06/09/2025
আপনার জন্ম হয়েছিল মক্কার অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারে। পিতাকে হারিয়েছিলেন জন্মের পূর্বে। বনু সাদের নারীরা শুধু এতিম বলেই আপনাকে গ্রহণ করেনি। তারা জানত না, আপনি এতিম কিন্তু অভিভাবকহীন নন। দুগ্ধপোষ্য শিশু না পাওয়ার লজ্জা এড়াতেই আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে আপনাকে গ্রহণ করেন হালিমা সাদিয়া। মুহূর্তের মাঝে মহান রবের রহমত ছেয়ে গেল তাদের মাঝে। দুর্বল পশুটিও হয়ে উঠল মোটাতাজা। বনু সাদেই কাটল আপনার জীবনের প্রথম কয়েক বছর।
আপনি ফিরে এলেন মক্কায়। মায়ের কোলে। আপনার মা ইচ্ছে করলেন মদিনায় যাওয়ার। সেখানে আপনার পিতার সমাধি। নানাবাড়ি। ছোট্ট আপনি তখনো জানতেন না, আপনার মায়ের সাথে এটিই আপনার শেষ সফর। সফর থেকে ফেরার পথে আপনি হারালেন আপনার মাকে। উম্মে আয়মান ছাড়া আর তো কেউ ছিল না আপনাকে কোলে তুলে নেওয়ার।
নবীজি, সেদিন আপনার কেমন লেগেছিলো!
হিযরতেরও বহুদিন পর। আপনি সে পথ ধরেই যাচ্ছিলেন। কাফেলা নিয়ে। একটা সময়ে থেমে গেলেন। একটা কবরের পাশে গিয়ে অঝোরে কাঁদলেন। সুখ অথবা দুঃখের সময়গুলোতে মায়ের কথা আপনার অনেক বেশি মনে হতো!
মক্কায় ফিরে এসে আপনি পালিত হতে থাকলেন দাদার তত্ত্বাবধানে। একদিন দাদাকেও হারালেন। দাফন করার কাফেলার পেছনে সেদিন আপনি কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সেই ত্যাগ আর শোকের কত পরিস্থিতির মুখোমুখিই না আপনাকে হতে হয়েছিল।
আপনি বড় হতে লাগলেন। সমাজে ভিন্নরকম এক ব্যক্তিত্ব নিয়ে। পরম সত্যবাদী। আমানতদার। বিশ্বস্ত। একটা সময় মহান আল্লাহ আপনাকে বিশেষ এক নিয়ামত দান করলেন। খাদিজা। রাযিআল্লাহু আনহা। পরম সংকটে আপনার সাহস, আস্থা আর ভালোবাসার জায়গা।
নবুওয়ত লাভের পর আপনি যখন চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি তখন আপনাকে সাহস জুগিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আল্লাহ আপনাকে লজ্জিত করবেন না। আপনি তো সব সময় সত্য বলেন। অন্যের ঋণ পরিশোধ করেন। অসহায়দের খোঁজ রাখেন। অতিথিদের আপ্যায়ন করেন। তার বিদায়ের পরেও আপনি তাকে ভুলতে পারেননি। প্রতিটি সুখের মুহূর্তে আপনি তাকে স্মরণ করতেন। তিনি ছিলেন আপনার সেই সময়ের সঙ্গী, যখন পুরো সমাজের বিপরীতে আপনি একা লড়েছিলেন।
মক্কার পরিবেশ প্রচণ্ড বৈরী হয়ে গেলো। আপনার গোত্রের নিকট আপনাকে চাইল কাফিররা। আপনার গোত্র অসম্মতি দেওয়ায় আপনাদের বয়কট করা হলো। আশ্রয় নিলেন শিআবে আবু তালিবে। তিন বছর এভাবে চলল। খাদ্য-পানি সবকিছুর মাধ্যমে তারা আপনাদের অত্যাচার করেছিল। একসময় অবৈধ এই অঙ্গীকারের অবসান হয়। মুক্ত পৃথিবীতে আপনি বিচরণ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মাথাতেই আপনি হারালেন আপনারা চাচাকে। মক্কার মারাত্মক প্রতিকূল পরিবেশে সেই তো আপনাকে আগলে রেখেছিল। আপনি শোকে মুহ্যমান। এর মাঝেই আপনাকে বিদায় জানালেন খাদিজা। রাযিআল্লাহু আনহা।
ইসলাম প্রচারে আপনি ছুটলেন তায়েফে। সাথে যায়েদ বিন হারেছা। হতভাগারা আপনাকে সেদিন রক্তাক্ত করেছিল। রক্তে আপনার শরীরের সাথে পায়ের জুতা আটকে গিয়েছিল।
নবিজী! কতটা অসহায়ত্ব থেকেই না আপনি আপনার রবকে বলেছিলেন “… হে আমার রব, আপনি আমাকে কার হাতে ছেড়ে দিলেন! …”
মক্কায় যখন কাফিররা বলে বেড়াচ্ছিল আপনার রব আপনাকে ত্যাগ করেছেন। আপনার রব তখন আপনার প্রতি সূরা দোহা অবতীর্ণ করলেন। জানালেন, “আপনাকে এত নিয়ামত দেওয়া হবে, যে আপনি খুশি হয়ে যাবেন।" সেই মুহূর্তে আপনি বলে উঠলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার একজন উম্মত জাহান্নামে থাকবে, আপনি ততক্ষণ খুশি হবেন না। যেই উম্মতের কারও আগমন আপনার বিদায়ের শ বছর বা হাজার বছর পরে, সেই উম্মতের প্রতিটি মানুষের জন্যে আপনার হৃদয় ব্যাকুল । দীর্ঘ সিজদায় এই উম্মতের মাগফিরাতের জন্যে ক্রন্দন। হাশরের মাঠের পরম কঠিন মুহূর্তে, যখন কেউ কাউকে চিনবে না। সকলেই বলতে থাকবে “নাফসী, নাফসী”। শুধু আপনিই হবেন ব্যতিক্রম। বলবেন “উম্মাতী, উম্মাতী”।
শত শত বছর পর, আজও যখন শিশু-কিশোররা আপনার সীরাত অধ্যয়ন করে, মায়ের মুখে আপনার গল্প শোনে, ভিন্নরকম এক না পাওয়া কাজ করে তাদের মাঝে। তারাও যদি হতে পারত, হাসান-হুসাইন, যায়েদ, উসামা অথবা আনাস। রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহুম। তারাও আপনার আদর পেত। ভালোবাসা পেত। আপনার সাথে খেলা করত। আপনার কপালে চুমু খেত।
আপনাকে ভালোবেসেছিল আবু তালহা। রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু। উহুদ যুদ্ধে নিজের শরীরকে ঢাল হিসেবে পেতে দিয়েছিল কাফিরদের আক্রমণের সামনে। যুদ্ধ শেষে কাফেলা যখন ফিরছিল। এক নারী মদীনার অলিগলিতে ছুটছিল। জানতে চাচ্ছিলেন আপনার সংবাদ। আপনার কিছু হয়নি তো ! একসময় তিনি জানলেন তার স্বামী শহীদ হয়েছেন, জিজ্ঞাসা করলেন আপনার কিছু হয়নি তো! একে একে জানলে শহীদ হয়েছে তার ভাই, তার সন্তান। তখনো তার ব্যাকুল হৃদয়ে আপনার সংবাদ জানাটাই মুখ্য। একসময় জানলেন আপনি বেঁচে আছেন। বলে উঠলেন, তিনি সব শোক ভুলে গিয়েছেন। স্বামী, সন্তান, ভাই…
চৌদ্দ শ বছর পর। কোটি কোটি হৃদয়ে আপনার অবস্থান। আপনাকেই ভালোবাসি হে আমার নবীজি। সেই ভালোবাসা অতি তুচ্ছ, আল-বাহতা উপত্যকায় নির্যাতিত সুমাইয়া রাযিআল্লাহু আনহার ভালোবাসার নিকট। উহুদের ময়দানের আবু তালহা, হামযা ও হানযালার ভালোবাসার নিকট। রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহুম। এই ভালোবাসা তুচ্ছ আবু বকর রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহুর ভালোবাসার সামনে। বিদায় হজের ভাষণে সবাই যখন উদ্দীপ্ত, দ্বীন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আনন্দে। একা ক্রন্দনরত আবু বকরই বুঝেছিলেন আপনার বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে।
এ ভালোবাসা অস্তিত্বহীন আপনার প্রতি সাহাবীদের ভালোবাসার হাজার ভাগের এক ভাগের সামনে… তবুও গ্রহণ করে নিন আমাদের ভালোবাসাকে। আপনি তো আমাদেরই ভালোবেসেছিলেন, নবীজি….
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ
(সীরাতে ইবনে হিশাম ও সীরাতে মুস্তফার আলোকে লিখিত)