23/06/2025
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের প্রভাব: ঢাকা ও তেল আবিবের পুঁজিবাজার!
০১। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান সংঘাত ২০২৫ সালের জুন মাসে তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই যুদ্ধের প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং পুঁজিবাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং ইসরাইলের তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জ (টিএএসই) এই সংঘাতের প্রভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা এই দুই পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা এবং এর পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করব।
০২। ঢাকার পুঁজিবাজারের অবস্থা
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মিশ্র প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর হওয়ায়, বিশেষ করে জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে, এই সংঘাতের ফলে তেলের দাম বৃদ্ধি এবং হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে তেল সরবরাহে সম্ভাব্য বিঘ্নের আশঙ্কা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
০৩। প্রধান প্রভাব:
(ক) তেলের দাম বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির চাপ:
যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক তেলের দাম বেড়ে গেছে, যা বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের ১৩ জুন থেকে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৪.৬৫ ডলারে পৌঁছেছে, যা এপ্রিল মাসের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধির ফলে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও, অন্যান্য খাতে (যেমন, উৎপাদন ও পরিবহন) উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে শেয়ারের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
(খ) বিনিয়োগকারীদের সতর্কতা:
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করছে এবং জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে, দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন, ফলে ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা কমেছে।
০৪। খাতভিত্তিক প্রভাব:
(ক) জ্বালানি ও পাওয়ার খাত: তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এই খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে।
(খ) ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত: মূল্যস্ফীতির আশঙ্কায় সুদের হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
(গ) ভোগ্যপণ্য খাত: তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এই খাতে শেয়ারের দামে সামান্য পতন দেখা গেছে।
০৫। তেল আবিবের পুঁজিবাজারের অবস্থা
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের কেন্দ্রস্থলে থাকা ইসরাইলের তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জ (টিএএসই) এই সংঘাতের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে তেল আবিবসহ ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
০৬। প্রধান প্রভাব:
(ক) সরাসরি ক্ষয়ক্ষতি:
২০২৫ সালের ১৯ জুন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনে সরাসরি আঘাত হানে, যার ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে। এই হামলায় কমপক্ষে ৩২ জন আহত হয়েছেন। ২২ জুনের হামলায় তেল আবিব ও নেস জিওনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার ফলে টিএএসই সূচক উল্লেখযোগ্যভাবে পতনের মুখ দেখে।
(খ) নিরাপত্তা উদ্বেগ:
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) তেল আবিব ও হাইফার মতো কৌশলগত শহরগুলোতে নিয়মিত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। এই হামলার ফলে ইসরাইলের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে, যা টিএএসই-এর শেয়ার বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
০৭। খাতভিত্তিক প্রভাব:
(ক) প্রযুক্তি খাত: ইসরাইলের প্রযুক্তি খাত, যা টিএএসই-এর একটি প্রধান উপাদান, যুদ্ধের কারণে বিনিয়োগে ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে। গ্যাভ-ইয়াম টেকনোলজি পার্কে হামলার ফলে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামে বড় ধরনের পতন দেখা গেছে।
(খ) প্রতিরক্ষা খাত: প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারে সাময়িক উত্থান দেখা গেলেও, দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা সতর্ক রয়েছেন।
০৮। তুলনামূলক বিশ্লেষণ
ঢাকা ও তেল আবিবের পুঁজিবাজারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও, উভয় বাজারই ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের প্রভাবে অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছে। ঢাকার পুঁজিবাজারে প্রভাব পরোক্ষ, যা মূলত তেলের দাম বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে এসেছে। অন্যদিকে, তেল আবিবের বাজার সরাসরি যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, কারণ ইরানের হামলা ইসরাইলের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করেছে।
০৯। মিল:
(ক) উভয় বাজারেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও সতর্কতা বিরাজ করছে।
(খ) তেলের দাম বৃদ্ধি উভয় দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
১০। পার্থক্য:
(ক) ঢাকার বাজারে প্রভাব পরোক্ষ এবং ধীরগতির, যেখানে তেল আবিবের বাজার সরাসরি হামলার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
(খ) ঢাকার জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও, তেল আবিবে প্রযুক্তি ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ কমেছে।
১১। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতির পাশাপাশি ঢাকা ও তেল আবিবের পুঁজিবাজারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। ঢাকার পুঁজিবাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে তুলেছে, তবে এটি এখনও স্থিতিশীল রয়েছে। অন্যদিকে, তেল আবিবের পুঁজিবাজার সরাসরি হামলা ও নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে তীব্র অস্থিরতার মুখোমুখি। যুদ্ধের এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে উভয় বাজারে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে, বাংলাদেশ সরকারের পর্যবেক্ষণ এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ঢাকার বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হতে পারে।