09/07/2025
আবুল মনসুর আহমেদকে প্রথম পড়তে গিয়া আমি অবাক হইছিলাম। দুইটা কারণে, এক—এত দারুণ একজন লেখককে এত দেরিতে পড়া; দুই—আদু ভাই গল্পটা উনার লেখা এইটা জানতে পারা। এমন না যে আবুল মনসুর আহমদের কথা শুনি নাই বা তার সম্পর্কে কমবেশি জানি না। কিন্তু কোনোভাবে তার লেখা পড়তে দেরি হয়ে গেছে। যেইটা আমার কাছে সমস্যাজনকই মনে হইল। আর আমাদের দেশে ক্লাস সেভেনে পড়ছেন অথচ আদু ভাই গল্প পড়েন নাই এমন মানুষ বোধহয় পাওয়া যাবে না। কিন্তু ক্লাস সেভেন পাশ করার ১ যুগ পর, গল্পের কথা মনে থাকলেও লেখক কে তা আর মনে নাই। এইটা কি আমার একার ক্ষেত্রেই হইছে, নাকি আরও অনেকেরই এমন হইছে আমি জানি না।
আদু ভাই গল্পটা আমরা যারা সাধারণভাবে পড়ছি, স্কুলে থাকতে, ওইটুকু বয়সে, এরপর আর যদি পড়ে না থাকি, তাহলে ধরতেই পারব না যে এই গল্পটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে গেছে। এমনকি আমরা যে আদু ভাইকে বলদ মনে করি সেইটাও ঠিক কি বেঠিক ‘আরেকটা মনোযোগী পাঠের’ আগে তা ধরতে পারার কথা না।
আদু ভাই যে বোকা ছিল, বা কিছুই বুঝত না ব্যাপারটা কিন্তু এমন না। গল্পটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
আদু ভাইয়ের প্রমোশন না পাওয়ার কারণ ৩টা। এক. সততা। দুই. বইয়ের টেক্সট আর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে না পারা। তিন. শিক্ষকদের অযোগ্যতা।
একটা উদাহরণ দেখা যাক। কথক যখন আদু ভাইয়ের প্রতি দরদ অনুভব করে তাকে প্রমোশন পাইয়া দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়া স্যারদের বাড়িতে বাড়িতে গেলেন, তখন মৌলবী স্যারের কাছে প্রথমে গিয়া দেখলেন, ফারসি পরীক্ষার খাতায় ফারসিতে কিছু লেখেন নাই আদু ভাই; ‘তার বদলে ঠাস-বুননে বাংলা হরফে অনেক কিছু লেখা আছে।’ লেখকের ভাষায়, ‘কৌতূহল-বশে পড়ে দেখলাম: এই বঙ্গদেশে ফারসি ভাষা আমদানির অনাবশ্যকতা ও ছেলেদের উহা শিখাবার চেষ্টার মূর্খতা সম্বন্ধে আদু ভাই যুক্তিপূর্ণ একটি ‘থিসিস’ লিখে ফেলেছেন।’
তো যেই লোক প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়া এইরকম চিন্তা করতে পারে, এবং সেই সম্পর্কে নিজের ‘যুক্তিপূর্ণ’ মতামত লিখতে পারে, তাকে আর যাইহোক অযোগ্য বা ‘আদু ভাই’ অথবা বলদ মনে করার আগে দুইবার ভাবা দরকার। আমার মনে হয় এ জিনিসটা আমরা সবাই মিস করে যাই।
মৌলবী স্যার যদি মনে করে থাকেন আদু ভাইয়ের চিন্তা ভুল, উনি কি তা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন? আমার ধারণা করেন নাই। কারণ, ওই যে, আদু ভাই যে ভিন্নরকম চিন্তা করতেন, সেই চিন্তা ধরার মতো বা পাত্তা দেবার মতো মনে করেন নাই শিক্ষকরা।
তো আমার কাছে মনে হইছে, আদু ভাই গল্পটা যে পড়ছে, মনোযোগ দিয়া অথবা মনোযোগ ছাড়াই তার কাছে যেমন এই গল্পটা অবিস্মরণীয়, আবুল মনসুর আহমদ যে পড়ছে, সে যদি মোটামুটি বুঝবান হয়, তাহলে এই লেখকটাও অবিস্মরণীয়ই হয়ে থাকার কথা।
কিন্তু আবুল মনসুর আহমদ তো শুধুই আদু ভাই গল্পের লেখক না। আদু ভাই গল্পের থেকেও উনার আরও ভালো লেখা আছে, যারা ফুড কনফারেন্স পড়ছেন, বা গালিভরের সফরনামা পড়ছেন, অথবা জমিদারি উচ্ছেদ পড়ছেন, তারা হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন। তবে মনসুর আহমদ বেশি আলোচিত ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটার জন্য। এইটা উনার জন্য ভালো না খারাপ সেইটা নিয়া আমি কিছু বলব না। তবে উনার গল্প যে বাংলা সাহিত্যের জন্য একটা বিরাট ঘটনা সেইটা বলতে চাই।
আমার পাঠে বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক স্যাটায়ারে আবুল মনসুর আহমদ এখন পর্যন্ত সেরা লেখক। তার আগে পড়ে কেউ আর তার মতো এমন তীব্র ব্যঙ্গাত্মক কিন্তু সমাজকল্যাণকর গল্প আর লেখেন নাই। আর উনার শ্রেষ্ঠ স্যাটায়ারগুলি শুরুর জীবনে লেখা, যখন তিনি সংবাদপত্রে কাজ করতেন আর সবে রাজনীতিতে নাম লেখাইছেন। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে পালনের সময়ে গালিভরের সফরনামা বইটা লিখছেন। এবং এই গল্পটা দারুণ একটা জিনিস।
আবুল মনসুর আহমদের স্যাটায়ারকে আত্মসমালোচনা বলতে আমার কোনো সমস্যা নাই। স্যাটায়ারের একটা বেসিক বিষয় হইতেছে মানুষের স্টুপিডিটি নিয়া হাসি ঠাট্টা ব্যঙ্গ করার পাশাপাশি ভুলগুলি ধরা এবং সেইখান থেকে শিক্ষা নেওয়া যে এই জিনিস যাতে আর না হয়। আবুল মনসুর আহমদের রচনার প্রধান একটা লক্ষণ হইতেছে নিজ জাতির অনৈতিক কর্মকাণ্ড, অজ্ঞতা, ভণ্ডামি নিয়া ব্যঙ্গ করা। কিন্তু দূর থেকে তাকায়া দেখলে দেখা যাবে, লেখক মনসুর কিন্তু সেই জাতির ভেতরেই অন্তর্ভুক্ত। এইসব ব্যঙ্গাত্মক গল্পগুলি দিয়া তার মেসেজটা হইতেছে, এইযে এই এই জিনিসগুলিকে মার্ক করা দরকার, এবং এইখান থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। ফলে জাতিবিদ্বেষী বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠির প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ আছে এইটা বলার সুযোগ আসলে থাকে না।
বিশেষ করে যখন তিনি লেখেন—
“ছোটলোকগুলোর উৎপাত থেকেও বাঁচা গেল। এবার আমরা শেরে-বাঙলা সিংগীয়-বাঙলা হাতিয়ে-বাঙলা ও মহিষে-বাঙলা খুব আরামসে হেঁ হেঁ হেঁ...
সবাই সে হাসিতে যোগ দিলেন। শুধু ছাগলে-বাঙলাটা দাড়ি নেড়ে বললেন: তা হল বটে, কিন্তু শেরে-বাঙলা হাতীয়ে বাঙলা প্রভৃতি শুধু জানোয়ারে বাঙলাতেই আমরা বেঁচে রইলাম। মানুষে বাঙলারা যে সবাই মরে গেল।
সে কথায় কেউ কান দিলেন না। বরঞ্চ সকলে সমস্বরে আসমান ফাটিয়ে জয়ধ্বনি করলেন: জানোয়ারে-বাঙলা জিন্দাবাদ।
গড়ের মাঠের অপর পাশের ফোর্টের দিক থেকে প্রতিধ্বনি হল: মানুষে-বাঙলা মুর্দাবাদ।” [ফুড কনফারেন্স]
তখন আমরা তার আত্মার কান্না আর নিষ্ফল ক্রোধ, অসহায় আত্মার আত্মসমর্পণ কিংবা ভাষার বিদ্রুপাত্মক প্রতিবাদ দেখে ফেলি।
অথবা বাওএনের দেশে যখন সবাই উল্টা দিকে চলে, যখন প্রকৃতির সভ্যতার সবকিছুই এখানে বিপরীত দেখতে পায়া উনি লেখেন—
“আমি: এ সব যে আপনারা করেন, তাতে আপনেরার শাসনতন্ত্রের বিধান ভাগ হয় নাই?
ওযিরে-আযম: (হো হো করিয়) শাসনতন্ত্র? কিসের শাসনতন্ত্র?
আমি: (বিস্ময়ে চোখের ভুরু কুঞ্চিত করিয়া) কেন, আপনেরার দেশে কোন শাসনতন্ত্র নাই?
ওযিরে-আযম: তুমি কি পাগল হইয়াছ? না আমরারে পাগল ঠাওরাইয়াছ? আমরা শাসনতন্ত্র রচনা করিয়া কি নিজেরার গলার ফাঁসি তৈয়ার করিব? তা আমরা এতদিনেও করি নাই। ভবিষ্যতেও করিব না। শুধু আমরাই ইচ্ছামতো দেশ শাসন করিব, এটাই এ দেশের শাসনতন্ত্র! এটাই এ দেশের আইন।
আমি বুঝিলাম, হাঁ, বুদ্ধিমানের দেশ বটে। আল্লাহ্এ-দেশবাসীকে কদে ছোট করিয়াছেন বটে, কিন্ত বুদ্ধিতে বড় করিয়াছেন। এদের তালুর চুল হইতে পায়ের নখ পর্যন্ত সবটাই মগজে ভরা। এরা দেহে বাউন হইলেও মনে এরা দেও।
এদেশেই স্থায়ীভাবে বসবাস করা আমি সাব্যস্ত করিলাম। আমার দেশ ভ্রমণের বাতিক স্বায়ীভাবে সারিয়া গেল।
আমি এখন হইতে গৃহী হইলাম।” [গালিভরের সফরনামা]
তখন তার দুঃখটা আমরা বুঝি। আমরা জানি এই দেশটা আমাদের এবং এইখানে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আমাদের আর করার কিছু নাই। করার থাকলেই বা করব কেন?
আবুল মনসুর আহমদের গল্পগুলি প্রকাশের ৭/৮টা দশক পার করে আসার পর, ২০২৩ সালে একজন পাঠক হিসেবে যখন পড়লাম, মনে প্রশ্ন আসলো, এত বছর পর বাঙালি জাতির চরিত্র রাজনীতি ধর্ম ও তাদের ভাগ্যের গল্পে কতটুকু পরিবর্তন হলো? আমরা কতটুকু বদলাইলাম? আমাদের শাসকরা কুত্তায়ে-বাঙলা শুওরে-বাঙলার কাতার থেকে আগায়া গিয়া মানুষেবাঙলার কাতারে দাঁড়াইতে পারল কি?
উত্থাপিত প্রশ্নগুলির উত্তর আর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্যাটায়ারে আবুল মনসুর আহমদের অবদান কতটুকু তার খতিয়ান পাওয়া যাবে এই সংকলনের গল্পগুলি পড়লে।
আমাদের এই দমবন্ধ করা সময়ে আবুল মনসুর আহমদের এই গল্পগুলি কিছুটা হইলেও তৃপ্তি দিবে, যেহেতু আমাদের রসিকতা করার, ঠাট্টা করার, স্বৈরাচারের অবৈধ ক্ষমতার অসারত্বকে ব্যঙ্গ করার সকল মাধ্যমকে ফাঁসির আসামী বানানো হইছে। ফলে নিজেদের বাজে সময় আর বঞ্চনার কালটাকে কষে উপভোগ করার বদলে ৭০/৮০ বছরের পুরাতন স্যাটায়ারেই স্বাদ মিটাইতে হইতেছে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, লেখকের নাম বাদ দিয়া যদি সময় আর কিছু পুরাতন শব্দ বদলে নতুন শব্দ বসায়া দেওয়া হয়, আপনি ধরতেই পারবেন না যে এই গল্পগুলি আজ থেকে কয়েক যুগ আগে লেখা হইছে।
এতটাই প্রাসঙ্গিক, আর এতটাই চেনা গল্প যে, ৭০/৮০ বছর আগেকার জঘন্য সমাজ রাজনীতি আর দেশ যেমন ছিল আল্লার অশেষ দয়ায় ঠিক তেমনই আছে। কেয়ামতের আগ পর্যন্ত এই দেশ আর জাতির কোনো পরিবর্তন হবে কিনা তা নিয়া সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ আছে। ফলে আবুল মনসুর আহমদ আমাদের জন্য সবসময়ই প্রাসঙ্গিক।
হুসাইন হানিফ
নভেম্বর, ২০২৩
..
আদুভাই
ফুড কনফারেন্স
গো-দেওতা কা দেশ
গালিভরের সফরনামা
রিলিফ ওয়ার্ক
জমিদারি উচ্ছেদ
..
পেইজ ৭২
দাম ১৫০ টাকা
পেপারব্যাক