13/07/2025
গত বছর আমরা পালিয়ে এসেছিলাম।
ভাবতেও পারিনি—এই বয়সে এসে আমাদের এমন কিছু করতে হবে।
কিন্তু কিছু সম্পর্কের মাঝে বাঁধনটা এত গভীর হয়, যেখানে আলাদা থাকার কোনো মানে থাকে না।
সামসুদ্দিন মিয়া (৭৭) ও রেখা বেগম (৬২)
আমার আর আমার স্ত্রীর সেই বাঁধনের বয়স এখন ৪৭ বছর।
প্রতিদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগেই সে আমাকে জাগায়।
একসাথে ওযু করি, নামাজ আদায় করি।
৪৭ বছরে একদিনও আমরা একজন আরেকজনের থেকে আলাদা থাকিনি।
আমার দিন শুরু হতো তার মুখ দেখে, রাত শেষ হতো তার কণ্ঠ শুনে।
আমরা আমাদের ছয় সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি।
অনেকদিন এমন গেছে, যখন এক বেলার খাবারও জোগাড় করা কঠিন ছিল।
তখন আমি আর রেখা না খেয়ে থাকতাম, শুধু সন্তানদের মুখে কিছু তুলে দিতাম।
সে একদিনও কোনো অভিযোগ করেনি, কোনোদিন বলেনি—
“তুমি স্বামী হিসেবে ব্যর্থ।”
এত অভাব, এত কষ্টের মাঝেও আমরা ঝগড়া করিনি।
একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারাইনি।
কিন্তু যখন বড় ছেলে আমাকে আর ছোট মেয়ে তার মাকে আলাদা করে নিয়ে গেল—
তখন বুঝিনি আমাদের ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেছিল—তাদের সামর্থ্য সীমিত।
একসাথে আমাদের দায়িত্ব নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
আমরা চুপচাপ তাদের কথা মেনে নিই, কারণ আমরা সন্তানদের বোঝা হতে চাইনি।
কিন্তু প্রতিটি সকাল আমি আর পারছিলাম না।
ঘুম ভাঙার পর আমার চোখ খুঁজত তার মুখ।
দিনভর অপেক্ষা করতাম কখন আমার ছেলে বাড়ি ফিরবে—
যাতে তার ফোন দিয়ে একটিবার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারি।
প্রায় রাতেই সে দেরিতে ফিরত, আর তখন অপরপাশে থাকা আমার স্ত্রী হয়তো ঘুমিয়ে পড়ত।
একদিন যখন অবশেষে তার গলা শুনতে পেলাম,
আমরা কেউই একটা শব্দ পর্যন্ত বলতে পারিনি।
শুধু অনুভব করছিলাম—
সে কীভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠটাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।
আমিও আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করলাম।
জীবনের এই বয়সে এসে বুঝলাম—একজন আরেকজন ছাড়া জীবন কতটা শূন্য হতে পারে।
একদিন আমি সাহস করে তাকে বললাম,
“চলো, পালিয়ে যাই।”
সে একটুও দেরি না করে বলল,
“চলো, এখনই চলো।”
আমি আমার লাঠি হাতে নিলাম, আর পেছনে তাকাইনি।
আমরা পালিয়ে এলাম—দু’হাতে কিছুই ছিল না।
এখন আমি রাস্তার ধারে বসে ছোটদের খেলনা বিক্রি করি।
কখনো কখনো ১০০ টাকাও হয় না।
বাসায় ফিরলে দেখি রেখা বিছানায় খাবার রেখেছে—
একটু ভাত, একটু আলু ভর্তা, একটু ভালোবাসা।
গত বছরে একবার আমাদের ছেলেমেয়েরা এসেছিল,
তারা বলেছিল—
আমরা নাকি তাদের ব্যর্থ করেছি।
আমাদের জন্য তারা ছোট হয়ে গেছে।
আমরা কিছু বলিনি, কারণ আমরা তাদের আঘাত দিতে চাইনি।
তারা আর না আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেল।
আমরা ওদের মিস করি।
তাদের জন্য দোয়া করি।
কিন্তু এখন জানি—আমাদের সময় শেষ হয়ে আসছে।
আমি রেখার থেকে পনেরো বছর বড়।
যেকোনো দিন রাস্তার মাঝখানে পড়ে যেতে পারি।
তাই আমি একটামাটির ব্যাংকে টাকা জমাই—
যাতে আমার মৃত্যু হলে রেখাকে কারো কাছে হাত পাততে না হয়।
প্রতিদিন নামাজের পর দেখি রেখা চুপচাপ কাঁদে।
আমি জিজ্ঞাসা করি—
“কেন কাঁদো?”
সে বলে—
“আমি তোমার সাথে মরতে চাই।”
এমন ভালোবাসা, এমন দৃষ্টান্ত যুগে যুগে ইতিহাস হয়ে থাকে।
আল্লাহ এই দুই আত্মার ভালোবাসাকে কবুল করুন।
এই ভালোবাসা যেন জান্নাত পর্যন্ত গড়ে উঠতে পারে—আমিন।