19/08/2025
স্বপ্ন এবং হ্যালুসিনেশন
বিষয়টা এখানে অপ্রসঙ্গিক হলেও অনেক সদস্যই এই সকল বিষয়ে ভোগছেন এবং শাস্ত্রপৃষ্ঠায় পোষ্ট দিচ্ছেন। কারো বাবা মারা যাওয়ার পর বা আত্মীয়-স্বজন মারা যাওয়ার কিছুদিন পর গভীর রাতে রুমে দেখেন। মনেহয় যেন আপনাকে ডাকছে। কিংবা আপনার সাথে কথাও বলেছে। কিন্তু তার অস্তিত্ব স্পষ্ট নয়। আবার অনেকে ভোর বেলা স্বপ্ন দেখছেন। সেটা কি সত্যি হবে কিনা জিজ্ঞাস করেন। আসলে স্বপ্ন মানুষ কেন দেখে? কিংবা মৃত মানুষ কাছে আসার কারণ কি হতে পারে? এসব বিষয়েই দু-চার লাইন লিখছি...
স্বপ্ন আসলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা জরুরী।
স্বপ্ন তেমন কিছুই নয়। স্বপ্ন, অবচেতন মনের প্রযোজনায় ‘বর্তমান, ‘নিকট অতীত’ ও ‘দূর অতীতে’ ঘটে যাওয়া ঘটনা ও তার অভিজ্ঞতার আলোকে নির্মিত একটি ‘ছোট নাটিকা’ বা ‘সেগমেন্ট’ বলা চলে।
স্বপ্নের কিছু চাঞ্চল্যকর বৈশিষ্ট্য আছে। আমরা বেশিরভাগ স্বপ্ন দেখি রেপিড আই মুভমেন্ট (REM- SLEEP) স্লিপ পর্বে। রেপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ কী?
আমাদের ঘুমের দুটি স্তর। ‘চক্ষু আন্দোলন’ পর্ব (রেপিড আই মুভমেন্ট -REM) এবং চক্ষু স্থীর পর্ব (NON REM)। ঘুমের মধ্যে আমাদের চোখ দুটো কখনো আন্দোলিত বা কাঁপতে থাকে আবার কখনো স্থির থাকে। তাই ঘুমের এমন নাম। বেশিরভাগ স্বপ্ন আমরা দেখি চক্ষু আন্দোলন পর্ব ঘুমের সময়। আর ঘুম থেকে জেগে উঠার অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সিংহভাগ স্বপ্নই ভুলে যাই। কী স্বপ্ন দেখলাম হুবহু মনে করতে পারি না, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। স্বপ্নের মধ্যে ব্রেইন নতুন করে কারো কোন ইমেজ অবয়ব বা চেহারা তৈরি করতে পারে না। সে ক্ষমতা ব্রেইনের নেই। অতীতে দেখা চেহারা অবয়বেই প্রিয়জনকে দেখি। অনেক আগে যারা মা,বাবাকে হারিয়েছেন তারা তাদের মা বাবা কে ঠিক সেই অবয়বেই দেখেন, যখন তারা মারা গিয়েছিলেন।
অন্ধ মানুষ স্বপ্ন দেখেন?
হ্যাঁ, অন্ধ মানুষও স্বপ্ন দেখেন। তবে তাদের সে স্বপ্নে কারো চেহারা বা ছবি থাকে না। তারা জগৎকে যেভাবে কল্পনা করেন সেভাবেই তারা স্বপ্ন দেখেন। আর যারা জন্মের অনেক পর দৃষ্টিশক্তি হারান তাদের স্বপ্নগুলোও আমাদের মতনই।
কাদের আমরা স্বপ্নে দেখি?
স্বপ্নে আমরা পরিচিত মানুষগুলোকেই দেখি, দেখি পরিচিত চেহারায়। দৈবাৎ কেউ স্বপ্নে যদি দেখেন পাশে শুয়ে থাকা ‘স্বামী বা স্ত্রী’ থুরথুরে বুড়ো হয়ে গেছেন, আপনার সঙ্গে ঝগড়া করছেন, আসলে সেটা ব্রেইনের একটা ছোট ভুল। সে মেমোরি সেন্টার থেকে দৃশ্যগুলো/ অবয়বগুলো এনে জোড়া দিতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় একজনের অবয়বের মধ্যে আরেকজনের অবয়ব লেপ্টে দিয়েছে বে-খেয়ালে। আবার এও হতে পারে বয়স্ক অবয়ব হিসেবে ব্রেইন যাকে প্রিয়জন বলে উপস্থাপন করেছে, সেই অবয়বটা আমাদের দূর অতীতে দেখা কেউ, যা ব্রেইনের মেমোরি সেন্টারে সযত্নে তুলে রাখা ছিল। ব্রেইন ‘মেমোরি’ থেকেই তা তুলে এনেছে। মনে করতে পারছেন, ঠিক কে সে। তবে ভালো করলে মনে করার চেষ্টা করলে পরে হয়তো সেই বয়স্ক অবয়বের আসল মানুষকে খুঁজে বের করা যাবে।
স্বপ্নে বিপরীত বিষয়ই আমরা বেশি দেখি। যেমন পরীক্ষায় ফেল দিয়েছি। লিখতে পারছি না, কমন পড়েনি বা পরীক্ষক খাতা টেনে নিয়ে গিয়েছেন। কিংবা ভালোবাসার মানুষ অন্যের হাত ধরে টা-টা বাই-বাই বলে চলে যাচ্ছে। আপনি তার পেছনে পেছনে ‘নাইট রাইডার’ হয়ে ‘না -যেও না...’ বলে দৌড়াচ্ছেন, কিন্তু পারছেন না, আপনার পা মাটিতে লেপ্টে যাচ্ছে।
স্বপ্ন যেহেতু আপনার বর্তমান অতীত অভিজ্ঞতা, আপনার চিন্তা-চেতনা, আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি তাই স্বপ্নকে খুব একটা সিরিয়াসলি নেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
এবার আসি মৃত ব্যক্তিকে উপলোব্ধির বিষয়ে।
বিজ্ঞান এই ধরণের ঘটনাগুলোকে মূলত হ্যালুসিনেশনের আওতাধীন বলেছেন। হ্যালুসিনেশনকে দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। একটি হচ্ছে হিপনেজোগিক হ্যালুসিনেশন যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তার দশ সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে যা ঘটে থাকে, আর অন্যটি হচ্ছে হিপনোপমপিক হ্যালুসিনেশন যখন মানুষ জেগে উঠে তারপর যা ঘটে থাকে।
তবে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকার কারণে ইন্দ্রিয়ের ওপর ভিত্তি করে হ্যালুসিনেশনের বেশ কিছু ধরনকে বিশেষজ্ঞরা শণাক্ত করতে পেরেছেন। যেমন:
ভিজুয়াল বা দৃষ্টিতে হ্যালুসিনেশন: এক্ষেত্রে এমন কিছু দেখা, যার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই। হতে পারে সেটা কোনো আকারের-বর্ণের কিংবা আলোর ছটা, যা অবাস্তব মানব আকৃতি বিশেষ। যেমন মনে হতে পারে পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তখন পেছনে বা আড়ালে বস্তুত কেউই নেই।
অডিটরি বা শ্রুতিগত হ্যালুসিনেশন: এমন কোনো শব্দ, মিউজিক হইচই কিংবা কণ্ঠস্বর শোনা, যা নিতান্তই অলীক। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেটা হয়ে থাকে, তা হলো ক্ষতিকর গায়েবি কথা, আদেশমূলক কিংবা নিষেধমূলক কথা শোনা। এসব কথা মস্তিষ্কের ভেতর বা বাইরে থেকে হতে পারে। পুরুষ কিংবা নারীকণ্ঠ হতে পারে, অপরিচিত কিংবা পরিচিত মনে হতে পারে। সিজোফ্রেনিয়া রোগীর ক্ষেত্রে অডিটরী হ্যালুসিনেশন বেশি হয়ে থাকে।
অলফ্যাক্টরি বা ঘ্রাণজনিত হ্যালুসিনেশন: এক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি এমন কিছু জিনিসের ঘ্রাণ অর্থাৎ গন্ধ পাবে, যার কোনো সত্যতাই নেই, শুধুই একটি ভ্রান্ত ধারণা। যেমন: হঠাৎ করে পঁচা মাছের গন্ধ, বমি, প্রস্রাব, সিগারেট এমনকি পঁচা লালার গন্ধও পেতে পারে। এটি মূলত হয়ে থাকে অলফ্যাক্টরি সিস্টেমের স্নায়ুকোষের ক্ষতিগুলো থেকে, যা ভাইরাস ইনফেকশন ব্রেন টিউমার ট্রমা, সার্জারি কিংবা ওষুধের কারণে হয়ে থাকে।
গ্যাস্টেটরি বা স্বাদজনিত হ্যালুসিনেশন: কোনো কিছুর স্বাদকে মুখে বিস্বাদ লবণাক্ত বা মেটালিক মনে হয়, সম্পূর্ণটাই ভুল ধারণা। সাধারণত এপিলেপসি রোগে এ ধরনের হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে। টমেটো, আলু, বেগুন, মরিচ জাতীয় খাবারে ‘সোলানিন’ নামক উপাদান থাকে যেটি হ্যালুসিনেশনে প্রভাব রাখতে পারে। তাছাড়া কফি অতিরিক্ত পান করলেও হ্যালুসিনেশনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সোমাটিক বা স্পর্শগত হ্যালুসিনেশন: এক্ষেত্রে কোনোকিছুর স্পর্শ অনুভূত হওয়া, যা বাস্তবিকভাবে ঘটেনি। যেমন হঠাৎ করে শরীরের ভেতর বা উপরে কিছু উঠে আসছে মনে হওয়া। অন্ধকার ঘরে মনে হবে কেউ স্পর্শ করছে অথচ ঘরে তখন কেউ নেই। এটি মূলত একটি মেডিকেল ডিসঅর্ডার।
কারো খুব প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেলে বা মরে গেলে সেই মানুষটিকে নিয়ে হ্যালুসিনেশন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে বলে পরীক্ষা করে দেখা গেছে। হ্যালুসিনেশনের রোগীদের সঙ্গে এমনো হতে পারে, কাছের কোনো একজন মানুষের নাম ধরে গায়েবি কথাবার্তায় সে শুনতে পায়। ক্রমাগত হ্যালুসিনেশন হওয়ায় ঘটে যাওয়া কিংবা শোনা সবকিছুকেই মানুষটি সত্যি মনে করতে থাকে। যার জন্য অনেক বিপদও ঘটে থাকে। সুতরাং এসব বিষয়গুলোকে দ্রুত বুঝে শণাক্ত করা খুবই জরুরি। যত তাড়াতাড়ি তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা যায় ততই মঙ্গল।
ভয় নয়, সত্য উপলোব্ধি করুন। ধন্যবাদ।
#স্বপ্ন #হ্যালুসিনেশন