পুঁথি

পুঁথি পুঁথি মূলত ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, মিথলজি, অর্থনীতি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নন ফিকশন বই এবং বইয়ের সামারি প্রকাশ করে।
(1)

চিপ ওয়ার চলে এসেছে, যারা প্রি-অর্ডার করেছিলেন তাদের বই আজকেই কুরিয়ারে যাচ্ছে, আগামীকাল পেয়ে যাবেন। যারা অফিসের ঠিকানা দি...
04/09/2025

চিপ ওয়ার চলে এসেছে, যারা প্রি-অর্ডার করেছিলেন তাদের বই আজকেই কুরিয়ারে যাচ্ছে, আগামীকাল পেয়ে যাবেন। যারা অফিসের ঠিকানা দিয়েছেন তারা রবিবার বই পেয়ে যাবেন আশা করছি।

আজ থেকে প্রায় প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ার মানুষের মুখে মুখে একটি ভয়ের গল্প প্রচলিত ছিল। একদিন মেসোপটেমিয়ার শহর...
03/09/2025

আজ থেকে প্রায় প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ার মানুষের মুখে মুখে একটি ভয়ের গল্প প্রচলিত ছিল। একদিন মেসোপটেমিয়ার শহরগুলোর আকাশ কালো করে নামল এক ভয়ংকর ঝড়। বজ্রপাতের শব্দে রাত-দিনের ভেদাভেদ মুছে গেল। এমন ঝড় বৃষ্টি মেসোপটেমিয়ার মানুষ আগে কখনো দেখেনি। পুরোহিতরা জানালেন, দেবতারা নাকি মানুষের অহংকারে ভীষণ রুষ্ট হয়েছে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পৃথিবীকে ধুয়ে-মুছে ফেলবেন জলোচ্ছ্বাস পাঠিয়ে। নগরের বৃদ্ধদের মুখে গল্প শোনা যায়, একটানা ছয় দিন ছয় রাত হয়েছিল সেই ভয়ানক বৃষ্টি। প্রবল হাওয়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল নদীগুলো। ঘর-বাড়ি, শস্যভাণ্ডার, মন্দির যা ছিল সবই চলে গিয়েছিল পানির তলায়।

এই বিপর্যয়ের ভেতর কেউ একজন বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয় খুঁজছিলেন। তার নাম উৎনাপিশ্তিম। দেবতা এয়া গোপনে তাকে সতর্ক করে দিলেন।

‘একটি বিশাল নৌকা বানাও, আর সেই নৌকাতে তোমার পরিবার-পরিজন আর সব ধরনের জীবজন্তু তুলে ফেল।’

দিনরাত পরিশ্রম করে তৈরি করা হলো বহুকুঠুরি বিশিষ্ট একটা বিশাল নৌকা। এই নৌকার ভেতরে নেওয়া হলো নানা রকম ফসলের বীজ, আর নানা জাতের পশু-পাখি। চারিদিকের সবকিছু যখন পানির নিচে তলিয়ে গেছে, তখন উৎনাপিশ্তিম আর তার পরিবার ভেসে ছিলেন সেই বিশাল কাঠের নৌকাতে। সপ্তম দিনে এসে সেই ভয়াবহ ঝড় থামল। নৌকাটি এসে আছড়ে পড়ল এক পাহাড়ের চূড়ায়। ধূপ-ধুনোয় উৎসর্গ দিলেন উৎপিশ্তিম। দেবতারা শান্ত হলেন।

এই ভয়াবহ বন্যা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন শুধু উৎপিশ্তিম ও তার পরিবার। প্লাবনের পর দেবতারা তাকে ও তার স্ত্রীকে বিশেষ কৃপা করে অমরত্ব দান করেন।

মহাপ্লাবনের এই ঘটনার শত শত বছর পরে উরুকের রাজা হয়ে সিংহাসনে বসলেন ‘গিলগামেশ’।

গিলগামেশ উরুক নগরের রাজা হলেও তিনি পুরোপুরি মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন অর্ধ-দেবতা, অর্ধ-মানুষ। রাজা গিলগামেশ ছিলেন অসীম শক্তিশালী। কিন্তু দেবতাদের শক্তি পাওয়ার ফলে তার মনে এসেছিল এক অদম্য অহংকার। তিনি ছিলেন প্রজাদের কাছে ভীতিকর—কেউ তাকে প্রতিহত করতে সাহসও পেত না। গিলগামেশের এই অহংকারে খুশি ছিলেন না অনেক দেবতাই। ফলে সিদ্ধান্ত হলো, গিলগামেশের এই অহংকার ভাঙতে হবে। দেবতারা তার শক্তির লাগাম টানতে সৃষ্টি করলেন এক প্রতিদ্বন্দ্বী। একজন বুনো মানুষ। নাম তার এনকিদু। গিলগামেশ ছিলেন অহংকারী, তাই এনকিদুর শক্তির কথা জানার পরে তার প্রচণ্ড রাগ হলো। তিনি ভাবলেন এর শেষ দেখে ছাড়বেন। প্রথমে তাদের সংঘর্ষ হলো। দুইজন লড়াই করল রণক্ষেত্রে। ভীষণ সেই লড়াই। কিন্তু এখানে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। লড়াই শেষে গিলগামেশ আর এনকিদুর মধ্যে গড়ে উঠল এক দারুণ বন্ধুত্ব।

একদিন তারা দুই বন্ধু একসাথে বের হলো অভিযানে। সিডার অরণ্যে গিয়ে হত্যা করলেন দৈত্য হুম্বাবাকে। দেবী ইশতারের পাঠানো স্বর্গের ষাঁড়কেও পরাস্ত করল তারা দুই বন্ধু। কিন্তু দেবতাদের ক্রোধ থামল না। এবার গিলগামেশের পাশাপাশি শাস্তি নেমে এলো এনকিদুর উপরও। দীর্ঘ জ্বরে ভুগে ধীরে ধীরে তিনি ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। বন্ধুর মৃত্যু গিলগামেশের মন ভেঙে দিল। প্রথমবারের মতো তিনি নিজের ভেতরে অনুভব করলেন মৃত্যুর ভয়। তার হৃদয়ে গেঁথে গেল এক প্রশ্ন—“আমিও কি একদিন চলে যাব? আমার সমস্ত শক্তি, সমস্ত জয়, সবই কি একদিন ধূলিসাৎ হবে?”

এই ভয়ই তাকে ধাবিত করল অমরত্বের সন্ধানে। তিনি পাহাড় পেরোলেন, মরুভূমি অতিক্রম করলেন, পেরোলেন আকাশ-পাতালের অন্ধকার সুড়ঙ্গ। এভাবে চলতে চলতে এসে তিনি পৌঁছালেন সেই উৎপিশ্তিমের কাছে। অমরত্বের বর পেয়ে এখনো বেঁচে আছেন উৎপিশ্তিম।

উৎপিশ্তিম তাকে শোনালেন সেই ভয়াবহ প্লাবনের গল্প—কীভাবে দেবতারা মানুষকে ধ্বংস করতে বন্যা নামিয়েছিলেন, কীভাবে তিনি নৌকা বানিয়ে পরিবার ও প্রাণীদের বাঁচিয়েছিলেন, কীভাবে ছয় দিন ছয় রাতের ঝড় শেষে তার নৌকা এক পাহাড়ের কাঁধে এসে থেমেছিল, আর দেবতারা শেষে নিজেদের সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত হয়ে তাকে ও তার স্ত্রীকে অমরত্ব দান করেছিলেন।

গিলগামেশ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন তার সেই গল্প। গিলগামেশের মনের ভেতর আশা জেগে উঠল—“যদি উৎপিশ্তিম অমর হতে পারে, তবে আমিও পারব।” তিনি দেবতাদের পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন তিনি। একদিন তিনি এমন একটা উদ্ভিদের সন্ধান পেলেন, যা নাকি বৃদ্ধকে ফিরিয়ে দেয় যৌবন। কিন্তু ভাগ্য যেন তাকে ব্যঙ্গ করল—এক সাপ এসে উদ্ভিদটি ছিনিয়ে নিল, আর গিলগামেশ খালি হাতে ফিরে এলেন সেখান থেকে।

এই ব্যর্থতার পরও তার যাত্রা বৃথা হলো না। তিনি যখন উরুকে ফিরে এলেন, তখন তার আগের সেই বেপরোয়া স্বভাব ছিল না। তিনি দাঁড়ালেন শহরের উঁচু প্রাচীরের ওপর, তাকালেন তার নিজের হাতে গড়া নগরীর দিকে—দেয়াল, সেচব্যবস্থা, মন্দির, বাজার কত সুন্দর তার মাতৃভূমি। নিজের রাজত্বের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন: অমরত্ব কোনো বস্তু নয়, কোনো দেবতার দান নয়। অমরত্ব লুকিয়ে আছে মানুষের সৃষ্টি আর মানুষের কাজে।

গিলগামেশ বুঝলেন, মানুষের নিয়তি হলো জ্ঞান, শ্রম, আর মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে থাকা। আমরা চলে যাই, কিন্তু আমাদের শহর, আমাদের লেখা, আমাদের গান থেকে যায়। মহাকাব্যের শেষ সুরটা তাই গিলগামেশের বিজয়ের নয়, এক গভীর উপলব্ধির—আমরা যা বানাই, লিখি, বিলাই সেটাই আমাদের স্থায়িত্ব।

গিলগামেশের এই গল্প কয়েক হাজার বছর মানুষের কাছে অজানা থেকে গেছে। ১৮৪০ সালের দিকে এসে একবার ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইরাকের মরুভূমি খুঁড়ছিলেন। তখন তারা প্রচুর সংখক মাটির ফলক খুঁজে পেলেন। গ্রামবাসীদের অনেকেই এগুলোকে ভেবেছিল নিতান্তই সাধারণ পাথর। কেউ কেউ এগুলোকে গৃহস্থালির কাজেও ব্যবহার করত। কিন্তু গবেষকরা এই মাটির ফলকগুলো আবিষ্কার করার পর এই ফলকগুলোর গুরুত্ব প্রথমবারের মতো পুরোপুরি বোঝা গেল। এগুলোই হলো মানবসভ্যতার প্রাচীনতম লিখিত দলিল। ধুলোমাখা সেই ফলকগুলো আসলে ছিল পাঁচ হাজার বছর আগের মানুষের হাতের লেখা!

প্রথম আবিষ্কারের পর কেউই বুঝতে পারছিল না যে এগুলো ভাষা নাকি প্রতীক। তারা এগুলোর নাম দেন ‘কিউনিফর্ম’ লিপি। লাতিন ভাষায় cuneus মানে পেরেক আকৃতি, আর এই কারণেই এগুলোর এমন নামকরণ করা হয়। এই ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে মূল অগ্রগতি আসে পারস্যের পাহাড়ে দারিয়ুস মহারাজার খোদাই করা বেহিস্তুন শিলালিপি থেকে। এটি তিন ভাষায় লেখা ছিল—পুরোনো পারসিক, এলামাইট, আর আক্কাদীয় কিউনিফর্ম। অনেকটা ‘রোজেটা স্টোন’ এর মতো। অবশেষে ১৮৫০-এর দশকে প্রমাণিত হলো যে কিউনিফর্ম আসলেই ভাষা প্রকাশ করে—শুধু সংখ্যা বা প্রতীক নয়। এরপর ধীরে ধীরে হাজার হাজার মাটির ফলক পড়া সম্ভব হলো।

গিলগামেশের কাহিনী যখন উনিশ শতকে কিউনিফর্ম ট্যাবলেট থেকে অনুবাদ করা হলো, তখন সবাই ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। কারণ বাইবেলের নোয়ার নৌকা এবং মহাপ্লাবনের গল্প ইউরোপে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। এই দুই কাহিনীর মধ্যে এত অদ্ভুত মিল দেখে অনেকে বিস্মিত হয়ে বলল—“তাহলে নোয়ার কাহিনীর শিকড় আছে হয়তো এই প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মাটির ফলকে!”

কাদার ছোট ছোট ফলককে ভিজিয়ে তার উপর এক বিশেষ সরু কাঠি চাপ দিলেই তৈরি হয় পেরেকের মতো চিহ্ন। প্রথম দিকে এভাবে শুধু সংখ্যাই লেখা হতো। একটা দাগ মানে এক, দুটো দাগ মানে দুই। কিন্তু বাণিজ্য আর রাজনীতির জটিলতা যত বেড়েছে, মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্ম লিপিও তত উন্নত হয়েছে। শস্য আর গরুর হিসাব ছাড়িয়ে লেখা হতে লাগল কবিতা, প্রার্থনা, ভবিষ্যদ্বাণী এমনকি রাজাদের জয়যাত্রার গল্পও।

একটা ট্যাবলেটের মধ্যে পাওয়া গেছে বাজারের ঝগড়ার রেকর্ড। এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছে, তার পাঠানো তেলের পাত্র গন্তব্যে পৌঁছায়নি। কিউনিফর্ম ট্যাবলেটে সেই ঝগড়ার বিবরণও লেখা আছে, যেন আমরা আজও সেই প্রাচীন বাজারের কোলাহল শুনতে পাই। এজন্যই অনেকে বলেন, সাহিত্য হলো সময়ের দর্পণ। লেখার মধ্য দিয়ে সময় আটকে থাকে সাহিত্যে। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের মানুষের চিন্তা চেতনা, দিনলিপি, ঋণের হিসাব কতকিছু আটকে আছে এই মাটির ট্যাবলেটগুলোতে।

আজ থেকে প্রায় ২২০০ বছর আগে মিশর শাসন করছিল টলেমি রাজবংশ। রাজা পঞ্চম টলেমি একবার একটা বিশেষ ফরমান জারি করেন। রাজার এই আদে...
31/08/2025

আজ থেকে প্রায় ২২০০ বছর আগে মিশর শাসন করছিল টলেমি রাজবংশ। রাজা পঞ্চম টলেমি একবার একটা বিশেষ ফরমান জারি করেন। রাজার এই আদেশ পাথরে খোদাই করে স্থাপন করা হয় মন্দির, নগরের প্রবেশদ্বার এবং বাজারের পাশে। এই ফরমানগুলো লেখা হয়েছিল একসাথে তিনটি ভাষায়—মিশরের পুরোনো হায়ারোগ্লিফিক্স, মিশরের সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ডেমোটিক লিপি, আর গ্রিক ভাষায়। রাজ্যের সব মানুষ যেন এই ঘোষণা পড়ে বুঝতে পারে সেজন্য এভাবে তিনটি ভাষায় লেখা হয় এই আদেশগুলো।

এই ঘটনার প্রায় দুই হাজার বছর পর ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়নের সৈন্যরা মিশরে অভিযান চালায়। তখন ফরাসি এক সেনা-প্রকৌশলী নীল নদের কাছাকাছি রাশিদ (Rosetta) নামের এক শহরে দুর্গ মেরামত করতে গিয়ে মাটির নিচ থেকে কালো রঙের একটা গ্রানাইট পাথর আবিষ্কার করেন। তখন গ্রামের লোকেরা এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ববিদরা দ্রুত বুঝতে পারলেন যে এটি এক অমূল্য সম্পদ।

এই আবিষ্কারেরও কয়েক বছর পর ইউরোপের ভাষাবিদরা মিশরের প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক ভাষার পাঠোদ্ধার করতে শুরু করেন। ভাষাবিদদের মধ্যে শুরু হয় রীতিমতো এক প্রতিযোগিতা। কে আগে হায়ারোগ্লিফিক ভাঙতে পারবে? কিন্তু প্রাচীন হায়ারগ্লিফিকের পাঠোদ্ধার ততটা সহজ ছিল না। অবশেষে ফরাসি গবেষক জ্যঁ-ফ্রাঁসোয়া শ্যাম্পোলিয়ঁ বহু বছরের চেষ্টা ও ধৈর্যের পর ১৮২২ সালে ঘোষণা করলেন—তিনি হায়ারোগ্লিফিক লিপি পড়তে সক্ষম হয়েছেন। আর এই সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি ছিল সেই কালো পাথরের টুকরো। এই কালো পাথরকে এখন আমরা সবাই রোজেটা স্টোন নামে জানি। পাথরটার তিন অংশে তিনটি ভাষায় একই কথা লেখা ছিল। ফলে গ্রিক আর ডেমোটিক ভাষার সাথে মিলিয়ে তুলনামূলকভাবে সহজেই প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিকের লিপির পাঠ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।

রোজেটা স্টোন এখন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে। কারণ ফরাসিদের পরাজয়ের পরে ব্রিটিশরা পাথরটি দখল করে নিয়ে যায়। এই রোজেটা স্টোন শুধু একটা রাজকীয় ফরমান নয়—এটি হলো মানব ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া ভাষার দরজা খুলে দেওয়ার এক অমূল্য চাবি। এই পাথরের মাধ্যমে হাজার বছরের মিশরীয় সভ্যতার গল্প, দেবদেবীর উপাখ্যান আর রাজাদের ইতিহাস আবার আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।

30/08/2025

আজ থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেক্টাসরা আগুন ব্যবহার করতে শিখেছিল। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে রাতের বেলা আলো পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল কাঠ পুড়িয়ে আগুন জ্বালানো। আজকের দিনে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষই বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহার করে। আধুনিক একটি বাল্ব থেকে এক ঘণ্টায় যে পরিমাণ আলো পাওয়া যায়—সেই পরিমাণ আলো পেতে প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের মোটামুটি ৫৮ ঘণ্টা ধরে কাঠ সংগ্রহ করতে হতো। এরপর ব্যাবিলনীয় সভ্যতার আমলে এসে মানুষ প্রদীপ তৈরি করতে শিখে। এসব প্রদীপ জ্বলতো মূলত তিলের তেলের সাহায্যে। আজ থেকে ৩৭৫০ বছর আগে ব্যাবিলনে বাস করা একজন ধনী মানুষ যদি রাতের বেলা এই একই পরিমাণ আলো পেতে চাইতেন, তাহলে তাকে পরিশ্রম করতে হতো মোটামুটি ৪১ ঘণ্টা।

এরপর মানুষ এক ধরনের মোমবাতি তৈরি করতে শিখেছিল। প্রথমদিকের মোমবাতিগুলো তৈরি করা হতো মূলত বিভিন্ন প্রাণীর চর্বি থেকে। এইসব মোববাতি তৈরি করতে প্রচুর সময় লাগতো। পাশাপাশি এগুলো জ্বালালে এক ধরনের বোটকা গন্ধ বের হতো। এমনকি ১৭০০ শতকের শেষের দিকে এসেও বর্তমান সময়ের একটি বৈদ্যুতিক বাতি এক ঘণ্টায় যে পরিমাণ আলো দেয় সেই পরিমাণ আলো পেতে চাইলে একজন মানুষকে মোটামুটি পাঁচ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। এরপর ১৮০০ শতকে এসে মানুষ আবিষ্কার করে গ্যাস চালিত বাতি। এই ধরনের বাতির ক্ষেত্রে খরচ আরও কিছুটা কমে আসে। তবে তারপরও, এই একই পরিমাণ আলো পেতে হলে মোটামুটি ২-৩ ঘণ্টার পরিশ্রম দরকার হতো।

সব শেষে আসে বৈদ্যুতিক বাতি। বিদ্যুৎ চালিত এসব বাতি আবিষ্কারের পর খরচ আরও কমে আসে। ১৯০০ শতকের প্রথম দিকে এসে একটি বৈদ্যুতিক বাতি এক ঘণ্টা জ্বালাতে কয়েক মিনিটের উপার্জনই যথেষ্ট ছিল। আর আজকের দিনে আপনি এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে যা আয় করেন তা দিয়েই একটি বাল্ব এক ঘণ্টা চালানো সম্ভব। আমরা যদি কৃত্রিম আলোর সাপেক্ষে চিন্তা করি, তাহলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের তুলনায় আমাদের আয় বেড়েছে প্রায় ৩ লক্ষ গুণ। আর ১৮০০ শতকের তুলনায় আয় বেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার গুণ। আজকের দিনে বাতি জ্বালানোর খরচের কথা বেশিরভাগ মানুষ ভেবেই দেখেন না।

এই যে অসাধারণ উন্নতি, এই উন্নতি করতে মানবজাতির দীর্ঘ সময় লেগেছে। আর এই উন্নতি কিন্তু কোনো ধারাবাহিক উন্নতি নয়। অনেক ক্ষেত্রে কয়েক হাজার বছরের জন্যও মানব জাতির অগ্রগতি থেমে থেকেছে। মানব জাতির প্রকৃত অগ্রগতি শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। এই সময় মানুষ প্রথম জটিল সভ্যতা নির্মাণ করতে শিখেছিল। এই কাজটি শুরু হয় বর্তমান দক্ষিণ ইরাকের আল-মুঠান্না প্রদেশে। জায়গাটি ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। এখানেই তৈরি হয় পৃথিবীর প্রথম জটিল ও শহর ভিত্তিক সভ্যতা। এখানে গড়ে উঠেছিল উরুক নগরী। উরুক ছিল তখনকার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। মেসোপটেমিয়ার এই নগর থেকেই শুরু হয় ‘নগর রাষ্ট্র’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। শুরু হয় পৃথিবীর প্রথম প্রশাসন, প্রথম কর ব্যবস্থা ও লিখন পদ্ধতি। আর ইতিহাসবিদরা মনে করেন এই সময় থেকেই মানবজাতির ইতিহাসের শুরু।

পৃথিবীর বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন, ইতিহাস শুরু হয় লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের সময় থেকে। যখন মানুষ লেখা ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণ করতে শুরু করে তখন থেকেই প্রকৃত ইতিহাসের শুরু। সেই থেকে আমরা লিখিত দলিলের মাধ্যমে সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, যুদ্ধ ও চিন্তাধারার বিস্তারিত রেকর্ড পেতে শুরু করি। এই মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়রা যখন কিউনিফর্ম লিপিতে চাষাবাদ, বাণিজ্য ও করের হিসাব লেখা শুরু করে তখন থেকেই শুরু হয় নতুন এক যুগের।

তবে এই সময়টা শুধু ইতিহাসের শুরু বা লিখন পদ্ধতির শুরু হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই সময় মানুষ লেখার পাশাপাশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছিল। সেটি হলো নগর রাষ্ট্র বা ‘রাষ্ট্র ব্যবস্থা’। আজকের দিনে আমাদের সভ্যতা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তা রাষ্ট্র নামের এই প্রশাসনিক কাঠামো ছাড়া সম্ভব হতো না। মানবজাতি রাষ্ট্র নামের এই কাঠামো আবিষ্কার করার পর থেকে প্রশাসন, কর ব্যবস্থা ও লিখনপদ্ধতির কারণে দ্রুত উন্নতি করতে শুরু করে। মানবজাতির অগ্রগতির দিকে পেছন ফিরে তাকালে আমরা এই সময়ের পরেও অনেক বড় বড় শূন্যস্থান দেখতে পাব। কিন্তু তারপরও, এই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা শুরুর পর থেকে মানবজাতি একটা মোটামুটি ধারাবাহিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে গেছে।

আমরা যে সময়ের কথা বলছি সেটা আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগের কথা। কিন্তু মানুষ প্রথম বসতি স্থাপন করে বসবাস শুরু করেছিল আজ থেকে প্রায় ১১ হাজার বছর আগে। এই প্রথম বসতিও ছিল মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার আশেপাশের অঞ্চলে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার বছর আগে একদল লোক বর্তমান ফিলিস্থিনের জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে এবং সিরিয়ার তেল আসওয়াদ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে তারা এই অঞ্চলে স্বল্প পরিসরে চাষাবাদও শুরু করেছিল। এই লোকগুলোকে বলা হয় নাটুফিয়ান সংস্কৃতির লোক।

নাটুফিয়ানদের আগে আসলে এভাবে গ্রাম বা স্থায়ী বসতি স্থাপন করা সম্ভব ছিল না। কারণ এর আগের প্রায় ১ লক্ষ বছর পৃথিবী ছিল ভয়াবহরকম শীতল। গোটা স্থলভাগের ২৫ ভাগ তো ছিল রীতিমতো বরফের নিচে! আজ থেকে ১১,৬০০ বছর আগে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বেশ আরামদায়ক উষ্ণ পরিবেশ তৈরি হয়। এই উষ্ণ আবহাওয়ার ফলে বরফ গলে পৃথিবীর বিশাল একটা অঞ্চল বরফের নিচ থেকে বের হয়ে আসে। আর এই উষ্ণ আবহাওয়াতে জন্মাতে থাকে প্রচুর গাছপালা, বাড়তে থাকে পশু-পাখির সংখ্যা। একই সাথে দ্রুত বাড়তে থাকে মানুষের সংখ্যাও।

এই সময়টাতে মানুষ মূলত পশু-পাখি বা মাছ শিকার করা, বন্য ফলমূল এবং মধু সংগ্রহ করে জীবনযাপন করত। এই ধরনের মানব সমাজ ‘হান্টার গ্যাদারার’ বা শিকারি-সংগ্রহজীবী নামে পরিচিত। এই শিকারি-সংগ্রহজীবীরা ছিল মূলত যাযাবর। কিন্তু এখানে আমরা যে নাটুফিয়ানদের কথা বলছি তারা হান্টার গ্যাদারার হলেও যাযাবর ছিল না। ওরা স্থায়ী বসতি স্থাপন করে বসবাস শুরু করেছিল। বসতি স্থাপন করার প্রায় ৫০০ বছর পর ওরা কৃষিকাজ শুরু করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে আশেপাশের অঞ্চলের মানুষও চাষাবাদ শুরু করে। তবে কৃষিকাজ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের এই একটি অঞ্চলেই শুরু হয়নি। পৃথিবীর অন্তত ১১ টা অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেরাই কৃষি শুরু করেছিল।

মানুষ যখন কৃষিকাজে পারদর্শী হয়ে উঠল তখন আর শিকারের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা থাকল না। শস্য, ডাল, ফলমূল, এবং পশুপালনের মাধ্যমে তারা নিরবচ্ছিন্ন খাদ্য সংগ্রহ শুরু করে। এর ফলাফল ছিল বিপ্লবাত্মক—মানুষের জীবনে প্রথমবারের মতো অতিরিক্ত খাদ্যভাণ্ডার তৈরি হলো। এই অতিরিক্ত খাদ্য মানুষ ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখত। এটাই ছিল ইতিহাসের প্রথম ইন্সিওরেন্স পলিসি। এই স্থিতিশীলতা থেকেই পরবর্তীতে শুরু হয় স্থায়ী বসতি তৈরি করার প্রবনতা। এরপর থেকে ধীরে ধীরে স্থায়ী বসতির সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর কমতে থাকে হান্টার-গ্যাদারারদের যাযাবর জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। মানুষ ধীরে ধীরে কৃষি-ভিত্তিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়।

কৃষি-যুগে প্রবেশ করলেও প্রথমদিকে মানুষ তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেনি। কৃষি শুরু করার পর মানুষের অনেক ফসল উদ্ধৃত থাকত; তারা মাটির পাত্র, ধাতব অস্ত্রসহ আরও অন্যান্য পণ্য ব্যাপক হারে তৈরি করার মতো সময়ও পেত। ব্যাবসা-বাণিজ্যও শুরু হয়েছিল। কিন্তু তবুও উন্নতি সেই অর্থে হয়নি। ফলে স্থায়ীভাবে বসবাস করার প্রথম ৫ থেকে ৬ হাজার বছরে বড় কোনো সভ্যতা গড়ে উঠেনি। আমরা এখন বই পুস্তকে যেসব প্রাচীন সভ্যতার নাম শুনি সেই প্রধান সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল মোটামুটি পাঁচ হাজার বছর আগে। আমরা এখানে যে উরুক নগরীর কথা জানলাম সেটাও তৈরি হয়েছিল এই সময়। মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা ছাড়াও এই কাছাকাছি সময়ে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা ইত্যাদি। কিন্তু স্থায়ী বসতি গড়ার পর থেকে সভ্যতা শুরু করা পর্যন্ত এই যে ৫-৬ হাজার বছরের গ্যাপ—এই বিশাল গ্যাপের কারণ আসলে কী?

বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথম কারণটা রোগ জীবাণুঘটিত। মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর কৃষির পাশাপাশি তারা পশু পালনেও অভ্যস্ত হয়। পশু পালন খুবই লাভজনক, কিন্তু একইসাথে এটি সংক্রামক রোগের সবচেয়ে বড় কারণ। গুটি বসন্ত থেকে শুরু করে যত ভয়াবহ সংক্রামক রোগ রয়েছে তার বেশিরভাগই এসেছে পশুর শরীর থেকে। এইসব সংক্রামক রোগ থেকে মাঝে মাঝেই ভয়াবহ সব মহামারি শুরু হতো। অনেক মহামারিতে গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যেত। পশুর শরীরের রোগ ছাড়াও আরও একটি জীবাণুঘটিত সমস্যা ছিল। প্রথমদিকে মানুষ যখন স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে তখন তারা তাদের নিজেদের এবং পশুর বর্জ্যকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে জানত না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের খাবার পানি দূষিত হয়ে উঠত। আর এর ফলেও কলেরার মতো বেশকিছু জীবাণুঘটিত রোগ হতো। ফলে শিকারি জীবনের তুলনায় কৃষি ভিত্তিক জীবনে রোগবালাইয়ের আক্রমণ ছিল অনেক বেশি। মহামারি এবং রোগের কারণে কয়েক হাজার বছর পৃথিবীর জনসংখ্যা কখনোই ৪০ থেকে ৫০ লাখের উপরে উঠতে পারেনি।

দ্বিতীয় সমস্যা ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। শুধু বন্যা আর খরার কারণেই প্রথমদিকের অনেক গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। এই সমস্যা ছাড়াও আরও একটা বড় সমস্যা ছিল। সেটা হলো চুরি। প্রথম দিকের কৃষকেরা অনেক কষ্ট করে ফসল ফলাতে জানত, কিন্তু সেই ফসল রক্ষা করতে জানত না। আশেপাশের অনেক যাযাবর গোষ্ঠী কৃষকদের ফসলের উপর নজর রাখত। সময় সুযোগ পেলেই তারা ফসল গায়েব করে দিত। অর্থনীতিবিদরা এই সমস্যার নাম দিয়েছেন ‘ফ্রি রাইডার প্রবলেম’।

এই ফসল চুরির সমস্যাটা শুনতে খুব সাধারণ মনে হলেও বিষয়টা আসলে কেবল চুরির প্রশ্ন নয়। বিষয়টা আসলে মানবজাতির সংগঠনিক ক্ষমতার। মানুষ যখন উরুকের মতো জটিল নগর গড়ে তুলেছিল, তখন তারা একদিকে তৈরি করেছিল সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ফসল চুরি বন্ধ করার মতো বাহিনী, নগরের বাইরে ছিল মজবুত প্রাচীর, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও জনবল। শুধু তাই নয়, উরুক নগরীতে ছিল বড় রাস্তা ও ছোট গলির স্পষ্ট বিন্যাস। ছিল কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক অঞ্চল, আবাসিক এলাকা ও ধর্মীয় কেন্দ্র। উরুকের কেন্দ্র ছিল বিশাল মন্দির কমপ্লেক্স। এটি ছিল ওদের দেবতা আনুর মন্দির। মন্দিরের নাম ছিল জিগুরাট। অর্থাৎ আধুনিক নগরে আমরা যেমন নাগরিক জীবনযাপন করি তার প্রায় সবই শুরু হয়েছিল ওই উরুক নগরীতে। আর এই সবই সম্ভব হয়েছিল মূলত একটা প্রশাসনিক কাঠামো থাকার কারণে। যদি একটি প্রশাসনিক কাঠামো না থাকত, তাহলে নাগরিকদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করে জটিল স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা যেত না। থাকত না নগরের সম্পদ রক্ষা করার মতো বাহিনী, থাকত না নগরের প্রাচীর। আজকে মানব সভ্যতা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই হলো এই প্রশাসনিক কাঠামো। ২০২৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যারন এসেমগ্লু ও জেমস এ. রবিনসন তাঁদের বই ‘Why Nations Fail’-এ দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, বরং একটি জাতির উন্নতি করার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের প্রশাসনিক কাঠামো এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। তাঁরা এই বইতে প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক অর্থনীতি পর্যন্ত পুরো মানবসভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। শুধু এই দুই অর্থনীতিবিদই নয়, ডগলাস নর্থ, এডওয়ার্ড গ্ল্যাজার, পল কলিয়ার, ভার্জিলিও প্রেদো এবং মাইকেল পোর্টারের মতো অনেক অর্থনীতিবিদ তাঁদের বইতে উন্নতি করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কাঠামোকেই প্রধান নিয়ামক মনে করেন।

এইসব অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকদের ব্যাখ্যা থেকে দেখা যায় যে, আজকে দিনে আমরা যে উন্নত সভ্যতা তৈরি করেছি তা রাষ্ট্র বা প্রশাসনিক কাঠামো ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। এই কথাটা হয়তো শুনতে একটু আশ্চর্য লাগতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা এর প্রমাণ দেখতে পাই। রাষ্ট্র না থাকলে মানব সমাজের চেহারা যে কতটা আলাদা হতে পারে সেই বিষয়টা বোঝা যায় পাপুয়া নিউগিনি অঞ্চল থেকে।

পাপুয়া নিউগিনির অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার কাছাকাছি, প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে। এই অঞ্চলটাকে বলা হয় মেলানেশিয়া। এই অঞ্চলের দ্বীপগুলোতে এখন যেসব মানুষ বাস করে তারা মূলত দুইটা জনগোষ্ঠীর লোক। এদের একটা দল এই অঞ্চলে এসেছিল তাইওয়ান থেকে, আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। ওদের বলা হয় অস্ট্রোনেসিয়ান। অন্য দলের লোকগুলোকে বলা হয় ট্রান্স গায়ানা জনগোষ্ঠী। ওরা এই অঞ্চলে এসেছিল প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, পাপুয়া নিউগিনিতে এখন প্রায় ১ হাজারেরও বেশি আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে। আর ওদের জীবিত ভাষার সংখ্যা হলো ৮৩৯টি! অর্থাৎ এখনো এই অঞ্চলের মানুষ এই ৮৩৯ টি ভাষায় কথা বলে। এই অঞ্চলে যতগুলো ভাষা রয়েছে তাদেরকে মোটামুটিভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে একটা ভাষা পরিবারের নাম হলো অস্ট্রোনেসিয়ান, আরেকটা ট্রান্স গায়ানা। অর্থাৎ, এই অঞ্চলে মূলত দুইটি গোষ্ঠী বসবাস করে, আর এই দুইটি গোষ্ঠীর থেকেই দুইটি ভাষা পরিবারের উদ্ভব ঘটেছে।

এই অঞ্চলে যখন অস্ট্রোনেসিয়ানরা এসেছিল তখন তারা একটা ভাষাতেই কথা বলত। ঠিক তেমনি ট্রান্স গায়ানা গোষ্ঠীর মানুষরাও প্রথমে একটা ভাষাতেই কথা বলত। কয়েক হাজার বছর এই অঞ্চলে বাস করার পর সেই দুইটি আদিভাষা থেকেই এতগুলো আলাদা আলাদা ভাষার জন্ম হয়েছে। পাপুয়া নিউগিনিতে কেন এতগুলো আদিবাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে এবং এতগুলো আলাদা ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে সেটা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন উইলিয়াম ফলে। তিনি পাপুয়া নিউগিনির ভাষার একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে, এখানে এতগুলো ভাষা তৈরি হওয়ার কারণ মূলত রাজনৈতিক। এই অঞ্চলের ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য তৈরি হয়নি। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা বা অ্যামেরিকায় রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্য তৈরির অনেক উদাহরণ রয়েছে। এমনকি ল্যাতিন অ্যামেরিকার মায়া এবং অ্যাজটেকদের সমাজেও সাম্রাজ্যের বেসিক স্ট্রাকচার ছিল। কিন্তু এই পাপুয়া নিউগিনি অঞ্চলে কোনো সময় কোনো রাষ্ট্র, বা রাষ্ট্রের আদলে কোনো সংগঠনই তৈরি হয়নি। সাম্রাজ্য তো আরও দূরের কথা। তার বদলে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ছিল গোত্রে গোত্রে তীব্র প্রতিযোগিতা।

কোনো অঞ্চলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এমন তীব্র প্রতিযোগিতা থাকলে সেই অঞ্চলে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। এটাকে বলা হয় ‘বলকানাইজেশন’। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপের বলকান অঞ্চলে ধীরে ধীরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ভিত্তিক অনেকগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্র গঠিত হয়। সেই ঘটনা থেকেই এই ধরনের বিভক্তিকে ‘বলকানাইজেশন’ বলা হয়। পাপুয়া নিউগিনিতে একদম চূড়ান্ত পর্যায়ের বলকানাইজেশন ঘটেছে। দুইটি মূল গোষ্ঠী থেকে প্রায় ১০০০ এর উপর স্বতন্ত্র আদিবাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, তৈরি হয়েছে ৮০০-এরও বেশি ভাষা।

এখন প্রশ্ন হলো পাপুয়া নিউগিনির মতো পুরো পৃথিবীর কোথাও যদি সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্র তৈরি না হতো তাহলে মানবজাতির বর্তমান অবস্থা কেমন হতো? উত্তরটা খুবই অবাক হওয়ার মতো।

যদি মানবজাতি কোনোদিনও কোনো রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্য না তৈরি করত তাহলে বেশকিছু ঘটনা ঘটত।

১। পৃথিবীতে হাজার হাজার ভাষা এবং উপভাষা থাকত। ইংরেজির মতো কোনো লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা থাকত না।
২। খ্রিষ্ট বা বৌদ্ধ ধর্মের মতো কোনো বড় ধর্মের অস্তিত্ব থাকত না। পৃথিবী জুড়ে থাকত শুধু স্থানীয় ধর্ম। ফলে ভাষার মতো ধর্মের সংখ্যাও হতো আরও কয়েক হাজার বেশি!
৩। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি আজকের দিনের তুলনায় অনেক অনেক পিছিয়ে থাকত। এখনো হয়তো মানবজাতি ইলেক্ট্রনিক্স যুগেই প্রবেশ করত না।

এই বিষয়গুলোর মতো বর্তমান পৃথিবীর অনেককিছুই হতো সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি কোনটি ন্যায়, কোন কাজটি ভালো এসবের সংজ্ঞাও হতো আলাদা। তাহলে বুঝতেই পারছেন রাষ্ট্র বা প্রশাসনিক কাঠামো মানব জাতির উন্নতি বা অগ্রগতির ক্ষেত্রে কত বড় প্রভাবক।

কিন্তু এই রাষ্ট্র বা প্রশাসনিক কাঠামো যেমন মানবজাতিকে সভ্যতা তৈরি করে আধুনিক যুগে নিয়ে এসেছে, তেমনি এই রাষ্ট্রের কারণে মানবজাতিকে অনেক দুর্ভোগও পোহাতে হয়েছে। এই দুর্ভোগ শুরু হয়েছিল সেই প্রথম সভ্যতা নির্মাণ করার সময় থেকেই।

প্রাচীন বিশ্বের প্রথম ভয়ঙ্কর সামরিক রাষ্ট্রগুলোর একটি ছিল আশুর। এই রাজ্যের রাজা আশুরবানিপাল ছিলেন একাধারে বিদ্বান ও নিষ্ঠুর। যুদ্ধে হেরে যাওয়া রাজাদের তিনি বন্দী করে জনসমক্ষে চোখ উপড়ে দিতেন। জীবন্ত অবস্থায় বন্দীদের চামড়া ছাড়িয়ে নিত তার কসাই বাহিনী। আশুরবানিপালের সাম্রাজ্যের যুদ্ধনীতি ছিল—শহর দখল করো, পুরুষদের হত্যা করো, নারী ও শিশুকে দাস বানাও।

রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক কাঠামো শুরুর পর থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দাস হয়ে কাটাতে হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যে মানুষ বনে বাদাড়ে ঘুরে শিকার করত, উন্মুক্ত বনে ফল আর মধু সংগ্রহ করত, তাদেরকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটাতে হয়েছে দাসের জীবন।

প্রাচীন চিন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চিন শিহুয়াং চীনকে একত্রিত করে এক শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তার রাষ্ট্র ছিল ভয় ও নিয়ন্ত্রণের উপর দাঁড়িয়ে। তিনি ‘Legalism’ নামে একটি দর্শন অনুসরণ করতেন। তার এই দর্শনে ন্যায়বিচার নয়, বরং শাসকের ইচ্ছাই ছিল আইন। তিনি ৪৬০ জন কনফুসীয় পণ্ডিতকে জীবন্ত পুঁতে ফেলেন। তাদের অপরাধ ছিল তারা সম্রাটের মতামত মেনে নেয়নি। সম্রাট শিংহুয়াং-এর আমলে অসংখ্য প্রাচীন বই পুড়িয়ে ফেলা হয় যাতে জনগণ রাষ্ট্রনির্ধারিত সত্য ছাড়া আর কিছুই না জানতে পারে। চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণের জন্য লক্ষ লক্ষ কৃষককে জোর করে কাজে পাঠানো হয়। এদের অনেকেই আর কোনোদিন বাড়িতে ফিরতে পারেনি। ওই দেয়ালই ছিল তাদের শেষ ঠিকানা।

এখানেই কি শেষ? রাষ্ট্র যখন ভুল পথে উন্নতি করতে চায় তখনও মানবজাতির জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনে। রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের নামে চীনের কমিউনিস্ট শাসক মাও সেতুং একবার একটি ভয়াবহ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত শিল্পায়ন ও কৃষি উৎপাদন বাড়ানো। কিন্তু বাস্তবে এর ফল হয় বিপর্যয়কর। উদ্ভট নীতিমালার কারণে কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, খাদ্য উৎপাদন কমে যায়। এর ফলে ১৫ থেকে ৪৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে। রাষ্ট্রের আদর্শবাদী অবাস্তব পরিকল্পনা কতটা প্রাণঘাতী হতে পারে, তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর উদাহরণ এটি।

রাষ্ট্র, রাজশক্তি বা প্রশাসনিক কাঠামো কখনো কখনো এতটাই ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠে যে গণহত্যাও তার কাছে হার মানে। এমন এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ করেছিল রোমান সিনেট। তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধের সময় রোমান সিনেট সিদ্ধান্ত নেয় যে কার্থেজকে তারা এমনভাবে ধ্বংস করবে যেন পৃথিবীর বুকে কার্থেজের কোনো চিহ্নই না থাকে। সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তারা পুরো শহর জ্বালিয়ে দেয়। নারী ও শিশুসহ অসংখ মানুষ আগুনে পুরে মারা যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় ৫০০,০০০ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে অবশ্য কিছু লোককে দাস হিসেবে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পুরো শহর পুড়িয়ে ফেলার পর রোমানরা পুরো শহরের উপর লবণ ছিটিয়ে দিয়েছিল, যাতে এই অঞ্চলে কোনো ঘাসও জন্মাতে না পারে। রোমানরা চেয়েছিল কার্থেজকে আক্ষরিকভাবেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে।

আসলে রাষ্ট্র কাঠামো বা প্রশাসন তার ক্ষমতা দিয়ে যেমন সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি পারে সমগ্র মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিতে, বা সমগ্র মানবজাতিকে দাসে পরিণত করতে।

শুধু প্রশাসনিক কাঠামোর শক্তিতেই যদি রাষ্ট্র এতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে, তাহলে রাষ্ট্রের হাতে যদি কোনো মহাশক্তিশালী প্রযুক্তি থাকে, তাহলে কী হতে পারে? এমন কিছু উদাহরণ অবশ্য ইতিহাসে ইতোমধ্যেই আছে।

যেমন: হিটলারের কথাই বলা যায়। হিটলারের একটা ধারণা ছিল ‘আর্য জাতি’ বা ‘ইউরোপীয়রা’ হলো শ্রেষ্ঠ মানব সন্তান। পাশাপাশি সে এটাও মনে করত যে, অনগ্রসর নিচু জাতিগোষ্ঠীগুলোর সবাইকে মেরে ফেললে সেটা জার্মানি তথা মানবজাতির জন্যই কল্যাণকর। তাই তার নাৎসি সরকার একটা প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পে ইহুদি, রোমা, সিন্টি, সমকামী, প্রতিবন্ধী, এবং অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু দেশের এত মানুষকে এভাবে বেছে বেছে হত্যা করা তো বেশ কঠিন একটি কাজ। এজন্য হিটলার প্রযুক্তির সহায়তা নেয়। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এইসব মানুষকে শনাক্ত করে তার একটা তালিকা করার জন্য তার অফিসাররা ব্যবহার করেছিল IBM-এর একটি মেশিন। এই মেশিনের নাম ছিল ‘Hollerith punch card system’। এই তথ্য বিশ্লেষণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম, ধর্ম, পেশা, বাসস্থান শ্রেণিবদ্ধ করেছিল। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কে যাবে, কে মরবে—এভাবেই তারা সেটা নির্ধারণ করত। প্রযুক্তি এখানে ঠান্ডা মাথায় মানুষ হত্যা করার যন্ত্র হয়ে ওঠে। এটা ছিল আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে করা প্রথম ‘Ethnic cleansing’।

কিন্তু প্রযুক্তি এখন অনেক এগিয়ে গেছে। এখন আমাদের সামনে এমন দুইটি প্রযুক্তি এসে হাজির হয়েছে যে দুইটি প্রযুক্তি চিরতরে বদলে দিতে পারে মানবজাতির ভবিষ্যৎ। এর একটি হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটার, আর দ্বিতীয়টি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এখন পর্যন্ত মানবজাতি যত প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে তার মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ ছিল পারমাণবিক বোমা। এই বোমা এতই ধ্বংসাত্মক যে—যদি পৃথিবীর সব দেশ একই সাথে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করে তাহলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মানবজাতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। পারমাণবিক বোমা তার চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছেছে, আমরা তার ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ করেছি। অন্যদিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনো তার চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছায়নি। পারমাণবিক বোমা তৈরির পর অনেক দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী বলেছিলেন—এই বোমার কারণে মানবজাতি খুব দ্রুত ধ্বংস হতে চলেছে। কিন্তু সেটা হয়নি, হয়েছে তার বিপরীতটা। কারণ এই বোমা যদি একবার কোনো দেশ ব্যবহার করে, তাহলে বিশ্বের অন্যান্য দেশও সেই পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। আর তা যদি হয়, তাহলে কোনো দেশই আসলে রক্ষা পাবে না। তাই পারমাণবিক বোমার কারণে কিছু দেশের আধিপত্য বৃদ্ধি পেলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ আসলে কমই হয়েছে। বলা হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিগত ৭০ বছর ইউরোপ ছিল ইতিহাসের সবথেকে শান্তিপ্রিয় অঞ্চল।

কিন্তু নতুন এই দুইটি প্রযুক্তি যদি তার চুড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছায় তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম হতে পারে। প্রথমে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথাই বলা যাক।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার আর সাধারণ কম্পিউটারের গঠনের মধ্যে অনেক বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। আর কাজ করার পদ্ধতিতেও (এ্যালগরিদম) রয়েছে অনেক তফাৎ। কোয়ান্টাম এ্যালগরিদম ব্যবহার করে কিছু কিছু সমস্যা খুব কম সময়ে সমাধান করা যাবে, যেগুলো করতে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের হয়তো দুই চার বিলিয়ন বছর লেগে যেতে পারে! এর মধ্যে রয়েছে রাসায়নিক বিক্রিয়ার সিমুলেশন ও মৌলিক উৎপাদকে বিশ্লেষণ। প্রথমটা করা গেলে ওষুধ ও রোগ নিয়ে গবেষণায় এক ধরনের মারাত্মক অগ্রগতি হবে, আর দ্বিতীয়টা করা গেলে যেকোনো সার্ভার বা কম্পিউটারের সিকিউরিটি খুব সহজেই ভেঙ্গে ফেলা যাবে।

শুনতে খুব সাধারণ শোনালেও একটি বিশাল সংখ্যাকে মৌলিক উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে গেলে সুপার কম্পিউটাররও অনেক সময় লাগে। যদি অনেক বিশাল কোন সংখ্যাকে মৌলিক উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে দেওয়া হয়, তবে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগেও তা শেষ হবে না। আর এই বিষয়টা ধরে নিয়েই বেশিরভাগ কম্পিউটার নিরাপত্তা ব্যাবস্থা ডিজাইন করা হয়। যদি কেউ বড় কোন সংখ্যাকে মৌলিক উৎপাদকে বিশ্লেষণ করার কোন সহজ উপায় বের করতে পারে, তবে সহজেই কম্পিউটার নিরপত্তা ভেঙ্গে ফেলা যাবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই কাজটা খুব দ্রুত করে ফেলতে পারবে।

যদি কোনোদিন আমরা একটি উন্নত মানের কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করতে পারি তাহলে সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার হবে পারমাণবিক বোমার থেকেও শক্তিশালী অস্ত্র। কারণ RSA, ECC, AES-এর মতো প্রচলিত এনক্রিপশন এক নিমেষে ভেঙে ফেলা যাবে সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাহায্যে। আধুনিক ইন্টারনেট, ব্যাংকিং সিস্টেম, সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ইমেইল সব কিছু দাঁড়িয়ে আছে এই এনক্রিপশনের উপর। আর কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম, যেমন Shor’s Algorithm এই সব সিকিউরিটিও ভেঙে দিতে পারে। কেউ যদি সাইবার সিকিউরিটি ভেঙে আপনার সার্ভারে ঢুকে পড়ে তাহলে আপনার সবকিছুই আসলে তার দখলে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার যখন তার চুড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছাবে তখন সেই কম্পিউটার দিয়ে যেকোনো ধরনের ক্রিপ্টোগ্রাফি ভেঙে ফেলা যাবে, কিন্তু কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি ভাঙা কোনো সাধারণ কম্পিউটারের সাহায্যে সম্ভব হবে না। আর যদি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এই প্রযুক্তি প্রথম অর্জন করে একটিমাত্র রাষ্ট্র বা একটিমাত্র কর্পোরেশন—তাহলে তারা চাইলে বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে পারবে। তাদের কোনোভাবেই আটকানো যাবে না।
দুনিয়ার সব সরকার, কর্পোরেশন, ব্যক্তির গোপন তথ্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে সেই কোয়ান্টাম কপিউটারের মালিক দেশের কাছে। ব্যাংক, ডিফেন্স, রিসার্চ, স্বাস্থ্যখাত, এমনকি নির্বাচনী ডেটাও হ্যাক করা যাবে নিমেষে। ফলে আশ্চর্য ক্ষমতাশালী একটি দেশ গোটা দুনিয়ার সব মানুষের প্রতিটি মুভমেন্ট বুঝতে পারবে, কিন্তু তাকে বোঝা যাবে না।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাথে যদি যুক্ত হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তাহলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। তখন তৈরি হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা। AI আমাদের সবার মুখ চিনবে, অভ্যাস জানবে, কথাবার্তা বিশ্লেষণ করবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের সবার মেসেজ, ইমেইল, হিসাবপত্র—সবকিছু পড়ে ফেলবে। ফলে পৃথিবীতে গোপন বলে কোনোকিছু থাকবে না। সেই শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে তো পারবেই না, হয়তো ভাবতেও পারবে না।

অনেক সময় বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বা ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসে দেখানো হয় যে—পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই, জাতি নেই, যুদ্ধ নেই, নির্বাচন নেই। সমগ্র পৃথিবী পরিচালনা করছে একটি কর্পোরেশন। কর্পোরেশনের সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে দিচ্ছে কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম। কে বিপজ্জনক, কাকে গ্রেপ্তার করতে হবে, কোন তথ্য বন্ধ করতে হবে—সবই ঠিক করছে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এই বিষয়টি এখন আর ফিকশন নয়। বেশ কিছু কোম্পানি কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছে। গুগলসহ বেশকিছু কোম্পানি কিছু প্রোটোটাইপও তৈরি করেছে। ২০১৯ সালে গুগল তাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সফলতার একটি খবর প্রকাশ করে। সেখানে তারা দেখিয়েছে যে, বিশ্বের সবচেয়ে ভালো সুপার কম্পিউটারের যে সমস্যাটি সমাধান করতে প্রায় দশ হাজার বছর লাগবে, সেটা তারা তাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে মাত্র ৩ মিনিট ২০ সেকেন্ডেই সমাধান করেছে। অবশ্য আইবিএম গুগলের এই দাবিকে মেনে নেয়নি। তাদের দাবি এই সমস্যাটা সমাধান করতে সুপার কম্পিউটারের আড়াই দিন লাগবে। কিন্তু গুগল নেচার জার্নালে তাদের গবেষণাপত্রে সিমুলেশনের সাহায্যে এটা দেখিয়েছে যে সমস্যাটা সমাধান করতে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারেরও ১০ হাজার বছর সময় লাগবে।

এখনো হয়তো ব্যবহার উপযোগী কোনো কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হয়নি, তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইতোমধ্যে বেশ কার্যকর হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। যদি কখনো এই দুই প্রযুক্তির দেখা হয়ে যায়, তাহলে মানবজাতির ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে থাকবে ন্যানোমিটার ব্যাসার্ধের একটি সুতার উপর।

Address

Dhaka
1000

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when পুঁথি posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share

Category