22/07/2025
আজকে দুপুর ১টায় আমাদের সেকেন্ড ইয়ার-এর ক্লাস শেষ হয়। আমরা প্রতিদিনের মতো ক্লাস শেষে ক্যাম্পাস থেকে বের হচ্ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে একটা ফাইটার জেটের শব্দ শোনা যায়। যেহেতু আমাদের ক্যাম্পাস এয়ারপোর্টের একদম কাছাকাছি, তাই এভাবে প্রায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিমান উড়তে দেখাটা খুবই স্বাভাবিক।
কিন্তু এবার জেটের শব্দ কানে আসতেই না আসতেই এক বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনি। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম হয়তো কোনো গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ করে। পেছনে ফিরে দেখার আগেই কিছু মানুষ বলে উঠল, "প্লেন ক্র্যাশ করছে!" আমি প্রথমে শুনেই ভাবি যে “প্লেন আবার এখানে কীভাবে ক্র্যাশ করে? হয়তো কোনো পার্ট খুলে পড়ছে।”
এরপর দেখি এক বিশাল আকারের আগুন আর ধোঁয়া। তখন বুঝে নিতে দেরি হয় না, কোথাও একটা বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে দেখলাম, সত্যি একটা আস্ত প্লেন আমাদের ক্যাম্পাসের উপর পড়ছে, হায়দার আলী বিল্ডিং-এর উপর, যেখানে মূলত ক্লাস ৪ থেকে ৮ এর মতো ছোট বাচ্চারা ক্লাস করে।
এরপর শুরু হয় মানুষের চিৎকার, অসংখ্য আহত ছাত্রছাত্রীর আর্তনাদ। আমরা ক্র্যাশ সাইটের কাছে যেতেই দেখি আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের বিল্ডিংগুলো থেকে ফায়ার এক্সটিংগুইশার এনে সবাই কাজে লেগে পড়ে। কিন্তু এই আগুন তো সাধারণ আগুন নয়—জেট ফুয়েলের আগুন। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তা পুরোপুরি নিভানো সম্ভব হয় না।
এই অবস্থাতে আগুন পুরোপুরি না নেভার আগেই কয়েকজন ছাত্র মুখে কাপড় বেঁধে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ভিতরের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মতো ছিল না—এতটাই মর্মান্তিক, এতটাই ভয়াবহ। ২-৩টা সেকশন প্লেনের ধাক্কায় একেবারে তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, প্রায় সবাই স্পট ডেড।
এতক্ষণে পাশেই থাকা আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। বাকি রুমগুলো থেকে অসংখ্য আহত ছাত্রছাত্রীদের উদ্ধারের কাজ শুরু হয়। একে একে আহত শিক্ষার্থী ও অসংখ্য মৃতদেহ বের করা হয়, স্ট্রেচারে তুলে সবাই মিলে দৌড়ায় বুকভরা আশা নিয়ে যেন অন্তত এই ছেলেটা বা মেয়েটা বেঁচে থাকে।
অধিকাংশ মৃতদেহ প্রায় চেনার অযোগ্য। কারো মাথা খুঁজে পাওয়া যায়না তো কারো শরীরের অর্ধেকই পাওয়া যায়না। তার উপর এখানে সব ছাত্রছাত্রীরাই ছিল একদম ছোট ছোট বাচ্চা। জেট ক্র্যাশ করার সময়ে যারা ক্লাসে বসে ছিল, তাদের দেহ একদম সেই অবস্থাতেই পড়ে ছিল।
আহত ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর চামড়া খসে পড়ছে, চিৎকারে-আর্তনাদে পুরো ক্যাম্পাস কেঁপে উঠছে। কিন্তু আমরা অসহায়। বুক চেপে শুধু দোয়াই করতে পারছি—যেন অন্তত শিশুটি হাসপাতালে পৌঁছানো পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
এর পাশাপাশি কিছু শিক্ষক ও গার্ডিয়ান মারা গেছে। কয়েকজনকে শনাক্ত করা গেলেও বাকিরা এখনো নিখোঁজ। আমরা সাধারণ ছাত্রছাত্রী হয়ে আজকে এতটাই ট্রমাটাইজড যে—যখন কারও বাবা-মা এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে, "বাবা, আমার বাচ্চাটা কোথায়?" তখন বুঝতে পারতেছিলাম না তাদেরকে কী বলে শান্তনা দেওয়া যায়। কী বলে তাদের কান্না থামানো যায়।
আমরা নিজেরা প্রত্যক্ষদর্শী। মাইলস্টোনের প্রায় ২০ হাজার+ শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষদর্শী, এখানে ৯০-১০০+ মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চিত, কিন্তু আর্মি সেটা কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেই চলতেছে। ধারণা করা সর্বনিম্ন ১২০ মৃত্যুর সংখ্যা যখন আমার ভাইয়েরা প্রেসকে জানাতে যায়, তখন সেনাবাহিনী তাদের উপর লাঠিচার্জ করে। প্রেসের লোকজন তো বাদ দিলাম, যেই শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ ৪-৫ ঘন্টা যাবত কাজ করে গেল সকল বাহিনীকে সাহায্য করতে, সেই শিক্ষার্থীদেরকেও ছাড় দিল না। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার সেই মূহূর্তে সামনে থাকায় তাকেও ধাক্কা মারে সেনাবাহিনী। আমাদের ভাই শাফায়েতকে মেরে বাজে ভাবে আহত করে। তার দোষ? কেন যমুনা টেলিভিশনকে আসল death count বলতে গেছিল। এইটাকে তারা নাকি বলে "crowd control", অমানূষগুলা।
এখন তো তাও পুরা ক্যাম্পাস সিল-অফ করে দেওয়া, অথচ বিল্ডিং এর ভেতর অনেক লাশ এখনো পড়ে আছে। আল্লাহ জানেন রাতের অন্ধকারে সেগুলোকেও গুম করে ফেলা হয় কিনা।
আবারও বলছি, আমার ছোট ভাই-বোনদের মৃতদেহ নিয়ে যেন কোনো রাজনীতি না হয়। নাহলে এর পরিণাম ভালো হবে না কিন্তু। যত দ্রুত সম্ভব "আসল" এবং "অপরিবর্তিত" মৃত্যুর সংখ্যা যেন প্রকাশ করা হয়। এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ যেন তাদের দোষ ও ব্যর্থতা শিকার করে নেয়। দরকার হলে বাংলাদেশ নাহয় আরেকটা জুলাই-এর সম্মুখীন হবে।
সর্বশেষে, আপনি আসলে দোষ দিলে দিবেনই বা কাকে? পূর্বের ব্যর্থ সরকারের অবহেলাকে? পূর্বের দূর্নীতি গ্রস্থ এয়ার মার্শাল ও চিফগুলোকে? নাকি পুরো সিস্টেমটাকেই? সোনার বাংলাদেশে একটা প্রাচীন যুদ্ধ বিমানের দাম নাকি ৭ কোটি যেখানে মানুষ সৌখিন রোলস রয়েস কিনে ২০ কোটি দিয়ে।
কেউ যদিও এই ঘটনার দায়ভার নেয়, সেই ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোকে কী আর ফিরে পাওয়া সম্ভব? আর কতো বাবা-মায়ের কোল খালি হতে হবে এই দেশে?
To the children who went to school and never returned today, Heaven has found new angels.
-through the eyes of a milestonian