিসহ নানা সুযোগ-সুবিধার। আশ্রিত মানুষরা বলছেন, নিরাপদে রয়েছেন আর সবধরনের সহযোগিতাও পাচ্ছেন তারা।
এদিকে আশ্রিতদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকরা। নানা ধরণের অভিযোগ শুনে দিচ্ছেন তাৎক্ষনিক সমাধানও। আর আশ্রয়কেন্দ্রেগুলোতে জোরদার করা হয়েছে পুলিশি নিরাপত্তা।
অতি প্রবল রূপ ধারণ করে ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার (১৩ মে) রাত ১২টা পর্যন্ত এই দুই লাখ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ।
তিনি জানিয়েছেন, প্রশাসনের পক্ষে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে মোখা মোকাবিলায় তৎপরতা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। যারা সঙ্গে গবাদি পশুসহ অন্যান্য মালামালও নিয়ে এসেছে। শনিবার রাত ৮ টা পর্যন্ত এর সংখ্যা দুই লাখের কাছাকাছি। একই সঙ্গে এখনও মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আসা অব্যাহত রেখেছে। জেলায় ৫৭৬ টি আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়াও অর্ধ শত আবাসিক হোটেল, বহুতল ভবন আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি জানান, ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক, পুলিশ উপকূলীয় এলাকা জুড়ে মাইকিং করে আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজন আনা অব্যাহত রেখেছে।
বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ইতোমধ্যে প্রায় সকল মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যেখানে বর্তমানে চার হাজার ৩০৩ জন মানুষ রয়েছে। দ্বীপের ৩৭ টি আশ্রয় কেন্দ্রে তারা অবস্থান নিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেয়া মানুষকে রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। প্রস্তুত রয়েছে জরুরি মেডিকেল টিম। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানও অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে, মোখার প্রভাবে কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় গুমোট আবহাওয়া বিরাজ করছে। সকাল থেকে থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সাগর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। উপকূলে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট জোয়ারের পানি বেড়েছে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে হালকা বাতাস শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে গুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, দ্বীপের দুটি সাইক্লোন সেন্টার, স্কুল, আবাসিক প্রতিষ্ঠানসহ ২২ টি দ্বিতল ভবন, ১৩ টি সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ভবন মিলে মোট ৩৭ টি আশ্রয় কেন্দ্রে দ্বীপবাসী অবস্থান নিয়েছেন। তার সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।
ঝুঁকিপূর্ণদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিতে উপকূলে পুলিশ
ঘূর্ণিঝড় মোখার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের উপকূলে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে মাঠে নেমেছে পুলিশ। শনিবার (১২ মে) দুপুর ২ টার পর থেকে উপকূলে বসবাসকারী মানুষদের মাইকিং করে দ্রুত আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি কাজ করছে পুলিশ।
পুলিশের পক্ষে বলা হচ্ছে, কক্সবাজারের পুরো উপকূলে প্রশাসনের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে পুলিশ শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবে। দুপুর ৩টার দিকে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনারটেক উপকূলীয় এলাকা প্রচারণা চালাতে যান কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহাফুজুল ইসলাম।
তিনি জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতের মূল কেন্দ্র কক্সবাজার। এখানে প্রাণহানি রোধ, ক্ষয়ক্ষতি কমানো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা প্রশাসনসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে পুলিশ মাঠে রয়েছে। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছে না তাদের বুঝিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। সন্ধ্যার আগেই ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো নিশ্চিত করবে পুলিশ।
কক্সবাজারের ৬৮টি হোটেল মোটেল ও রিসোর্টকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা
ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র কারণে কক্সবাজার উপকূলে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেয়া হয়েছে। উপকূলজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। এই ঝড়ে অনিশ্চিত জীবন থেকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছে কক্সবাজারের হোটেল মালিকরা। কক্সবাজারের কলাতলী রোডে অবস্থিত ‘হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির’ পক্ষ থেকে ৬৮টি হোটেলকে উপকূলের বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন, দুর্যোগকালীন সময় হোটেল মালিকরা এগিয়ে এসেছে। তাদের এই হোটেলে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারবেন উপকূলের বাসিন্দারা।
আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হোটেল মোটেলগুলো হলো: সাফিয়া রিসোর্ট, ডায়মন্ড প্যালেস গেস্ট হাউস, অ্যালবার্ট্রস রিসোর্ট, সী-সান রিসোর্ট, গ্যালাক্সি রিসোর্ট, হোটেল সী পার্ক, মোহাম্মদিয়া গেস্ট হাউস, সী-পয়েন্ট রিসেটি, সী আরাফাত রিসেটি, মাসকট হলিডে রিসোর্ট, আমারি রিসোর্ট, কোয়ালিটি হোম, ওয়েল পার্ক রিসোর্ট, লেমিচ রিসোর্ট, জিয়া গেস্ট ইন, জিয়া গেস্ট হাউস, কক্স ইন, সী ল্যান্ড গেস্ট হাউস, লাইট হাউস ফ্যামেরী রিট্রিট, হক গেস্ট ইন, হানিমুন রিসোর্ট, হোটেল কোস্টাল পিস, শামীম গেস্ট হাউস, সী-কক্স রিসেটি, হোটেল সী আলিফ, বীজ হলিডে গেস্ট হাউস, কক্স হিটলন লি: এ আর গেস্ট হাউস, ব্লু-ওশান গেস্ট হাউস, সিলিকন শাকিরা বে রিসোর্ট, হোটেল এবি গার্ডেন, সোহাগ গেস্ট হাউস, পারসেম ইন সাইট, হোটেল কোরাল রীফ, আলম গেস্ট হাউস, কক্স ভিউ রিসোর্ট, ক্যাসেল বেটাস, হোটেল বে মেরিনা, হোটেল অস্টার ইকো,উর্মি গেস্ট হাউস, ইউনি রিসোর্ট, হোটেল ওশান ভ্যালি, রিসোর্ট বীচ ভিউ, সী-নাইট রিসোর্ট, বে-ভিউ গেস্ট হাউস, হোটেল প্রাইম পার্ক, রিগ্যাল প্যালেস, ডায়নামিক এস এইচ রিসোর্ট, আর এম গেস্ট হাউস, গ্রান্ড বীচ রিসোর্ট, ওলেপিয়া বীচ রিসোর্ট, সী-কিং, গোল্ডেনহীল, স্বপ্নালয় অ্যাপার্টমেন্ট, সী ওয়েলকামসহ আরো কয়েকটি রিসোর্ট।
বন্ধ কক্সবাজার-ঢাকা রুটে বিমান চলাচল
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে কক্সবাজারের আবহাওয়া পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। সাগরে জোয়ারের পানির উচ্চতাও বেড়ে। একই সঙ্গে সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির পাশাপাশি বাতাসের গতিবেগও বাড়ছে। তাই শনিবার সকাল থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দর বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সকাল সাতটা থেকে কক্সবাজার থেকে সব রুটে সব ধরনের উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ আছে। কাল রোববার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এই রুটে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক মো. গোলাম মোর্তজা বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে কক্সবাজার উপকূলে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি করা হয়েছে। রোববার বিকেলের আগে ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজারে আঘাত হানার কথা বলা হচ্ছে। জানমালের নিরাপত্তা ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে শনিবার সকাল সাতটা থেকে কাল রবিবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কক্সবাজার বিমানবন্দরের সেবা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, কক্সবাজার-ঢাকা রুটে প্রতিদিন বাংলাদেশ বিমান, ইউএস–বাংলা, নভোএয়ারসহ চারটি সংস্থার অন্তত ১০টি উড়োজাহাজ চলাচল করছে। দৈনিক অন্তত ৪০টির বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। তা ছাড়া কক্সবাজার উপকূলের হ্যাচারিগুলোয় উৎপাদিত বাগদা চিংড়ির পোনা খুলনায় পরিবহন করা হয় কক্সবাজার বিমানবন্দর দিয়ে একাধিক কার্গো উড়োজাহাজে। নিষেধাজ্ঞার কারণে আজ সকাল থেকে কক্সবাজার-যশোর রুটেও কার্গো উড়োজাহাজের চলাচল বন্ধ আছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ চলাচল রোববার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।