
24/09/2025
জীবন ও সংগ্রামের আধুনিক রূপকথা’র রূপকার কবি দিপালী রানী সরকার : প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষিত- কাব্যগ্রন্থ ‘বরেন্দ্র কন্যা’
**************************************************************
কবি দিপালী রানী সরকার তাঁর ‘বরেন্দ্র কন্যা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোয় এঁকেছেন এক জীবন্ত চিত্রকল্প, চিত্রকল্পের সমৃদ্ধি, ঋতু প্রকৃতির রূপমাধুরী ও প্রেমিক-প্রেমিকার মানসিক দ্বন্দ্ব। কখনোবা প্রতিভাত করেছেন- লোকজ ভাষা, শব্দের সহজ রেখায় এঁকেছেন নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিত্র। এ যেন তাঁর আবেগের সার্থক বহিঃপ্রকাশ। বরেন্দ্র কন্যায় তিনি ধরতে চেয়েছেন আবহমান বাংলার শেকড়কে। লাল মাটির টান, কৃষকের জীবনসংগ্রাম, নবান্ন, সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস এতে প্রতিফলিত হয়েছে। কবি নিজেকে বরেন্দ্র কন্যা বলেও পরিচিত করেছেন, যা তাঁর আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনাকে ধারণ করে। তিনি যেন তাঁর আত্মপরিচয়ের পাশাপাশি বৃহত্তর সম্মিলিত স্মৃতি ও সংগ্রামের প্রতীক। সাধারণত নদী, মাঝি, ডিঙি নৌকা, গ্রামীণ জীবনের চিত্রে প্রিয়জনের অনুপস্থিতি বেদনার রূপ নেয়। আর সে রূপও কবি তুলে ধরেছেন তাঁর ‘কবে ফিরবে মাঝি’ কবিতায়। ‘নশ্বর দেহ’ কবিতাটি পড়ে নিশ্চয়ই পাঠক চলে যাবেন আধ্যাত্মিকতার দার্শনিক অনুসন্ধানে। আত্মার চিরন্তনতা বনাম দেহের নশ্বরতা—এখানে মুখ্য বিষয়। জীবনের সঙ্গে ট্রেনযাত্রার তুলনা, মাটির গন্ধ থেকে নতুন জীবনের জন্ম—এসব বিষয় বৈচিত্র্য সহজভাবেই ছাপ ফেলেছে তাঁর কবিতায়। কবির ‘মুখ ও মুখোশ’ কবিতায় কবি উন্মোচন করেছেন ধর্মকথার ভেতরে থাকা তিক্ত সত্য। যেখানে মানুষ মুখোশের আড়ালে কপটতা ঢেকে রাখে, জড়িয়ে পড়ে অন্যায়-অধর্মে, যা কাম্য নয়। কবির এ গ্রন্থে নষ্টালজিক কিছু কবিতা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যেমন; লঞ্চ ঘাট, ডাক পিওন ইত্যাদি। গ্রামীণ নদীপাড়ের জীবনচিত্র। ভোরের হাঁক-ডাক, লঞ্চ-নৌকার চলাচল, বাজারের কোলাহল, গ্রামীণ মানুষজন—সব মিলিয়ে জীবন্ত চিত্রপট। অপরদিকে শৈশবের স্মৃতি ও বর্তমান সময়ের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের তুলনা। আগে ডাকপিয়ন খবর আনতো, এখন রয়েছে ডিজিটাল বার্তা। কিন্তু মানবিক যোগাযোগের আন্তরিকতা ডাকপিয়নের সঙ্গেই বাঁধা। এ সকল কবিতায় স্মৃতিনির্ভর চিত্রধর্মিতা, বাস্তব জীবনরূপ তিনি সময়ের পরিবর্তনকে অনুভবের স্রোতে আনতে চেষ্টা করেছেন। এখানেই কবি সার্থক যে, তিনি সত্যনিষ্ঠ উপস্থাপনের মাধ্যমে সামাজিক চেতনাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাদের কাছে বিস্তৃত ভাবনায়।
তাঁর কিছু কিছু কবিতায় সমাজের কপটতা, নীতি-অবক্ষয়, মুখোশধারী মানুষ—এসব বিষয়গুলো যেন কবিতাকেও ছাপিয়ে গেছে কবিতার শব্দাবলীর প্রতিবাদী সুরের সাথে। এখানে কবি যেন নিজেই বহন করছেন একাকী এক ভ্রষ্ট সমাজের প্রতীকী রুদ্রমূর্তি।
মোদ্দাকথা, কবি দিপালী রানী সরকারের প্রতিটি কবিতাই আলাদা আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর হলেও তাঁর লেখনী চিত্রকল্পের স্বচ্ছতা, লোকজ জীবনের টান এবং সামাজিক-দার্শনিক বোধ একসূত্রে গাঁথা।
এগুলো পাঠকের মনে একদিকে যেমন নস্টালজিয়া জাগাবে, অন্যদিকে জীবনের গভীর প্রশ্নকে উসকে দেবে- নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।
জাহান বশীর
আবৃত্তিকর্মী ও কবিতা পর্যালোচক
প্রধান নির্বাহী, জ্ঞানসঙ্গী প্রকাশন।