07/01/2025
“ মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি “
যেই গান এদেশের প্রতিটি মানুষকে প্রচণ্ডভাবে উজ্জীবিত করেছিল অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে।
জ্বি, আমি জীবন্ত কিংবদন্তী আপেল মাহমুদের কথা বলছি ।
একুশে পদক প্রাপ্ত শব্দ সৈনিক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আপেল মাহমুদ ছিলেন আমাদের কুমিল্লা জিলা স্কুলের ৬২ ব্যাচের ছাত্র ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে গান গেয়ে ও কথিকা পাঠ করে মুক্তিযুদ্ধ সহ জাতিকে সামগ্রিক যুদ্ধে উজ্জীবিত করেন তিনি ।
তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হওয়ার পরপরই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং জুন মাস পর্যন্ত ৩ নম্বর সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেছেন প্রত্যক্ষভাবে। এরপর তিনি যোগদান করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শিল্পী হিসেবে ।
আপেল মাহমুদ কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি কুমিল্লার আওয়ার লেডি অব ফাতিমা গার্লস হাই স্কুলে। সেখান থেকে কুমিল্লা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। মেট্রিক পাশ করেন এ স্কুল থেকেই।
তারপর ঢাকার কায়েদে আজম মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি ।
সংগীতে হাতে খড়ি হয় কুমিল্লা জিলা স্কুলে অধ্যয়নের সময়ে । কুমিল্লার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করায় সমগ্র শহরে পরিচিতি বাড়তে থাকে তাঁর ।
কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র হিসেবে ১৯৬১ সালে প্রাদেশিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় স্কুল পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন।
৮ম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় প্রথমবারের মত ঢাকা কলেজে অনুষ্ঠিত প্রদেশ ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে তিনটি স্বর্ণপদক পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন।
আপেল মাহমুদ বিভিন্ন সময়ে ডাঃ মোঃ মুতরীব, ওস্তাদ সুখেন্দু চক্রবর্তী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ মুন্সী রইস উদ্দিন প্রমুখ সংগীত সাধকগণের কাছে সংগীতের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তালিম নেন।
বাবার মৃত্যুর পর এবং মায়ের চাকরির কারণে প্রিয় শহর কুমিল্লা ছেড়ে চলে যেতে হয় তাঁকে নরসিংদীতে।
সে সময় দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আপেল মাহমুদ সেখান থেকে চলে যান ভারতে। প্রথমে আগরতলা ও পরে কলকাতা।
ক্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন তিনি । বিশেষ করে ভৈরব, আশুগঞ্জ, আজমীরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, তেলিয়াপাড়া এসব স্থানে সংগঠিত যুদ্ধে আপেল মাহমুদ সাহসিকতার সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ।
যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি বেতার কেন্দ্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশবাসীকে উদ্দীপিত করার তাগিদ অনুভব করে আপেল মাহমুদকে এর সাথে সম্পৃক্ত করেন।
আপেল মাহমুদ প্রথমে আগরতলার কয়েকটি শিবিরে গণসংগীত ও প্রেরণাদানকারী সংগীত পরিবেশন করে সকলের দৃষ্টিতে পড়েন। এরপর শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ।
আপেল মাহমুদ সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন। তিনি সেখানে শুধু শিল্পী নন, একটি যুদ্ধরত জাতির জন্যে বেতার কেন্দ্রের ভূমিকার বিষয় উপলব্ধি করে প্রতিনিয়ত প্রেরণামূলক সংগীত রচনা, সুরারোপ ও পরিবেশনার দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রায় প্রতিদিন আপেল মাহমুদের কণ্ঠে যুদ্ধরত বাংলাদেশ শুনতে পায় ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলি যুদ্ধ করি’, (গীতিকার গোবিন্দ হালদার, সুর আপেল মাহমুদ) ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে’ (গীতিকার ও সুরকার আপেল মাহমুদ) ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না।’ (গীতিকার গোবিন্দ হালদার, সুরকার আপেল মাহমুদ) ‘রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই নেব আমরা’ সহ মোট ৩১টি গান তিনি পরিবেশন করেছিলেন। যা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের মধ্যে সর্বাধিক।
আপেল মাহমুদ একজন নন্দিত গণসংগীত শিল্পী, পল্টনে গণসংগীত পরিবেশনার অভিযোগে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী সংগীতের মাধ্যমে জনগণকে উত্তেজিত করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। ফলে তাকে কারাবরণও করতে হয়।
তিনি বিভিন্ন সময়ে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়েচে ভেলে, মালয়েশিয়া এবং অষ্ট্রেলিয়ার রেডিও ও টিভিতে সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন।
বিশেষ করে একটি বিদেশি সংস্থা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় ২ নং সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধ এ্যাকশানকে নিয়ে একটি ছবি নির্মাণ করেছিল। আপেল মাহমুদ ছবিটির নেপথ্যে কন্ঠ দিয়েছিলেন।
কোন আন্তর্জাতিকমানের ছবিতে নেপথ্যে কন্ঠদান কোন বাংলাদেশী সংগীত শিল্পীর জন্য এটাই ছিল প্রথম।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসার বিরল সৌভাগ্যর অধিকারী আপেল মাহমুদ।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পর বঙ্গবন্ধু আপেল মাহমুদ এর কর্মজীবনের চিন্তা চেতনা সম্পর্কে জানতে চান। তিনি বিনয়ের সাথে বেতারে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা পেয়ে বেতারকে নতুনভাবে সাজাবার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০০৬ সালে বেতার থেকে মহাপরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এ সময়ে একই সাথে বাংলাদেশ টেলিভিশনেরও ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্যে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরুস্কার দেশে এবং বিদেশে ।
তাছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী আপেল মাহমুদের গান নিয়ে বেরিয়েছে অ্যালবাম “ আপেল মাহমুদ দ্য লিজেন্ড “।
ধন্যবাদ ।