17/08/2024
#‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ ঐতিহাসিক পটভূমি :
—উস্তাদে মুহতারাম Ashraf Ali Nizampuri (হাফি.)
মুহাদ্দিস : দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী..
অরাজনৈতিক সংগঠন ‘হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ এর’ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ এক যুগ অতিক্রম করে আসছে। হেফাজতে ইসলামের জন্ম ২০১০ঈ. সনে চট্টগ্রামে হলেও মূলত দেশব্যাপী হেফাজতের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১২ঈ.থেকে।
দীর্ঘ এক যুগের ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে হেফাজত এক অনিবার্য অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। হেফাজতকে বাদ দিয়ে এই সময়কে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেফাজতের কারণেই অনেক পরিবর্তন এসেছে। যে সময়ের গর্ভে হেফাজতের জন্ম সেখানে চোখ বুলালে দেখা যায় বাঙালি মুসলমানদের লালিত বিশ্বাস, তাহজীব ও তামাদ্দুনের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার মহান দ্বায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হয়েছিলো হেফাজতের অভিযাত্রা। হেফাজতের এই উত্থান অনিবার্য ছিলো, কারণ—ইসলাম হলো এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস। ইসলামই তাদের আদর্শ ও সংস্কৃতি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো—একাত্তরোত্তর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই বাংলাদেশে একদল পশ্চিম ও কলকাতাসক্ত এলিট শ্রেণীর কালপ্রিটরা ইসলাম বিরোধী চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল। যার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইসলাম সর্বদাই এ কালপ্রিটদের ষড়যন্ত্রের যুপকাষ্ঠে বলি হচ্ছিল। সংবিধান, শিক্ষানীতি, পাঠ্যসূচী, শিল্প-সাহিত্য সবখানেই ধর্মকে উপেক্ষা করা হচ্ছিল। ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবে মোকাবেলা করা হচ্ছিল। শাসকগোষ্ঠীর তরফ থেকেও দেশকে ইসলামহীন করার সমস্ত প্রক্রিয়াকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছিল। ফলে কাদিয়ানীরাও গলা উঁচু করে মানুষকে ঈমানহীন করা শুরু করল তাও ইসলামের নাম ভাঙিয়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বেড়ে গেল মিশনারীদের খ্রীষ্টান বানানোর অভিযান, এটাও সেবার নাম বিকিয়ে। মিডিয়া চলে গেল হিন্দুত্ববাদী রাবীন্দ্রিক শক্তির হাতে। আধুনিকতার নামে আমদানী হচ্ছিল নাস্তিক্যবাদ। বস্তুবাদী পশ্চিমাদের নগ্ন সংস্কৃতি দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো দেশের শহর-নগর। এ সময় দেশের মানুষ এমন এক কন্ঠস্বরকে খুঁজে ফিরছিল— যা মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়াবে। তাদের স্বার্থের কথা বলবে। তাদের শঙ্কিত অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করবে। তখন হেফাজতই সেই কণ্ঠস্বরের ভূমিকা নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিল।
•‘হেফাজত’ উচ্চারণ করলেই শাপলার কথা স্মরণ হয়। হেফাজতের অবদানের প্রশ্ন করা হলে শাপলা দিয়েই জবাব দেওয়া হয়। কারণ শাপলার জাগরণই ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছিল শাহবাগকে। শাহবাগ! কী ছিল সে শাহবাগ? শুধু ধর্মাবমাননা ও মোমবাতি জ্বালানো! কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি! না। মূলত শাহবাগ ছিল বিগত চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা প্রচ্ছন্ন ইসলাম বিরোধিতার চূড়ান্ত এক অধ্যায়।
বাংলাদেশে যাঁরা ভারতীয় শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন তাদের পাহাড়-প্রতিম আশঙ্কা, অদম্য রোমান্টিকা, কঠোর ইসলামবিদ্বেষ, চূড়ান্ত মিডিয়াবাজির ওপর ভর করে বাংলাদেশে একটা রাবীন্দ্রিক বামপন্থা ও চরম সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিলো শাহবাগের মাধ্যমে।
শাহবাগের অন্যতম উদ্যোক্তা নাস্তিক ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন ‘দ্য গার্ডিয়ান’কে বলেছিলেন—‘আমরা ধার্মিক মৌলবাদীদের সঙ্গে অনেকদিন ধরেই ব্লগে যুদ্ধ চালিয়ে আসছিলাম। শাহবাগ সফল হয়েছে। কারণ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের নির্মমতার ব্যাপারে আবেগাক্রান্ত।’
আসিফ মহিউদ্দীনের বক্তব্য অনুসারে এমনটা মনে হয়—যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেবল একটি সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল শাহবাগে। মূলত এটি ছিল সেক্যুলার বাংলাদেশ তৈরীর আন্দোলন। ধর্মীয় দলগুলোকে প্রতিহত করার আন্দোলন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় হেফাজত। হেফাজত শাহবাগকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। শাহবাগের বাঙালি মুসলমানকে জাগিয়ে তুলেছিল। সেই জাগরণের বিরুদ্ধে কুচকাওয়াজ হয়েছিল শাপলার চত্বরে। শাহবাগ পেরে উঠেনি। জিতে যায় হেফাজত, জিতে যায় বাংলাদেশ। এই বিজয়ের কারিগর শাপলার জাগরণ। শাপলার রক্ত। তাই সঙ্গত কারণেই বলা হয়ে থাকে শাপলার জাগরণই হেফাজতের সর্বশ্রেষ্ঠ কারনামা ও অবদান। এবং একই কারণে বলা যায়—হেফাজত মানে শাপলা, শাপলাই হেফাজত। তবে এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়—শাপলা শাহবাগকে মিটিয়ে দিলেও শাপলাকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে অভিহিত করা কতটুকু সঙ্গত? রক্তের বন্যা, লাশের স্তূপ, গুম-খুন জেল-যুলুমের যে অন্তহীন ফিরিস্তি এসবকে তো কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। এর উত্তরে আমরা শাপলাকে একটু ব্যাখ্যা করব। যদি শাপলা আন্দোলনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয় তবে এটাকে বিপর্যয় বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি, তাহলে শাপলা শুধু বিজয়ী শক্তি নয়, বরং শাপলার সুদূরপ্রসারী প্রভাব জাতীয় সাংস্কৃতিক জীবনের সর্বত্র যেমনভাবে ছড়িয়ে আছে তেমনই নতুন প্রজন্মকে পথের দিশা দিচ্ছে। তাতে শাপলাকে আরেকটি ফাতহে মুবিনই বলা যায়।
শাপলার আগের সময় ও শাপলাত্তর সময়কে গভীর দৃষ্টিতে বুঝতে চাইলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে—‘ইসলাম যিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ’। কিন্তু দুঃখের কথা হলো—বিষয়গুলো অনেকেই বুঝতে চায় না। ফলে শাপলাকে ভুলে যেতে বসেছে শাপলাপক্ষীয় নতুন প্রজন্ম। তারা শাহবাগকে শুধু গণজাগরণ মঞ্চ হিসেবে চিনে আর শাপলা মানে বুঝে ক্ষয়, রক্তের অপচয়। তারা শাপলার তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় বুঝতে চায় না। শাহবাগের পরাজিত শক্তির কপালে পরাজয়ের যে ক্ষতচিহ্ন এখনো ফুটে আছে তা তারা দেখতে চায় না, চেষ্টা করে না। তারা শুধু জাতে উঠতে চায় আর শিল্প-সাহিত্যের নামে হীনমন্যতার মানচিত্র আঁকে।
মনে রাখতে হবে—শাহবাগই হেফাজতের একমাত্র প্রতিপক্ষ নয়। কেবল শাহবাগের মোকাবেলার জন্যই হেফাজতের জন্ম হয়নি। শাহবাগ আন্দোলনের উত্থানের প্রায় তিন বছর আগেই হেফাজত প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। শাহবাগপূর্ব সময়ে হেফাজতের কার্যক্রম, কর্মসূচি ও কর্মপন্থাকে কোনভাবেই ছোট ও গুরুত্বহীন করে দেখার সুযোগ নেই। হেফাজত তার জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। এটা বাঙালি মুসলমানদের আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রশ্ন ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই। কিন্তু হেফাজত নিয়ে কথা উঠলে শুধুই শাপলাকেন্দ্রিক জাগরণ ও শাপলাউত্তর কর্মকাণ্ডের বয়ানই শোনা যায়। অথচ সামগ্রিকভাবে হেফাজতকে বুঝতে হলে তার উত্থানকাল থেকে তাকে মূল্যায়ন করতে হবে। তাই আমরা এখানে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের হালচাল, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মসূচী ও কর্মপন্থা দেখার চেষ্টা করব। তাহলে বুঝতে পারব হেফাজত কীভাবে ও কোন পথ ধরে এগিয়েছে।
• প্রতিষ্ঠার সাতকাহন:
ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন বড় করে লেখা আছে ২০১০। দেশের আকাশে দেখা দেয় দুঃসময়ের কালো মেঘের ঘনঘটা। সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে ফেলার ষড়যন্ত্র, ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন, বিতর্কিত ও ধর্মবিরোধী নারীনীতি পাশকরণ, এসব বিষয় ক্রমেই পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলছিল। চট্টগ্রামের একদল সচেতন আলেম শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। তারা এ বিষয়ে দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি, ইসলামপ্রিয় মানুষের অবিসংবাদিত অভিভাবক, তৎকালিন হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফীর রহ.র সঙ্গে আলাপ করলেন। তিনিও উৎকণ্ঠিত হলেন। তিনি চট্টগ্রামের সমস্ত মাদরাসার পরিচালক ও শীর্ষ উলামায়ে কিরামকে হাটহাজারী মাদরাসায় আহ্বান করলেন। ২০১০ঈ.র ১৯ জানুয়ারি তাদেরকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভাতেই বাঙালি মুসলমানদের ঈমান-আকিদার সুরক্ষা ও ধর্মীয় অধিকারের সংরক্ষণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় সকল উলামায়ে কেরামের সার্বিক সম্মতিতে একটি সংগঠনের গোড়াপত্তন করা হয়। নাম নির্বাচন করা হয়—“হেফাজতে ইসলাম”। উপস্থিত উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মতিতে আল্লামা আহমদ শফীকে আমির ঘোষণা করা হয়। মুফতি আবদুর রহমান রাহ. হন সিনিয়র নায়েবে আমির। মাওলানা আবদুল হালীম বুখারী রাহ. হন নায়েবে আমির। সুলতান যওক নদভী হাফি. মহাসচিব ও আবদুল মালিক হালিম নির্বাহী মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হন। আলহামদুলিল্লাহ হেফাজতের প্রথম বৈঠকে উপস্থিত থাকার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছে আমার। প্রতিষ্ঠার অব্যবহতি পরেই মাঠে নেমে আসে হেফাজতে ইসলাম। ধর্মহীন শিক্ষানীতি, বিতর্কিত নারীনীতি, সংবিধান থেকে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বাতিলের প্রতিবাদে সমাবেশের ডাক দেয়া হয় চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে হেফাজত থেকে বেশ প্রচারণা চালানো হয়। জনসচেতনতার জন্য বিতর্কিত আইন নিয়ে লিফলেট বিতরণ করা হয়। চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। উলামায়ে কিরাম ও তৌহিদী জনতার এই জাগরণে সরকার ও প্রশাসন ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সমাবেশের দিন ঘনিয়ে আসে। উত্তর চট্টগ্রাম থেকে সমাবেশমুখী গাড়ির বহর এসে জড়ো হতে থাকে হাটহাজারী মাদরাসার সামনে। এদিকে সমাবেশে যোগদান করার ব্যাপারে তখনো কেন্দ্র থেকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রশাসনের মারমুখী অবস্থানের কারণে আল্লামা আহমদ শফী বেশ দোটানায় ভুগছিলেন। ছাত্রদের নিরাপত্তার বিষয়টি তাঁকে পেরেশান করে তুলছিল। এসময় আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা সলিমুল্লাহ এবং আমি আশরাফ আলী নিজামপুরীসহ কয়েকজন উলামায়ে কিরাম হযরতের কক্ষে প্রবেশ করি। আমাদের বক্তব্য ছিল—এখন পিছু হটার সুযোগ নেই। এতে আমাদের দুর্বলতাই প্রমাণিত হবে। ধর্মবিরোধী শক্তি দুঃসাহসী হয়ে উঠবে। তখন চট্টগ্রাম লালদীঘির সমাবেশে যোগদান করার ব্যপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। অতঃপর শুরু হয় সমাবেশ অভিমুখী সম্মিলিত যাত্রা। কাফেলা যখন হাটহাজারী থেকে বালুছড়া নামক স্থানে পৌঁছে, পুলিশবাহিনী বাধা প্রদান করে এবং এক পর্যায়ে গোলাগুলি শুরু করে। হামলা করে আল্লামা আহমদ শফীর গাড়িতে। হযরতের গাড়িতে তৎকালীন নাজিরহাট মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ইদরিস সাহেব রাহ. , আমি (আশরাফ আলী নিজামপুরী), হযরতের খাদেম মাওলানা শফীসহ আরো দু'জন ছাত্র ছিল। হযরত ও আমরা নিরাপদ থাকলেও গুলিবিদ্ধ হয় অনেক ছাত্র। গ্রেফতার করা হয় নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাত্রকে এবং হাটহাজারী মাদরাসার একজন ছাত্র শাহাদাতের অমীয় শরাব পান করে।
‘শহীদ মুহাম্মদ রফীক’। হেফাজতের শহীদী মিছিলের প্রথম অভিযাত্রী ছিলেন শহীদ রফীক। পরবর্তীতে সেই মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছিল। কবি আল মাহমুদের ভাষায়—
“আমরা তো শাহাদাতের জন্যই মায়ের উদর থেকে পৃথিবীতে পা রেখোছি। কেউ পাথরে, কেউ তাবুর ছায়ায়, কেউ মরুভূমির উন্ন বালি, কিংবা সবুজ কোনো ঘাসের দেশে চলছি।”
আল্লামা আহমদ শফীর গাড়ি-বহরে হামলার সংবাদ শুনে ফুঁসে উঠে সমগ্র বাংলাদেশ কারণ বাংলাদেশে এমন কোনো থানা খোঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষার্থী নেই। প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায় সবখানে। ঢাকা, বি-বাড়িয়া, টাঙ্গাইল, নোয়াখালী কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় এই ঘটনার প্রতিবাদ হতে থাকে। মূলত এই ঘটনার মাধ্যমে দেশের মানুষ হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে। চট্টগ্রামের সীমানা পেরিয়ে হেফাজতের আবেদন ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে এর কিছুদিন পরই দেশের পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতি ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজতকে আঞ্চলিক সংগঠন থেকে সর্বজনীন ও জাতীয় সংগঠন হিসেবে রূপদানের প্রয়োজন দেখা দেয়। ২০১২ সালের জুন মাসে উলামা মাশায়েখ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় দেশের সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদরাসায়। এই সম্মেলনে নতুন করে ঘোষণা করা হয় হেফাজতে ইসলামের দেশব্যাপী পূর্ণাঙ্গ কমিটি।
• শাহবাগের উত্থান:
২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী জামায়াত নেতা মরহুম কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ সময় ‘ইমরান এইচ সরকার’ নামক একজন নাস্তিকের নেতৃত্বে একদল ব্লগার এক্টিভিস্ট তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে মৃত্যুদন্ডের দাবিতে শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনে নামে। রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও মিডিয়ার পূর্ণ সহযোগিতায় অল্প দিনেই জমে উঠে শাহবাগ আন্দোলন। সরকারের নিকট পেশ করা হয় ছয়দফা দাবি। বলা হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধপরাধীদের বিচারের মুখোশ লাগিয়ে মূলত শাহবাগ ছিল ধর্মবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু অল্পদিনেই তাদের এই মুখোশ খসে পড়ে। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবমাননা, ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদগার, ধর্মীয় প্রতিকসমূহ নিয়ে ব্যঙ্গ ও হাস্যরস করা শাহবাগের নিয়মিত কর্মসূচী হিসেবে পরিণত হয়। এসময় আবার জেগে উঠে হেফাজতে ইসলাম। প্রতিবাদ করেন আল্লামা আহমদ শফী। কিন্তু শাহবাগীরা থামছেই না। অতঃপর ১৫ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারীতে আল্লামা আহমদ শফীর সভাপতিত্বে
একটি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কয়েকদিন পরেই সেই চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠির শিরোনাম ছিল ‘শাহবাগের ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে জেগে উঠুন’। এই চিঠিতে শাহবাগে রাসুল স.এর অবমাননা, ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ, কৌতুক ও কটুক্তির কথা উল্লেখ করা হয় এবং সরকারকে এসব বন্ধের দাবি জানানো
হয়। সবশেষে দেশের তৌহিদী জনতাকে ঈমান-আকীদা ও ইসলামের প্রতিকসমূহের হেফাজতের পক্ষে সচেতন ও সোচ্চার হবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানানো হয় এবং আল্লামা আহমদ শফির রহ.এর পক্ষ থেকে বলা হয়—দেশের প্রতিটি প্রান্তে নাস্তিক-মুরতাদদের বিরুদ্ধে দুর্বার ও ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তুলুন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রথম পাতার অর্ধেকজুড়ে ছাপানো হয় এই খোলা চিঠি। দেশের প্রতিটি প্রান্তে, মাদরাসা, মসজিদে পৌঁছে যায় আল্লামা আহমদ শফীর সেই জাগরণী আহ্বান। সবাই সঙ্কিত হয়ে উঠে। এরপর ৯ই মার্চ উলামা-মাশায়েখ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশের আলেমসমাজের অংশগ্রহণে ঐতিহাসিক এক সম্মেলনে পারিণত হয় এই আয়োজন। এখানেই তেরো দফা দাবি উত্থাপিত হয় এবং সরকারের কাছে তেরো দফা দাবি জানানো হয়। এই সম্মেলনে হেফাজতের পরবর্তী কর্মসূচীসমূহ ঘোষিত হয়—
* ১২ মার্চ প্রতিটি উপজেলায় মানব বন্ধন।
* ১৫ মার্চ বাদে জুমা বিক্ষোভ মিছিল।
* ২২ মার্চ সব মসজিদে ১ ঘন্টা অবস্থান।
* ২৫ মার্চ উপজেলা পরিষদ ঘেরাও।
* সবশেষ ৬ই এপ্রিল ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ।
তেরো দফার প্রকাশের কিছুদিন পরেই বিভিন্ন মহল থেকে ১৩ দফার তীব্র সমালোচনা ও অপব্যাখ্যা করা হয়। এই দাবিগুলোকে মধ্যযুগীয় বলে অভিহিত করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজত ১৩ দফার ব্যাখ্যা প্রকাশ করে।
• তেরো দফা ও সাধারণ পরিসংখ্যান
"মূলত ১৩ দফার মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট। হেফাজত দেশের ধর্মীয় মহলের অভিভাবক হিশেবে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি আন্দোলন শুরু করার পর অনেকে গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১৩ দফার চারটিতেই নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট দাবি জানানো হয়েছে। প্রায় ১৫ শতাংশ দাবি ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে ইসলামের প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট। এই ১৫ শতাংশ-ই মূলত হেফাজতের আন্দোলনের মূল ফোকাস। ২৩ শতাংশকে সাংস্কৃতিক ও সহযোগী দাবি হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। এতে যদি সরাসারি নিরাপত্তা, ইসলামবিদ্বেষ ও মুসলিম রাষ্ট্রের বিষয়টি হাজির নাই, তবে ২৩ শতাংশ সাংস্কৃতিক দাবির সঙ্গে ইসলামবিদ্বেষ ও মুসলিম রাষ্ট্রের দাবির বিশেষ সম্পর্ক আছে। পাশাপাশি মূলত সাংস্কৃতিক বিদ্বেষ থেকেই নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই ২৩ শতাংশকে বিচ্ছিন্ন ভাবলে হবে না। বাকি ত্রিশ শতাংশ মুসলিম রাষ্ট্র-সংশ্লিষ্ট দাবি। এগুলো আলেমদের সর্বকালীন দাবি। ইসলামি আইন বাস্তবায়ন করতে হবে বা অন্তত ইসলামবিরোধী আইন পাশ করা যাবে না, যার অংশ হিশেবে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা ও খ্রিস্টান মিশনারীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি নারী ও শিক্ষানীতির ধর্মবিরোধী ধারা বাতিলের আহ্বান জানানো”
•২০১৩ সালের মার্চ মাসের ঘোষিত সমস্ত কর্মসূচী সফলভাবে পালন করা হয়। আন্দোলনের সমস্ত সিড়ি অতিক্রম করে হেফাজত পৌঁছে যায় ঢাকার দোরগোড়ায়। শাহবাগীদের হরতাল, সরকারের হুমকি ও আস্ফালন সবকিছু উপেক্ষা করে ঢাকায় ঘটে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ গণজাগরণ। সারাবিশ্ব এই দিন নতুন করে জানতে পারে—এ মাটি ইসলামের ও মুসলমানদের। তিতুমীর ও শরীয়তুল্লাহর সন্তানরা আজও বেঁচে আছে। এর পরের ঘটনা সবারই জানা আমরা শুধু হেফাজতের সূচনা থেকে শাপলা পর্যন্ত যে ঘটনা-প্রস্থ তা দেখাতে চেয়েছি। এতে দেখা যায় কীভাবে একটি মহাজাগরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। কর্মসূচীগুলোর দিকে যদি খেয়াল করা হয়, তাহলে বুঝা যাবে শাপলা পূর্ববতী হেফাজতের সাংগঠনিক কৌশল কেমন ছিল। এতে শাপলা উত্তর হেফাজতের বিপর্যয়ের কারণও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
হেফাজতের দ্বায়িত্ব দিনদিন বাড়ছে। কারণ পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। হেফাজত কি এই ভার বইতে পারবে! বাস্তবতা হলো—শাপলার পরে হেফাজত আর সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। শাপলার সেই জাগ্রত হেফাজত ঝিমিয়ে পড়েছে পরবর্তীতে। ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় চাপ ও ভয়াবহ নেতৃত্বশূন্যতা হেফাজতকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো হেফাজত কি টিকে থাকতে পারবে? তার উত্তরে বলা যেতে পারে— বাংলাদেশে যতদিন মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকবে হেফাজত প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে। হেফাজতের প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে না। কিন্তু যে পন্থায় হেফাজত এগুচ্ছে, এভাবে ইস্যুকেন্দ্রিক আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি কতদিন টিকে থাকবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সময়ের দাবি ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে হেফাজত তার কর্মপন্থায় পরিবর্তন আনলে এবং ওত পেতে থাকা দাদাল মুক্ত করতে পারলে একটা মাইলফলক হবে বলে আমার বিশ্বাস। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাওয়াহ ভিত্তিক সামাজিক আন্দোলনে মনোনিবেশ করাই হেফাজতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং তা বাংলার মুসলমানদের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বাকী আল্লাহই ভালো জানেন।
• সবিনয় অনুরোধ
‘হেফাজত’ নিয়ে বাজে মন্তব্য ও ট্রল করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন। সবসময় আমাদের মাথায় থাকা দরকার—‘হেফাজত’ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। হেফাজতের ব্যানারে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে হেফাজতের চেইন অফ কমান্ডে যারা থাকবেন তারা অরাজনৈতিক হলে আর কারো প্রশ্ন থাকবে না। এটিই শেষ কথা। হেফাজত এ দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য যা করেছে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে শত সহস্র বছর। হেফাজতের আবির্ভাব যদি না হতো তাহলে এদেশের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো—তা সমাজচিন্তক ও বিজ্ঞমহলই ভালোভাবে অনুধাবন করবেন।
যারা হেফাজত নিয়ে তামাশা করেছিল তারা তাদের পাওনা বুঝে পেয়েছে। পাচ্ছে। বুঝে পাবে, ইনশাআল্লাহ! কারণ—হেফাজত নামক বৃক্ষের গোড়ায় পানি নয়; ঈমানদারের তাজা রক্ত ঢালা হয়েছে। ঈমানদারের রক্তের সাথে যারা বেইমানি করেছিল তারা তাদের পাওনা পুঙ্খানু পুঙ্খানুভাবে পেয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
চল্লিশ বছর পর এদেশের মাটিতে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারলে, শাপলায় শহীদদের তাজা খুন বৃথা যাবে—তা ভাবলেন কি করে? হেফাজত যদি আর কোনো কর্মসূচি না-ও দেয়, তা-ও হেফাজত সার্থক ও সফল। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর হাসিনা-খালেদার নাম মুছে যাবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে লেখা থাকবে—শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী ও সিপাহসালার আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর নাম।
যারা বলছেন— হেফাজতের জানাযা হয়ে গেছে, কবর রচিত হয়েছে—আচ্ছা, বলুন তো হেফাজত কি কোনো জন্তুর নাম? যার কবর রচিত হবে! হেফাজত এদেশের চৌদ্দ কোটি তাওহীদী জনতার কনসেপ্টের নাম। তাওহীদী জনতার অন্তরের অন্তঃস্থলে হেফাজত স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। হেফাজত ছিল, আছে, থাকবে, ইনশাআল্লাহ।