15/11/2023
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হাফেজ্জী হুজুর
মনযূর আহমাদ
১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠার পর হাফেজ্জী হুজুর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচিত হন এবং কূটনৈতিক মহলসহ বিদেশেও তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নির্বাচনের পর ইরান ও ইরাকের উচ্চপর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা পৃথক পৃথ কভাবে কামরাঙ্গীর চরে মাদরাসায়ে নুরীয়ায় উপস্থিত হয়ে হাফেজ্জী হুজুরকে ইরান ও ইরাক সফরের আমন্ত্রণ জানান। ভ্রাতৃপ্রতিম দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে তখন যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধে দেশ দুটির শহর-বন্দর ও জনপদ ধ্বংস হওয়া ছাড়াও উভয় দেশের হাজার হাজার নর-নারী হতাহত হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে দেশ দুটির যুদ্ধ বন্ধ করার উপায় নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে ১৯৮২ সালের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর ইরান-ইরাকে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সফর করেন। তিনি ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইরান সফর করেন। পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সফরসঙ্গী ছিল।[১]
ইরান পৌঁছলে হাফেজ্জী হুজুরসহ প্রতিনিধিদলকে তেহরানের মেহরাবাদ বিমানবন্দরে ইরান সরকারের পক্ষ থেকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসেবে আট দিন ইরানে অবস্থানের সময় তাঁরা ইরানের বিপ্লবী নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি, প্রেসিডেন্ট আলি খামেনিসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। ইরান সফরের পর হজ পালন শেষ করে অক্টোবরের পাঁচ তারিখ হাফেজ্জী হুজুর তাঁর শান্তিমিশনের সদস্যগণসহ ইরাকে পৌঁছেন। ইরাকে হাফেজ্জী হুজুরের প্রতিনিধিদলে আরো তিনজন নতুন সদস্য যুক্ত হন।[২] শান্তিমিশনের লক্ষ্য নিয়ে হাফেজ্জী হুজুর ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনসহ তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী এবং ওয়াকফবিষয়ক মন্ত্রীর সাথে বৈঠকে মিলিত হন।[৩] উভয় দেশের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময়ের সময় তাঁরা ইরান-ইরাকের ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বন্ধ এবং কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানান ।
ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইরাক যদি ইসলামি হুকুমত কায়েমের কথা ঘোষণা করে এবং ইরাকি আলেমবৃন্দ ও হাফেজ্জী হুজুরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রণীত ইসলামি হুকুমতের রূপরেখা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে কোনো শর্ত ছাড়াই তারা যুদ্ধ বন্ধ করতে প্রস্তুত আছে ।
এই প্রস্তাব ইরাকের প্রেসিডেন্টের নিকট পেশ করা হলে তিনি যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব মেনে নিলেও কোরআন-সুন্নাহর শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে তাঁর দেশের বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করেন।[৪] হাফেজ্জী হুজুরের শান্তিমিশন সফল না হওয়ার কারণ হিসেবে শান্তিমিশনের ব্যাপারে উভয় দেশের সরকার প্রধান ও নীতিনির্ধারকদের ভুল বোঝাবুঝির শিকার হওয়া ছাড়াও দেশ দুটির মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দীর বৈরী সম্পর্ক এবং ‘শিয়া-সুন্নি' বিষয়ক আকিদাগত পার্থক্যের বিরাট ভূমিকা ছিল।[৫]
১৯৮৫ সালের জুলাই-আগস্টে অনুষ্ঠিত লন্ডন মুসলিম ইনস্টিটিউট আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে হাফেজ্জী হুজুর প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। প্রায় একশটিরও অধিক দেশের বরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ ও ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে যোগদান করেন।
সম্মেলনে তিনি মুসলিম বিশ্বের ঐক্য, সংহতি ও আন্তর্জাতিক ইহুদী-খ্রিষ্টান চক্রের ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যে মুসলিম উম্মাহর জন্য পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যার মূল বক্তব্য ছিল :
ক. কালিমা পাঠকারী বিশ্ব মুসলিম ঐকবদ্ধরূপে আল্লাহর রজ্জু ধারণ করে সংঘবদ্ধ হয়ে বিশ্বের সমস্ত কুফরি শক্তিকে অভিন্ন সাব্যস্ত করে সর্বাত্মক জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
খ. ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধ করাসহ মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব- সংঘাত নিরসনের জন্য একটি শক্তিশালী বিশেষ ওলামা বোর্ড গঠন করতে হবে।
গ. সারা বিশ্বের ইসলামি আন্দোলনসমূহের মধ্যে সমন্বয় বিধান ও তাদের সহযোগিতা প্রদানের জন্য একটি বিশেষ কমিটি এবং ইহুদিদের কবল থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করার জন্য একটি তহবিল গঠন করতে হবে।
ঘ. আন্তঃইসলামি বিশ্বের সংযোগের ভাষা ও খেলাফতের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে আরবি।
ঙ. খেলাফতের রাজধানী হবে মক্কা অথবা মদিনা।[৬]
সম্মেলনে প্রদত্ত হাফেজ্জী হুজুরের প্রস্তাবগুলো ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংগঠন জোরালো কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রস্তাবগুলো কার্যকর কোনো ফলাফল দিতে সমর্থ হয়নি। তারপরও হাফেজ্জীর ভাষণ ও প্রস্তাব পেশ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বাক্তিদের মনে নতুন চিন্তার উদ্রেক করেছিল। অন্তত মানসিকভাবে তারা উজ্জীবিত হয়েছিল। এও কোন সম্মেলনের কম সফলতা নয় ।
হাফেজ্জী হুজুর সমাজ থেকে জুলম, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা ও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বন্ধসহ যাবতীয় অশ্লীলতা উৎখাতের আহ্বান জানাতেন। তিনি এ জন্য দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় সৎ ও মুত্তাকি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য বলে মনে করে দল গঠনের মাধ্যমে রাজনীতিতে অংশ নেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত (মৃত্যু ৭ মে, ১৯৮৭) এই লক্ষ্যে সাধ্যমতো কাজ করে গেছেন। নানা কারণে ইচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাব না থাকা সত্ত্বেও তাঁর রাজনৈতিক উদ্যোগসমূহে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তবে তিনি চেষ্টা করেছেন, এ-ও তাঁর সাফল্য। তিনি ১৯৮১ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রাজনীতি সক্রিয় ছিলেন। রাজনীতি ছাড়াও আধ্যাত্মিক সাধনায়, জ্ঞানচর্চায় ও শিক্ষা-সেবায় তাঁর সফলতা অসামান্য।
খেলাফত আন্দোলনের বড় সাফল্য –সে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশে কওমি ধারার আলেমদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে খেলাফত আন্দোলনের কৃতিত্ব সর্বাগ্রে বিবেচ্য। বাংলাদেশের ত্রিশ হাজার কওমি মাদরাসার ছাত্র- শিক্ষক আজ ইসলামি রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে কওমি ধারার আলেম-ওলামার প্রভাব ও ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ অবদানের অনেক অংশ হাফেজ্জী হুজুরের প্রাপ্য।
টীকা :
[১] শাইখুল হাদিস আজিজুল হক রাহি., মাওলানা ফজলুল হক আমিনি রাহি., মাওলানা হামিদুল্লাহ রাহি., মাওলানা আখতার ফারুক রাহি. ও ত্বহা বিন হাবীব।
[২] মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা হাবীবুল্লাহ ও হাজী সিরাজউদ্দৌলা।
[৩] মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১০৬।
[৪] দেশ দুটি সফরশেষে ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনের প্রতিবেদন এবং অধ্যাপক আখতার ফারূক লিখিত মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর, হিজবুল্লাহ প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা-১৫৮।
[৫] মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১১৪-১৫।]
[৬] হাফিজি্জি হুজুর রাহ. স্মারক গ্রন্থ, হাফেজ্জি হুজুর রাহ. পরিষদ, প্রকাশকাল : ২০০৫, পৃষ্ঠা : ২৩৪।
বিস্তারিত পড়ুন :
বই : পঁচাত্তর থেকে শাপলা
লেখক : মনযূর আহমাদ
প্রকাশক : নাবিক প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্য : ১৫০০ টাকা