19/07/2025
বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প।অনেকে জানতে চান, তাই রিপোস্ট।
সকল প্রশংসা মহান সৃষ্টিকর্তার।
আমি আমার গল্পটি শেয়ার করতে চাই মূলত আমার সহযোদ্ধা সেই সকল আপুদের জন্য,যারা সব থেকেও কিছু একটা না থাকার বেদনা অনুভব করেন সতত। সেই কিছুটা হল- নিজের যোগ্যতাবলে অর্জিত একটি পরিচয়।
আমার বেড়ে ওঠাঃ
সালটা ১৯৯৫। বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাওয়া, ভর্তি হই বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল ও কলেজে,চট্টগ্রাম এর ১ম শ্রেণীতে। সেই যে প্রবেশ, সেখান থেকে বের হই ১২ বছর পরে, ২০০৭ সালে।
আমার জীবনে প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক আমার বাবা।বাবা বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কর্মরত।৭ম শ্রেণি পর্যন্ত আমার প্রাইভেট টিউটর ছিল না, বাবাই পড়াতেন। আমার জ্ঞানের বেসিক মূলত তিনিই গড়ে দিয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে তিন ভাইবোনের শখ-আহ্লাদ বাবা-মা যথাসাধ্য পূরনের চেষ্টা করতেন।মনে পড়ে, ছোটবেলায় দুধ খেতে চাইতাম না।মা আমাকে এক কাপ গরুর দুধ খাওয়ার জন্য ২ টাকা দিতেন,এক গ্লাস খেলে ৫ টাকা।শুধু টাকার লোভে নাক চেপে ধরে দুধ খেতাম।৭ টাকা জমলে ১টা মিমি চকলেট কিনে খেতাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিঃ
পরিবারের স্বপ্ন ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। সে আশায় গুড়েবালি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং বা ঘরে পড়াশোনা কোনটাই করিনি।চরম দুশ্চিন্তা, এক বছর মিস যাবে। আল্লাহর অশেষ রহমতে এ যাত্রায় রক্ষা পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে 'D' ইউনিটে ২৩৫ তম হই মোটামুটি বেসিক নলেজ দিয়ে পাশ করে।
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াঃ
সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই ১৯ বছর বয়সে। তখন মনে হচ্ছিল বিয়েটা বেশ ইন্টারেস্টিং বিষয়।কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে দেখলাম সংসার সামলানো, অন্যদের মন যুগিয়ে চলা, একইসাথে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া খুব সহজ বিষয় নয়। কিছুটা বিষণ্ণতা ঘিরে ধরলেও আত্মবিশ্বাসের জোরে তা কাটিয়ে উঠলাম এবং নিজেই নিজের অভিভাবক হয়ে উঠলাম।
সন্তানের জন্মঃ
যখন মাস্টার্স ফাইনাল দিচ্ছিলাম তখন আমার মেয়ে ৮ মাসের গর্ভে।জীবনের আসল সংগ্রামটা শুরু হয় সন্তান জন্মের পরে। আমার ভাইবোনদের স্কুল-কলেজ,পরীক্ষা থাকায় আমার মা কেবল ১ মাস সময় দিতে পেরেছেন আমাকে।এরপর আমার কাছে কোনো অভিভাবক ছিলেন না,পুরোটা নিজ হাতে সামলেছি। ইন্টারনেট ও বই থেকে তথ্য জেনে সন্তানকে বড় করেছি সম্পূর্ণ সুষ্ঠুভাবে, কিছুমাত্র কমতি না রেখে।এই ভায়াবহ অবস্থা কেবল একজন মা অনুধাবন করতে পারবেন।বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে কেবল শব্দগুচ্ছের বর্ণনায় এই মানসিক স্ট্রেস ঠাহর করা অসম্ভব।
সন্তান জন্মদানের পরে প্রায় দুই বছর পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশনে ভুগি।তবে এর আঁচ আমি আমার মেয়ের উপরে পড়তে দেইনি।অত্যন্ত কঠিন মনোবলের পরিচয় দিয়ে নিজেকে ও সন্তানকে সামলাতে হয়েছে।
দৈনিক ৮-১০ ঘন্টা ঘুমকাতুরে আমিকে যখন রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটাতে হত, মাঝে মাঝে মনে হত, জীবনে বুঝি এতটুকুই হওয়ার ছিল! রাজ্যের হতাশা ভর করে, আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকে!
একসময় আবার মনে শক্তি জড় করতে থাকি, নিজেই ডিপ্রেশন থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হই।তখন ভাবতাম, মেয়েটা আরেকটু বড় হলেই প্রাইভেট জবে জয়েন করব।যেটুকু যোগ্যতা আছে অন্তত একটা প্রাইভেট জব জুটে যাবে।২০১২ থেকে ২০১৬,এই চার বছর কোনো পড়াশোনা করিনি,কারন প্রাইভেট জব করতেতো আর পড়তে হয় না!
নতুন করে স্বপ্ন দেখাঃ
একডেমিক স্টাডি শেষ করার পর কখনো কেউ আমাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনেনি বা কেরিয়ার গড়ার উৎসাহ দেয়নি।একটু দেরিতে হলেও নিজেই নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। যখন আমার স্বপ্নটা অন্যদের জানালাম, তখন অনেকেই আমার কেরিয়ার গড়ার কোনো হেতু খুঁজে পাননি! ভালোইতো আছি,খামোখা কেন কষ্ট করতে যাবো!
কয়েকটা চিন্তা আমার বিবেককে তাড়িয়ে বেড়াত।
১। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র আমাকে অকৃপণ দানে ধন্য করেছে, আমি কি কিছুই দিতে পারবোনা সমাজকে!
২। জীবন একটাই, জন্মও একবার। আমার চাওয়ার মত করে জীবনকে সাজাতে হলে এক জন্মেই তা করে যেতে হবে, তাও আমার ৩০ বছর বয়সের মধ্যে।
৩। লালন বলেছেন, "সময় গেলে সাধন হবে না।"
স্কুল-কলেজের 'ভালো ছাত্রী' খ্যাতিটা আমার কাছে এক প্রকার বোঝা মনে হতে লাগল। ৩০ বছর পার হয়ে গেলেই আর কেউ আমার বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন মনে রাখবে না, চারটা 'A' ক্যাটাগরির সার্টিফিকেট তখন ফেলনা বস্তুতে পরিনত হবে।
৪। ভীষণভাবে 'আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ' এ ভুগতে থাকি। কারো উপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা মেনে নেয়া খুব কষ্টকর।
৫। একটা সময় হীনমন্যতায় ভুগতে থাকি। আমার চারপাশের প্রাকৃতজন নারীদের সাথে তুলনা চলে আসত মনে মনে।
এরইমধ্যে ৩৪ তম, ৩৫ তম ও ৩৬ তম বিসিএস এর ফলাফল প্রকাশ হয়। ফেসবুকে ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সহপাঠী ও বন্ধুদের সফলতার খবরে অনুপ্রাণিত হই। তখন মনে হয়, আর প্রাইভেট জবের ভাবনা নয়, একই পথের পথিক সহপাঠীরা যা পেরেছে,আমিও তা অর্জন করতে পারব।
বিসিএস এর প্রস্তুতিঃ
নিজেকে আবার শানিত করতে শুরু করলাম প্রস্তুতি। পূর্বেই ৩৭ তম বিসিএস এর আবেদন করেছিলাম। যখন সিরিয়াসলি ভাবলাম প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দেব তখন মাত্র ২ মাস বাকি।
সবার সাথে কথা বলে বুঝলাম এবার চান্স পাওয়া সম্ভব নয়,তাই ৩৮ তম বিসিএস এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার কথা ভাবলাম। তারপর মনে হল, ২ মাসের একটা এটেম্পট নিয়ে দেখি কি হয়!
৩৭ তম প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছিল ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। ১৭ সেপ্টেম্বর আমার ও আমার মেয়ের চিকেন পক্স হয়। আমি পক্স নিয়েই পরীক্ষায় অংশগ্রহন করি।
রিটেনের সময় অনেক কম ছিল। তখন ১.৫ মাসের মত আমি পড়াশুনা করেছি। এই সময়টাতে আমার হাজবেন্ড আমাকে বেশ সহায়তা করেছেন। আমার মা ও বোন প্রিলিমিনারি, রিটেন ও ভাইবা ফাইনাল পরীক্ষাগুলোর আগে আমাকে ২০-২৫ দিন সময় দিয়েছেন। এ যাত্রায় যারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন, আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
আমি ঘুম থেকে উঠতাম সকাল ৭.৩০-৮.০০টায়। এর পর ননস্টপ ঘরের কাজ, বাচ্চার স্কুলে নিয়ে যাওয়া, মেয়ের যত্ন, নিজের কাজ, সংসার সামলানো - সব গুছিয়ে বই ধরার ফুসরত মিলত রাত ১১.০০ টার পরে।
মেয়ের স্কুল ছিল ২ ঘন্টা। এতো সময় অলস বসে থাকা কষ্টকর, আবার শোরগোলে পড়াও সম্ভব নয়।তাই আমি সময়টাকে প্রোডাক্টিভ কাজে লাগানোর জন্য একটা ইয়োগো সেন্টারে প্রাণায়াম, ও যোগব্যায়াম করতাম নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে ফিট রাখতে।
মেয়ে আমাকে ছাড়া ঘুমাতে যেতে চাইত না।ওকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে আমি অন্ধকারে চোখ মেলে থাকতাম, কারন চোখ বুজলে আমি ঘুমিয়ে পড়ব, একটা রাত পড়া হবে না!
সবাই বলেন, বিসিএস ক্যাডার হয়ে বাবা-মা বা অন্য কারো স্বপ্ন পূরণ করেছেন।আমি বলব, আমি আমার নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছি, কারন স্বপ্নটা ছিল আমার।আমার দৌড়ে আমি যখন অনেকটা এগিয়ে গেছি, তখন অনেকেই আমাকে শুভকামনা জানিয়েছেন,আমার জন্য দোয়া করেছেন।তাঁদের মধ্যে আমার শ্বশুর, স্বামী, বাবা-মা উল্লেখযোগ্য।
আমার সংগ্রামটা ছিল অনেক কঠিন। কেউ আমার দায়ীত্ব বা কাজগুলো কাঁধে নিয়ে আমাকে পড়ার সময় করে দেননি। স্ত্রী, মা, সন্তান, পুত্রবধূ, প্রতিবেশী -সব দায়ীত্ব পালন করে, স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভিনেত্রীর ভূমিকা পালন করে, পৃথিবী যখন ঘুমের রাজ্যে ডুব দিত,সেই সময়টায় আমি বই নিয়ে বসতাম।
আবার সকাল ৭.৩০-৮.০০ টা হলেই শুরু হত রংগমঞ্চের অভিনয়। সবমিলিয়ে আমার ঘুম হত সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টার মত। দিনেও রেস্ট নেয়ার সুযোগ ছিল না। সারাদিন মাথা ঝিমঝিম করতো।
ফলাফল প্রকাশের পর সবার মুখে একটা কথাই ছিল, আমরা নিশ্চিত ছিলাম তুমি প্রথম চয়েজই পাবে! যদিও আমি নিজে খুব চিন্তায় ছিলাম, কারন এটাই আমার প্রথম জব পরীক্ষা। আমি পূর্বে কখনো কোন প্রাইভেট বা সরকারি জবে আবেদন করিনি।
ধৈর্য নিয়ে এই দীর্ঘ কীর্তন পড়ার জন্য ধন্যবাদ।এই দেশ, সমাজ আমাকে যা দিয়েছে, কিছুটা হলেও যেন তার ঋণ শোধ করতে পারি, আমার জন্য এই প্রার্থনা করবেন।
উম্মে হাবিবা ফারজানা
বিসিএস প্রশাসনে সুপারিশপ্রাপ্ত
মেধাক্রম-১২০
৩৭ তম বিসিএস।