05/12/2025
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে দেশের সকল মানুষের সমান অধিকার থাকলেও কিন্তু বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ আমরা দেখি না। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে তাকালে এই বৈষম্য আরোও প্রকট ভাবে ফুটে উঠে। প্রত্যেকটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ফিজিসিয়ান, ডেন্টাল চিকিৎসকদের পাশাপাশি আরোও অনেক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তি থাকলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বিরল উদাহরণ । এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ফিজিওথেরাপি, হোমিওপ্যাথ, ইউনানি ও আয়ুর্বেদ, পুষ্টিবিদ, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি, মাইক্রোবায়োলজি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবিদের অন্তর্ভুক্তি নেই। কিন্তু সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আবার সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
সম্প্রতি 'বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি অধ্যাদেশ প্রণয়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, এটি মূলত বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ সংশোধনের জন্য তৈরি করা। ইতিমধ্যে এটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। যে কোন আইনকে যুগোপযোগী করার জন্য মন্ত্রণালয় যে কোন সময় এই উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে দেশের এই সময়ে কেন এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে হবে। আমরা জানি দেশের যে কোন জরুরী পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি দেশের প্রয়োজনে কোন অধ্যাদেশ পাশ করতে পারেন। কিন্তু কথা হচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ আইটি কেন জরুরী অবস্থার মধ্যে পড়ল যার জন্য এটি সংশোধন করতে হবে । দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি এই আইনটি সংশোধন না করলে ভেঙ্গে পড়বে। বিষয়টি মোটেই তা নয়, আমরা সবাই জানি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন দেশের ফিজিসিয়ানরা । উনারাই স্বাস্থ্যের সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। উনারা এই সময়টি বেছে নিয়েছেন যাতে সবার মনোযোগের অন্তরালে এমন ১টি আইন করতে পারেন যার মাধ্যমে দেশের সকল স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আসুন দেখে নেই কি কি বিতর্কিত ধারা যুক্ত করেছেন এই অধ্যাদেশে।
ধারা ৩১ (খ)- মেডিকেল ও ডেন্টাল চিকিৎসা সেবা প্রদান করিতে, প্রেসক্রিপশনে অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ লিখিতে এবং অস্ত্রোপচার বা অন্যান্য স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করিতে পারিবে।
এই ধারার মাধ্যমে দেশের সকল চিকিৎসা একচ্ছত্রভাবে দেয়ার অধিকার রাখবেন শুধুমাত্র দেশের এমবিবিএস এবং বিডিএস ডিগ্রীধারীরা। প্রতিটি স্বাস্থ্য পেশাজিবীর স্কোপ অব প্র্যাক্টিস নির্দিষ্ট। সমগ্র বিশ্বেই এভাবে প্রাকটিস হয়ে থাকে। এই ধারায় উল্লেখ আছে অন্যান্য স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করিতে পারিবে এট সম্পূর্ন আইন পরিপন্থী। এখানে এই আইনে নিবন্ধিত প্রফেশনালগণ শুধুমাত্র অ্যালোপ্যাথিক ও ডেন্টাল চিকিৎসা সেবা প্রদান করিতে, প্রেসক্রিপশনে অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ লিখিতে এবং অস্ত্রোপচার করিতে পারিবে এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
ধারা ৩১- ২ অন্য কোন আইনে যাহাই থাকুক না কেন, কেবল নিবন্ধিত মেডিকেল বা ডেন্টাল চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শ বা চিকিৎসাসনদপত্র এবং মেডিকোলিগ্যাল (Medicolegal) সার্টিফিকেট বা রিপোর্ট বৈধ্য বলিয়া বিবেচিত হইবে।
এই ধারার মাধ্যেম দেশের অন্যান্য স্বাস্থ্য পেশাজিবীরা তাদের নিজস্ব প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শ বা চিকিৎসাসনদপত্র এবং মেডিকোলিগ্যাল (Medicolegal) সার্টিফিকেট প্রদান করার অধিকার হারাবেন। অন্যান্য পেশাজিবিদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে। স্বাস্থ্য পেশাজিবীদের রোগ নির্ণয়, পরীক্ষণ করে প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শ বা চিকিৎসাসনদপত্র প্রদান করেন এটি একটি সার্বজনীন অধিকার।
কাউন্সিলের গঠন ৫ (১) (গ)- জাতীয় সংসদের স্পীকার কর্তৃক মনোনীত জাতীয় সংসদের দুই জন সংসদ সদস্য, যাহারা যথাসম্ভব চিকিৎসক হবেন।
জাতীয় সংসদের স্পীকার কর্তৃক মনোনীত জাতীয় সংসদের দুই জন সংসদ সদস্য এই কাউন্সিলের সদস্য হবেন কিন্তু উনাদের কেন চিকিৎসক হতে হবে। এর মাধ্যমে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট তৈরি হবে। একজন সংসদ সদস্য নিরপেক্ষ ভাবে উনার মতামত দিবেন তা অনেকাংশে রহিত হবে। উক্ত কাউন্সিল গঠনের জন্য দেশের অন্যান্য স্বাস্থ্য পেশাজীবী হতেও কোন সদস্যকেও রাখা হয়নি।
ধারা ৫৪ (১)- অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রী প্রাপ্তগণ ব্যতিত অন্য কেহ তাহাদের নামের পূর্বে ডাক্তার উপাধি ব্যবহার করিতে পারিবেনা।
কাউন্সিল শুধুমাত্র তার নিবন্ধিত প্রফেশনাল দের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, একটি কাউন্সিল কখনো অন্য কাউন্সিলে নিবন্ধিত প্রফেশনাল দের কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আমরা জানি ইতিমধ্যে অন্যান্য পেশাজীবিগণ বিভিন্ন আইনের মাধ্যেমে সৃষ্ট কাউন্সিলের মাধ্যেমে পদবি হিসেবে ডাক্তার ব্যবহার করেন। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি কাউন্সিল, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল, বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল ইত্যাদি আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট কাউন্সিল। উক্ত কাউন্সিলের মাধ্যেম নিবন্ধন প্রাপ্ত পেশাজীবীগণ নামের পূর্বে ডাক্তার পদবি ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল এর ধারা ১৯ অনুযায়ীঃ রিহ্যাবিলিটেশন পেশাজীবীগণ কর্তৃক ব্যবহার্য পদবি কি হবে তা নির্ধারিত হবে। এই অধ্যাদেশের আলোকে এই সমগ্র পেশাজীবিদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে।
এই অধ্যাদেশ পাশ হলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। অন্যান্য পেশাজীবীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে এবং উনারা সংক্ষুব্ধ হবে যা দেশের জন্য কোনভাবেই মঙ্গল বয়ে আনবে না। অতি দ্রুত এই অধ্যাদেশ বাতিল করতে হবে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার আসলে প্রয়োজন হলে বিএমডিসি আইন ২০১০ সংশোধন করে এটিকে আরোও যুগোপযোগী করা যেতে পারে। এই মুহুর্তে এই অধ্যাদেশ এভাবে পাশ হলে এটি একটি কালো আইনে পরিণত হবে । আমরা আশা করি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা উক্ত অধ্যাদেশ রহিত করে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে রক্ষা করবেন।
সব শেষে আরো একটি প্রশ্ন ❓বাংলাদেশ মেডিক্যাল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (BMDC).... এখানে মেডিক্যাল এর পরে ডেন্টাল, তাহলে ডেন্টাল রা কি মেডিক্যাল পার্সন নয়?
ডেন্টাল কেন আলাদা করে লিখতে হলো❓