25/11/2020                                                                            
                                    
                                                                            
                                            কথায় আছে, জন্মের পর প্রথম মুখে মধু দিলে মিষ্টি কথা বলা শেখে শিশুরা। এটা সত্যি নয়, কথার কথা। কিন্তু মধুর যে প্রকৃতই বিশেষ গুণ আছে, সে কথা স্বীকার করতেই হয়। হয়তো মিষ্টি কথা বলানোর গুণ নয়। শরীরের ক্ষেত্রে বিশেষ গুণ। সেই গুণ কিন্তু আবার একটি-দুইটি নয়। অসংখ্য। মধুর সুফল বা উপকারিতা যেমন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রয়েছে, তেমনই রয়েছে রূপচর্চা ও চুলের যত্নে। তবে প্রথম পর্বে আমরা জানব মধু সম্পর্কে বেশ কিছু অজানা কিন্তু জরুরি তথ্য।
প্রাচীন কাল থেকেই মধুর ব্যবহার দেশে ব্যাপক মাত্রায় হয়ে আসছে। তবে শুধু যে দেশে তাই নয়, বিদেশেও কিন্তু মধুর কদর প্রচুর। চিন-সহ এশিয়ার বহু দেশই সকাল শুরু করে মধুর হাত ধরে। অর্থাৎ প্রাতরাশের তালিকায় থাকে মধু।
 
অনেকেই গরম জলে মধু, চায়ের সঙ্গে মধু ইত্যাদি নিয়মে নিয়মিত মধু খেয়ে থাকেন। তার উপকারিতা বা সুফলও পান পুরোদমে।
সেই সুফলগুলি কী? তা তো অবশ্যই জানতে হবে। তবে তার আগে বলে নেওয়া যেতে পারে বিভিন্ন ফুলের মধু থেকে তৈরি মানুষের খাদ্য এই মধুতে রয়েছে দারুণ খাদ্যগুণ।
কী সেই খাদ্যগুণগুলি?
মধুতে রয়েছে ৪৫টিরও বেশি খাদ্যগুণ। তার মধ্যে কয়েকটি হল
১। মধুতে থাকে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ,
২। ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ,
৩। ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ
৪। ৫ থেকে ১২ শতাংশ মন্টোজ
৫। ২২ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড
৬। ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ
৭। ১১ শতাংশ এনকাইম
৮। ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি।
৯। ভিটামিন বি১
১০। ভিটামিন বি২
১১। ভিটামিন বি৩
১২। ভিটামিন বি৫
১৩। ভিটামিন বি৬
১৪। আয়োডিন
১৫। জিংক
১৬। কপার
১৭। অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান
১৮। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান
১৯। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই।
এই তো গেল মধুর খাদ্যগুণ। এবার দেখে নেওয়া যাক মধু নিয়মিত খেলে কী কী উপকারিতা লাভ করা যায়?
১। রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়ায়  –  প্রথমেই যে কথাটি বলার তা হল মধু শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়। শরীরের ভেতরে বাইরে কোনো রকম ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে প্রতিরোধ করে। অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান প্রতিরোধকারী শক্তি গড়ে তোলে, যে কোনো রকম সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে।
২। ওজন কমাতে – নিয়মিত মধু খেলে পাকস্থলীতে বাড়তি গ্লুকোজ তৈরি হয়। এই গ্লুকোজ মস্তিষ্কের সুগার লেভেল বাড়িয়ে দেয়। তার ফলে মেদ কমানোর হরমোন নিঃসরণের জন্য বেশি মাত্রায় চাপ সৃষ্টি করে। ফলে মেদ কমে যায়।
৩। অনিদ্রায় – অনিদ্রার জন্য খুব ভালো ওষুধ হল মধু। রাতে নিয়ম করে মধু খেলে গভীর ঘুম হয়।
৪। কোষ্ঠকাঠিন্য – মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। এই ভিটামিন বি কমপ্লেক্স কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
৫। ডায়রিয়া – মধু ডায়রিয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। তাই যাঁদের আমাশা, ডায়রিয়া বা পেট খারাপের প্রবণতা আছে তাঁরা নিয়মিত মধু সেবন করতে পারেন।
৬। অম্বলের সমস্যা – খাঁটি মধু যদি ভোরবেলা খাওয়া যায় তা হলে অম্বলের সমস্যা, মুখে টক ভাব দূর করে।
৭। হজমের সমস্যা – মধুর মধ্যে থাকা উপাদানগুলি হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে খাবার খাওয়ার পর বদ হজম, গলা বুক জ্বালা ইত্যাদি সমস্যা দূর হয়।  
৮। পাকস্থলীর সুস্থতায় – মধু খেলে পাকস্থলীর কাজ জোরালো হয়। কারণ এটি হজমে সাহায্য করে। এর ব্যবহার হাইড্রোক্রলিক অ্যসিড ক্ষরণ কমিয়ে দেয়। তার ফলে পাকস্থলীর কাজ ভালো হয়।
৯। অরুচি – অনেকেই বেশি খেতে পারেন না। একটু খেয়েই হাঁপিয়ে ওঠেন। বা খাবারে ইচ্ছাটাই থাকে না। অরুচিতে ভোগেন। সে ক্ষেত্রে মধু খেলে খাবরে অরুচি কমে। খাবার চাহিদা বাড়ে।
১০। বমিভাব – অনেকেই আছেন খাবার দেখলেই বা সামান্য খেলেই বমি বমি ভাব আসে। সেই সমস্যার সমাধানও করে মধু। বমিভাব কনায় মধু।
১১। বুদ্ধি বাড়ে – মধু যে শুধু আপনার কায়িক শক্তি বাড়ায়, তা নয়। ঘুমানোর আগে এক চামচ মধু খেলে তা মস্তিষ্কের কাজ সঠিক ভাবে চালাতে সাহায্য করে। তার ফলে মস্তিষ্কের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তথা বুদ্ধির জোর বাড়ে।
১২। হৃদরোগে – এটা হৃদপেশিকে সুস্থ সবল করে এবং এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে আয়ু বৃদ্ধি পায়।
১৩। রক্ত ও রক্তনালী পরিষ্কার – মধু নিয়মিত খেলে রক্তনালীর বিভিন্ন সমস্যা দূর হয়। অর্থাৎ রক্তনালী পরিষ্কার থাকে। সেখানে দূষিত কোনো পদার্থ যা স্বাস্থ্য হানির কারণ তা জমতে পারে না। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়।
১৪। রক্ত উৎপাদনে – রক্ত উৎপাদনকারী উপকরণ হল আয়রন। আর এই আয়রন প্রচুর পরিমাণে রয়েছে মধুতে। ফলে শরীরে লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা-সহ রক্তের ইত্যাদি উপাদানগুলি গড়ে তুলতে সাহায্য করে মধু।
১৫। কোলেস্টেরলের ক্ষেত্রে – মধু রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ ১০% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমার অর্থ হল হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যাওয়া।
১৬। শরীরের নানান ব্যথায় – আজকাল বেশি ভাগ মানুষেরই শরীরের বিভিন্ন জায়ফগায় ব্যথা। ছোটো বড়ো সকলেরই গাঁটে বা জয়েন্টে ব্যথায় কষ্ট পাওয়ার একটি সমস্যা তো লেগেই থাকে। এই সমস্যার কারণ হল শরীরের অবাঞ্ছিত রস। এই রসের কারণে বাতের ব্যথা তৈরি হয়। সেই খারাপ রস অপসারিত করতে মধু বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
১৭। পেশিশক্তি বাড়াতে – পেশিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে মধু। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি। এই প্রাকৃতিক চিনি শরীরে শক্তি যোগায়। পেশিকে অনেক বেশি কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে।
১৮। দুর্বলতা দূর করতে – অনেকেই সারাক্ষণ ঝিমুনি বা দুর্বল অনুভব করেন। এই ঝিমুনি, ঘুম ঘুম বা দুর্বল ভাব কাটানোর জন্য ও সারাক্ষণ তরতাজা থাকতে নিয়মিত খেতে পারা যায় মধু।
১৯। যৌন দুর্বলতায় – অনেক পুরুষের একটা সমস্যা থাকে, তা হল যৌন দুর্বলতার সমস্যা। এই সমস্যা নানান রকমের হয়। এই সমস্যার একটিও যদি কোনো পুরুষের থাকে তবে তিনি নিয়মিত মধু খাওয়া শুরু করতে পারেন। তাতে এই সমস্যা থেকে রেহাই মিলবে।
২০। হাঁপানি – মধুর নানান গুণাগুণগুলির মধ্যে একটি হল এটি হাঁপানি রোগ কমাতে সাহায্য করে। তাই এই রোগ থাকলে তা কমাতে হলে খাওয়া যেতে পারে মধু।
২১। গ্যাসট্রিক আলসারে – যাঁরা গ্যাসট্রিক আলসারের সমস্যায় রয়েছে তাঁরা নিয়মিত মধু খেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
২৩। দাঁতের যত্নে – মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য রক্ষায় মধু ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ এটি দাঁতের জন্য খুবই ভালো। দাঁতের ক্ষয়রোধ করতে পারে মধু। অনেক সময়ই দাঁতে স্টোন হয় অর্থাৎ যাকে দাঁতে পাথর জমা বলে, সেই দাঁতে পাথর জমাট বাঁধা রোধ করে মধু। তা ছাড়াও দাঁত পড়ে যাওয়া আটকাতে বা তা বিলম্বিত করতে সাহায্য করে মধু। সঙ্গে দাঁতের মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
২৪। মুখের ঘায়ে – অনেক সময়ই ভিটামিনের অভাবে মুখের ভেতরে ঘা হয়। অথবা দাঁতের মাড়িতে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। সে ক্ষেত্রে মধু জলে কুলি করলে উপকার মেলে।
২৫। দৃষ্টি শক্তি বাড়াতে – চোখের জন্য খুবই ভালো মধু। দৃষ্টি শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এই মধু।
২৬। সর্দি কাশি কমাতে – শিশুদের সর্দি কাশি ঠাণ্ডা লাগা কমাতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে নিয়মিত মধু দেওয়া উচিত।
২৭। গলার স্বর যন্ত্রের জন্য – গলার স্বর যন্ত্রে বা স্বরনালীতে সংক্রমণ হলেও সেই ক্ষত দূর করতে নিয়ম মাফিক মধু সেবন করা যেতে পারে। তা ক্ষত নিরাময় করে। সংক্রমণ দূর করে।
২৮। তাপমাত্রা বাড়াতে – অনেক সময়ে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। কাঁপুনি দেয়। ইত্যাদি সমস্যায় অথবা শীতকালেও শরীরের আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ধরে রাখতে সাহায্য করে মধু।  
২৯। আর্দ্রতা বজায় রাখা – অনেক সময় নানান কারণে শরীর জলশূন্য হয়ে পড়ে। শরীরে জলের অভাব বোধ হয়। তার থেকে দেখা দেয় অন্যান্য অনেক সমস্যা।  এই জলশূন্যতা বা আর্দ্রতার অভাব দূর করতে মধু খুবই সাহায্য করে। কারণ এতে রয়েছে জলীয় উপাদানও।
৩০। ড্রেসিং করতে – ক্ষত স্থান সারাতেও মধুর উপকারিতা আছে। ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করতে মধুর ব্যবহার করা যেতে পারে।  
৩১। তারুণ্য ধরে রাখতে – মধু এমন একটি উপাদান যাতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ত্বকের উজ্জ্বল রং, টানটান ভাব ধরে রাখে। ফলে রিঙ্কেল পড়ে না। মধু তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
৩২। রূপচর্চায় – ত্বক টানটান চকচকে করতে মধু একটি বিশেষ উপকারী উপাদান হিসাবে বিবেচ্য হয়।
৩৩। চুলের স্বাস্থ্যে – শুধু ত্বক নয়। সৌন্দর্য বিদ্যায় চুলের বিশেষ যত্নেও মধুর উপকারিতার কথা বলা হয়। তাই চুলের যত্নেও ব্যবহার করা হয় মধু।
২২। হাড় ও দাঁতের গঠনে – মধুর মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ক্যালসিয়াম। এই ক্যালসিয়াম দাঁত, হাড়, চুলের গোড়া শক্ত রাখে, নখের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে, ভেঙে যাওয়া রোধ করে।