27/09/2025
আরব উপদ্বীপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নাজদ অঞ্চল। ১৭৪০ সালের দিকে এই অঞ্চলের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন মুহাম্মদ ইবনে সৌদ নামে এক স্থানীয় আমির। তাঁরই এক সরাসরি বংশধর ১৯৩০ সালে এসে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলের সীমানা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করেন। ইবনে সৌদের পরিবারের নামে দখলকৃত এই অঞ্চলটির নতুন নাম দেওয়া হয় সৌদি আরব। কিন্তু, কোনো পরিবার যদি নিজেদের নামে একটি রাষ্ট্রের নাম রাখে, তাহলে যেসব মানুষ সেই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের কী হবে? যেমন, ব্রাজিলের প্রতিটি নাগরিকই ব্রাজিলীয় পরিচয়ের অংশ এবং আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। কিন্তু সৌদি আরবের প্রতিটি নাগরিক সৌদ পরিবারের সদস্য নয়, আর তাই সবার মর্যাদাও এক নয়। আজকে যদি আমি যুক্তরাজ্যের ক্ষমতা দখল করি, আর তারপর যুক্তরাজ্য নাম বদলে মার্শল্যান্ড রেখে দিই, কিছু মানুষ হয়তো সেটা মেনেও নেবে। আবার অনেকেই হয়তো বলবে, নামটা দেশের জলবায়ুর সঙ্গে বেশ মানানসই। কিন্তু নতুন সেই দেশের প্রতি তাদের আসলে ঠিক কতটা আনুগত্য থাকবে? দেশ তো আসলে তখন আমি নিজেই। আমার প্রতিই নাগরিকদের আনুগত্য চাইছি আমি।
আসলে রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের পারিবারিক পরিচয় যুক্ত করার ফলে সৌদি রাজপরিবারের জন্য বেশ বড় একটি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বিচার করলে সৌদ বংশ এটা দাবী করতে পারে যে, নাজদের কিছু অংশ তাদের নামে পরিচিত হোক। কিন্তু, তাই বলে গোটা আরব উপদ্বীপ? এটা অনেক বড় দাবি। এমনকি আজকের সৌদি আরব রাষ্ট্রের বিশাল একটি অংশ মাত্র এক শতাব্দী আগেও সৌদ পরিবারের শাসনের অধীনে ছিল না। ১২০ বছর আগেও যদি কেউ শাম্মার গোত্রের কাছে গিয়ে বলত যে, তাদের স্বাধীন আমিরাত একদিন সৌদ সাম্রাজ্যের অধীনে একটি সাধারণ প্রদেশে পরিণত হবে—তার পরের মুহুর্তেই হয়তো সবার হাতে তলোয়ার উঠে আসত। তাছাড়া, পারস্য উপসাগরের কাছাকাছি অঞ্চলে বসবাসকারী শিয়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সুন্নি ওয়াহাবিদের দ্বন্দ্ব চলে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। শিয়ারা কখনো কল্পনাই করেনি যে, তারা একদিন সুন্নি ওয়াহাবি মৌলবাদী সৌদি শাসকের অধীনে চলে যাবে।
তবে তার মানে আবার এটা নয় যে আধুনিক সৌদি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারবে না। দেশটিতে যে আজও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা রয়ে গেছে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা রয়ে গেছে, এটি তার একটা ব্যাখ্যা মাত্র। সৌদি রাজপরিবার যদি ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, তাহলে একদিকে যেমন তাদের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে, অন্যদিকে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর আনুগত্যও নিশ্চিত করতে হবে।
এক শতাব্দী আগেও এই অঞ্চলে বাস করত মাত্র ২ মিলিয়ন মানুষ। এদের বেশিরভাগই ছিল যাযাবর। সেই অঞ্চলটিই এখন ৩৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি রাষ্ট্র। আরব উপদ্বীপের বড় অংশ জুড়ে বিস্তৃত এই রাষ্ট্র মূলত একটা বিশাল মরুভূমি। তেল আর বালি ছাড়া এখনো দেশটিতে তেমন কিছুই নেই। তবে, এই জ্বালানি সম্পদই সৌদি আরবকে বিশ শতকের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। পরিণত করেছে বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে। সৌদি আরব দেশটির প্রধান মিত্র ও রক্ষক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্কের ভিত্তিই হলো এই তেল। এই সম্পদ সৌদি আরবকে বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক করেছে। আর সেই ঐশ্বর্যের জোরেই তেলের প্রবল তৃষ্ণায় কাতর এই পৃথিবীতে টিকে আছে দেশটি। অবশ্য, সৌদি ক্ষমতা কাঠামোর একটি অংশ ইসলামি মৌলবাদের চরম সহিংস রূপ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি করে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে পরিচিত সৌদি নাগরিক কোনো বাদশাহ বা তেল ব্যবসায়ী বিলিয়নিয়ার নন। তিনি একজন সন্ত্রাসী, যার নাম ওসামা বিন লাদেন।
কিন্তু সৌদি আরবের সামনে এখন বেশ বড় একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সমগ্র বিশ্ব তেলের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। তাহলে এই রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? দেশটির জনসংখ্যার একটা অংশ অস্থির, চারপাশে রয়েছে শত্রুর উপস্থিতি, আর অন্যদিকে শাসকের শাসনের বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে শাসকদের করণীয় কী? একমাত্র পথ হলো আধুনিকায়ন। প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় টিকে থাকতে হবে। তবে, এই যাত্রা খুব একটা সহজ হবে না। সৌদি আরবের এই প্রচেষ্টা সফল হবে নাকি ব্যর্থ হবে, তার ফলাফল শুধু এই দেশটিকেই নয়—বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং বাকি বিশ্বকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করবে।
সৌদি আরব দেশটি গড়ে উঠেছে বিংশ শতকে—আধুনিক পরিবহন ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্যে। তবে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখনো দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে নানারকম বৈচিত্র্য রয়ে গেছে। কয়েক দশক আগেও দেশটির বিশাল একটা অংশ বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। সৌদি আরব হলো পৃথিবীর বৃহত্তম নদীবিহীন দেশ। দেশটির অভ্যন্তরভাগ জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে দুইটি বিশাল মরুভূমি। উত্তর দিকে রয়েছে ‘আন-নাফুদ’ মরুভূমি, যা আবার একটা সরু বালুময় করিডোর দিয়ে সংযুক্ত হয়েছে ‘রুব আল-খালি’ মরুভূমির সঙ্গে। রুব আল খালি অর্থ ‘শূন্য প্রান্তর’। এটি হলো পৃথিবীর সবথেকে বড় অবিচ্ছিন্ন বালিময় অঞ্চল। এই ভয়ংকর নির্জন মরুভূমিতে টিকে থাকতে পারে শুধু অল্প কিছু যাযাবর বেদুইন। তবে বেদুইনদের কাছে মরুভূমিটির নাম ‘আল-রামলাহ’, অর্থাৎ ‘বালু’। এই বিরানভূমি আয়তনে ফ্রান্সের চেয়েও বড়। এখানে বালিয়াড়িগুলো ২৫০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে শুরু হয়ে সৌদি আরব ও ওমান পার হয়ে ইয়েমেন পর্যন্ত এই মরুভূমির বিস্তার। গ্রীষ্মকালে এই মরুভূমির তাপমাত্রা এমনকি ছায়াতেও ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। যদিও ছায়া বলতে আসলে এই মরুতে তেমন কিছুই নেই। আবার শীতকালে রাতের বেলায় এই মরুভূমিতে অনুভূত হয় তীব্র কনকনে ঠান্ডা। আজকের এই আধুনিক যুগে এসেও খুব কম মানুষই এই মরুভূমির গভীরে প্রবেশ করে। ফলে, এর বড় অংশই এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। জানা যায়, এই অঞ্চলের বালির নিচে নাকি বিপুল পরিমাণ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিম্নমুখী। ফলে এই সম্পদকে কাজে লাগানো লাভজনক মনে করা হচ্ছে না।
আটটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের স্থলসীমান্ত রয়েছে। দেশটির উত্তরে রয়েছে জর্ডান, ইরাক ও কুয়েত। দেশটির পূর্ব উপকূল দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত হয়ে বাহরাইন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে গেছে। এই ছয়টি দেশ পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত। দক্ষিণে রয়েছে ওমান ও ইয়েমেন। এর মধ্যে ইয়েমেনের সীমান্তই সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সবচেয়ে অস্থির। সৌদি আরবের দক্ষিণাঞ্চলকে স্থলভিত্তিক হুমকি থেকে রক্ষা করার জন্য রুব আল খালি মরুভূমি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে। কিন্তু একইসঙ্গে দক্ষিণের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করাও কঠিন করে তোলে এই বিশাল মরুভূমি। এই বিশাল বালির সমুদ্র পাড়ি দেওয়া একসময় দক্ষিণ মেরু অতিক্রম করার মতোই কঠিন বলে মনে করা হতো। এই মরুভূমিতে প্রথম নথিবদ্ধ অভিযানটি মাত্র এক শতাব্দীরও কম সময় আগের ঘটনা। ১৯৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ অভিযাত্রী বারট্রাম থমাস বেদুইন ট্রাইবালদের সঙ্গে নিয়ে ওমান উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করেন। ১,৩০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি কাতারে পৌঁছান। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মরুভূমির বুকে যাতায়াত কিছুটা সহজ হয়েছে। এমনকি ২০১৮ সালে ওমান থেকে মরুভূমি পেরিয়ে সৌদি রাজধানী রিয়াদ পর্যন্ত একটি মহাসড়কও চালু করা হয়েছে। আপনি যদি এই পথ ধরে গাড়ি চালানোর কথা ভাবেন, তাহলে থমাস বা তার সঙ্গীদের মতো দুর্ধর্ষ অভিযাত্রী হতে হবে না। তবে একটা ব্যাপার মাথায় রাখা জরুরি—এই পথে কোথাও কোনো সার্ভিস স্টেশন নেই! না আছে তেল নেওয়ার সুযোগ, না আছে গাড়ি খারাপ হলে মেরামতের সুযোগ।
সৌদি আরবের বর্তমান জনবসতির কাঠামো বোঝার জন্য প্রাচীন বাণিজ্যপথ ও জলবায়ুর প্রভাব জানা গুরুত্বপূর্ণ। ভূগোলের প্রভাবেই এই অঞ্চলের প্রাচীন বাণিজ্য পথগুলো গঠিত হয়েছে। সৌদি আরবের সমস্ত উঁচু অঞ্চল মূলত দেশটির পশ্চিমাংশে অবস্থিত। লোহিত সাগরের সৌদি উপকূলজুড়ে প্রায় সমান্তরালভাবে সারি সারি পাহাড় ও পর্বতমালা দেখা যায়। এই অঞ্চলের উপকূলবর্তী সমভূমি তুলনামূলক সরু। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উপকূলীয় শহর জেদ্দা সমতল ভূমিতে অবস্থিত। কিন্তু মাত্র ৬০ কিলোমিটার ভেতরে গেলেই পবিত্র মক্কা নগরী। আর মক্কার অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৭৭ মিটার উঁচুতে। মক্কার আশেপাশের পাহাড়গুলোর মধ্যে কোনো কোনোটির উচ্চতা ১,৮৭৯ মিটার পর্যন্ত। এই উঁচু অঞ্চলগুলোর মধ্য দিয়ে একটি গিরিপথ চলে গেছে মদিনার দিকে। প্রাচীনকালের কাফেলাগুলোর জন্য এটি একটি প্রধান বাণিজ্যপথ হয়ে উঠেছিল। ওই সময় রুব আল খালি মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাতায়াত করা সম্ভব ছিল না। ফলে, আফ্রিকা ও লোহিত সাগরের সাথে পারস্য ও ভারতের বাণিজ্য মূলত এই তিনটি শহর—জেদ্দা, মক্কা ও মদিনার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হতো। দেশটির প্রধান জনবসতিগুলোও মূলত ভূ-প্রাকৃতিক কারণে এই অঞ্চলগুলোতে গড়ে উঠেছিল।
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ পর্বতমালা অবস্থিত দক্ষিণের ইয়েমেন-সংলগ্ন সীমান্তের কাছাকাছি। এই অঞ্চলের আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা। আর এই কারণে প্রাচীনকাল থেকেই এখানে জনবসতি গড়ে উঠেছে। সৌদি আরবের অধিকাংশ মানুষ দেশের পশ্চিম অংশে, বিশেষ করে মক্কা, মদিনা ও জেদ্দার আশপাশে বসবাস করে। তবে ইয়েমেন সীমান্তসংলগ্ন পার্বত্য অঞ্চল হলো দেশটির সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
উত্তর-পশ্চিমের হিজাজ বা অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল পার হয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত পুরোটাই সমতল অঞ্চল। সৌদি আরব মূলত সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। তবে এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শিয়া সংখ্যালঘুও রয়েছে। শিয়াদের বেশিরভাগই বসবাস করে পারস্য উপসাগর উপকূলের ইস্টার্ন প্রভিন্সে। এই শিয়ারা মূলত বাহারনা গোত্রের সদস্য। বাহারনা শব্দটি এসেছে বাহরাইন শব্দ থেকে। বাহরাইন শব্দটির মূল আরবি হচ্ছে ‘বাহর’ বা সমুদ্র। শব্দটির বহুবচন ‘বাহরাইন’ অর্থাৎ ‘দুই সমুদ্র’। ঐতিহাসিকভাবে বাহরাইন অঞ্চলে একদিকে যেমন ছিল মিঠা পানির উৎস, আর আরেকদিকে ছিল লবণাক্ত সমুদ্র। তাই এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল বাহরাইন। আর এই অঞ্চলের মানুষ হিসেবে তাদের নাম হয়েছে বাহারনা। এরা আরব উপকূলের প্রাচীন আরব অধিবাসী। কথা বলার জন্য এই মানুষগুলো বাহারনি আরবি উপভাষা ব্যবহার করে, যা সাধারণ খাড়ি আরবি থেকে কিছুটা ভিন্ন।
সৌদি আরবের এই শিয়াপ্রধান অঞ্চলটি বিদেশি শক্তির অনুপ্রবেশ বা নাশকতার জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই অঞ্চলে তেল ও গ্যাসের শত শত পাইপলাইন থাকায় ধ্বংসাত্মক নাশকতা ঘটানোও খুব সহজ। ইস্টার্ন প্রভিন্সকে ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর মাধ্যমে শিয়া-অধ্যুষিত বাহরাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। বাহরাইনের শাসক সুন্নি হলেও, বাহারনা শিয়ারাই দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯৮৬ সালে সৌদি সরকার সেতুটি নির্মাণ করেছিল। সৌদি সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী এটি নির্মাণ করা হয়েছে মূলত যাতায়াত, পর্যটন ও বাণিজ্যের জন্য। কিন্তু অপ্রকাশ্য বাস্তবতা হলো, বাহরাইনে সুন্নি শাসকদের বিরুদ্ধে যদি ওই দেশের শিয়াদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে এই সেতু ব্যবহার করে সৌদি ট্যাংক দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারবে। শিয়া জনগোষ্ঠীর আরেকটি বড় অংশ রয়েছে ইয়েমেনের সীমান্তবর্তী এলাকায়। এছাড়া মক্কা ও মদিনাতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়া বসবাস করে।
সৌদি আরবের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে রাজধানী রিয়াদ এবং নাজদ অঞ্চল। রিয়াদ দেশের বৃহত্তম শহর এবং রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হলেও অন্যান্য প্রধান জনবসতি থেকে এটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা রিয়াদের ইসলাম চর্চাকে তুলনামূলকভাবে আরও কট্টর করে তুলেছে, যা এমনকি বেশিরভাগ সৌদি জনগণের কাছেও অতিরিক্ত কঠোর মনে হয়। অতি প্রাচীনকালে ‘মরুভূমির জাহাজ’ খ্যাত উটের আবির্ভাব মরুভূমির বুকে মানুষের চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছিল। ফলে ব্যবসায়ীরা মক্কা ও মদিনার মতো ছোট ছোট মরূদ্যান ভিত্তিক শহরে সহজেই আসা-যাওয়া করতে পারত। তবে সৌদ পরিবার যেখানে বাস করত, অর্থাৎ সেই নাজদ অঞ্চলকে পশ্চিম দিক থেকে আলাদা করে রেখেছিল হিজাজ পর্বতমালা। আর বাকি তিনদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল তিনটি বিশাল মরুভূমি। নাজদ কার্যত ছিল একটি অনুন্নত মরু অঞ্চল। এখানে পানির তেমন কোনো উৎস ছিল না। আসলে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউই যেত না নাজদের আশেপাশে। তবে এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল আরব উপদ্বীপের পূর্ব প্রান্ত থেকে মক্কায় যাওয়া হজ্বযাত্রীরা। হজ্বযাত্রীরা ছাড়া অধিকাংশ মানুষ নাজদের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে বিকল্প সহজ পথ বেছে নিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহির্বিশ্ব নাজদকে একরকম উপেক্ষাই করে এসেছে।
নাজদ অঞ্চলের ইতিহাসে একটা পরিবর্তন আসে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে এসে। সে সময় আল সৌদ বংশের কয়েকশো উচ্চাভিলাষী সদস্য আদ-দিরিয়াহ নামক এক মরূদ্যানের কাছে কয়েকটি খেজুর বাগানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর এই মরূদ্যানকে ঘিরেই তারা বসতি স্থাপন করে এবং সৌদদের নেতা মুহাম্মদ ইবনে আল সৌদ নিজেকে আমির ঘোষণা করেন। মরুদ্যান থেকে একটু দূরেই ছিল হাজর নামে একটা প্রাচীন শহর। ইবনে সৌদ শহরটির নাম বদলে রাখেন রিয়াদ। এরপর সেখানে তিনি গড়ে তোলেন একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র। শহরটি ধীরে ধীরে নাজদ অঞ্চলের রাজনৈতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। যদি কখনো আপনার রিয়াদে যাওয়ার সুযোগ হয়, তাহলে মরুভূমির মধ্য দিয়ে ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই স্থানটি দেখে আসা আপনার জন্য একটা মূল্যবান অভিজ্ঞতা হতে পারে। শহরটি বেশ উপভোগ্য। তাছাড়া সৌদি রাষ্ট্রের জন্মস্থান হওয়ায় শহরটির রোমাঞ্চকর একটি দিকও আছে। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত আদ-দিরিয়াহ এখনো সেই অতীতের স্মৃতি ধরে রেখেছে। এখানে গেলে আপনি দেখতে পাবেন কাদামাটি দিয়ে তৈরি শহরের প্রাচীরের মধ্যে আধভাঙা ভবন, নতুন করে বানানো মাটির ঘর এবং কাদামাটির ইঁটে তৈরি চারতলা রাজপ্রাসাদ। সব মিলিয়ে জটিল গোলকধাঁধার মতো সরু গলিপথে ঘেরা ঐতিহাসিক এক শহর এটি।
সৌদ পরিবারের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ওয়াহাবি বংশের সঙ্গে একটি কৌশলগত জোট গড়ে তোলে তারা। এই জোট আজও বহাল রয়েছে। ধর্মীয় পণ্ডিত মুহাম্মদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহাব ১৭৪৪ সালে মুহাম্মদ ইবনে সৌদের কাছে আনুগত্যের শপথ নেন। ইবনে আল-ওয়াহাব বিশ্বাস করতেন, সাধারণ মুসলিমদের অবশ্যই নিরঙ্কুশ আনুগত্যসহ একজন মুসলিম শাসকের অধীনে থাকতে হবে। আর এর বিনিময়ে সেই শাসককে দেশ পরিচালনা করতে হবে কঠোর ইসলামি নীতির ভিত্তিতে। খ্রিস্টানদের মতো ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে রাখার কোনো ঐতিহ্যগত কলাকৌশল ইসলামে নেই। এই সমঝোতার ভিত্তিও ছিল মূলত ধর্ম ও রাজনীতির একাত্মকরণ। এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে সৌদ পরিবারের হাতে, আর ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করবে ওয়াহাবিরা। এখনও পর্যন্ত মূলত এই কাঠামোই বজায় আছে। তবে মাঝেমধ্যেই সৌদি আরবের এই দুই স্তম্ভ একে অপরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চালায়।
সৌদির বেশিরভাগ নাগরিক সুন্নি মুসলিম হলেও সবাই ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নাজদের উত্তরাঞ্চলে একসময় সৌদ পরিবারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শাম্মার গোত্রের শাসন ছিল, সেখানে সুন্নি মতবাদেরই তুলনামূলকভাবে কম কট্টর একটি সংস্করণ প্রচলিত আছে। একইভাবে, লোহিত সাগরের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর মানুষ নিজেদেরকে তুলনামূলকভাবে উদার মনে করে। বহির্বিশ্বের প্রতিও তাদের মনোভাব বেশ খোলামেলা। তাদের মনস্তত্ত্ব ওয়াহাবি মতবাদের মূল নীতিগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা। অর্থাৎ, আধুনিক বিশ্বের অন্যতম নিয়ন্ত্রিত সমাজ হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে সৌদি আরবের সব মানুষের পূর্ণ সম্মতি ছিল না। পরবর্তী সময়েও অনেকেই এই কঠোর ধর্মীয় কাঠামো ভেঙে আরও স্বাধীন সমাজ চেয়েছে।
আজকের যে সৌদি সমাজ আমরা দেখি সেটা তৈরি করা হয়েছে রীতিমত পরিকল্পনা করে। সৌদ–ওয়াহাবি জোটকে আরও দৃঢ় করতে ইবনে সৌদের জ্যেষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে ইবনে আবদ আল-ওয়াহাবের কন্যার বিয়ে দেওয়া হয়। আল সৌদ প্রকাশ্যে ওয়াহাবি মতবাদকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, ওয়াহাবিরা সৌদদের সমর্থন জানায় এবং এরপর তারা একসঙ্গে আরব উপদ্বীপ জয়ের অভিযানে নামে। ১৭৬৫ সালের মধ্যে তারা পুরো নাজদ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং চারদিকে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করতে থাকে। খুব শিগগিরই পবিত্র মক্কা ও মদিনা শহর তাদের দখলে চলে আসে। এই দুই শহরে প্রবেশ করেই তারা বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। বিশেষভাবে আঘাত হানে শিয়া সংখ্যালঘুদের মাজার ও কবরস্থানের ওপর। ওয়াহাবিরা শিয়াদের ‘রাফিদা’ বলে উল্লেখ করত। রাফিদা শব্দের অর্থ ‘প্রত্যাখ্যানকারী’। আরবি ভাষায় এটি একটি অবমাননামূলক শব্দ, যা একবিংশ শতকেও ওয়াহাবিরা ব্যবহার করে।
নাজদ অঞ্চল থেকে শুরু করে এই ক্ষমতা বিস্তারের সময়কালকে ‘প্রথম সৌদি রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আদি এই রাষ্ট্র একসময় বর্তমান সৌদি আরবের বেশিরভাগ অংশসহ ওমানের উত্তরাঞ্চল, কাতার, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কিছু অংশও দখল করে নিয়েছিল। তবে ১৮১৮ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্যের সুলতান মিশর থেকে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে হিজাজ অঞ্চল দখলমুক্ত করেন। সেই সেনাবাহিনী এরপর নাজদের দিকে অগ্রসর হয়ে আদ-দিরিয়াহ দখল করে নেয় এবং শহরটির বড় অংশ ধ্বংস করে দেয়। এরপর স্বঘোষিত সুলতান আবদুল্লাহ আল সৌদকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় ইস্তাম্বুলে। সেখানে প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ করা হয় তাকে। ফলে আদি সৌদি রাষ্ট্রের পতন ঘটে।
অনেকেই পাওয়ার অব জিওগ্রাফি বইটির কিছু অংশ পড়ে দেখতে চেয়েছিলেন, তাদের জন্য সৌদি আরব অধ্যায়ের কিছু অংশ এখানে দেওয়া হলো।