03/11/2025
আজ অনেক বছর পর আপনাকে “মা” বলে লিখতে বসলাম। হয়তো জীবনের এই পরিণত বয়সে এসে আমি বুঝতে শিখেছি “মা” শব্দটার আসল মানে কী। জানি না এই চিঠি আপনি পড়বেন কিনা, কিন্তু আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়—আপনি কোথাও আছেন, শুনছেন আমাকে।
আমি এখন সেই বৃদ্ধাশ্রমেই আছি—যেখানে একসময় আপনি ছিলেন, আর শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কাকতালীয়ভাবে আমি আজ আপনার পুরোনো রুমেই থাকি। হয়তো সেই কারণেই প্রতিদিন আপনাকে খুব মনে পড়ে। ভাবি, যদি একটু আগে বুঝতাম আপনার ভালোবাসার রূপটা কেমন ছিল!
বিয়ের পর আপনি সংসারটাকে নিজের মতো করে সামলাতেন। তখন আমার মনে হতো—আমি যেন বন্দি হয়ে গেছি। বুঝিনি, আসলে আপনি সংসারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আমাদের সবার জন্য। যখন বলতেন,
“বৌমা, যতটা খাবে ততটাই নাও, অপচয় কোরো না”—
তখন খুব রাগ হত। এখন বুঝি, আপনি কৃপণ ছিলেন না, আপনি শেখাতে চেয়েছিলেন বাঁচার জ্ঞান।
যখন আপনার ছেলে (আমার স্বামী) আপনাকে বেতন দিত, মনে মনে বিরক্ত হতাম। ভাবতাম, কবে আপনার হাত থেকে মুক্ত হব! একসময় নিজের জেদে স্বামীকে বোঝালাম, আমি তার কর্মস্থলে যাব। আপনি তখন একা পড়ে গেলেন, আর আমি মনে মনে ভাবলাম—বাহ, অবশেষে মুক্তি পেলাম।
কিন্তু ভাগ্য আমাকে শিখিয়েছে—মানুষ যত দূরেই পালাক, ভালোবাসার ঋণ সে শোধ করতে পারে না।
যখন আমি অন্তঃসত্ত্বা হলাম, ডাক্তার বেড রেস্ট নিতে বললেন, তখন আপনিই এলেন আমার পাশে। আপনি রান্না করতেন, কাপড় ধুতেন, আমাকে যত্ন করতেন। অথচ আমি তখনও মুখ বাঁকাতাম। আমার মনে হতো, আপনি আমার জীবনে বোঝা।
ছেলে জন্ম নিল, বড় হতে থাকল। সে আপনাকে "ঠাম্মা" বলে ডাকত—শব্দটা শুনে অদ্ভুত লাগত, বিরক্ত হতাম। আপনি তাকে গল্প, কবিতা শোনাতেন, সে বাংলা স্কুলে যেতে চাইত। আমি চেয়েছিলাম ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ুক, কিন্তু আপনার প্রভাবটা সে ভোলেনি।
এরপর আমাদের ভাড়া বাসার জায়গা ছোট হয়ে পড়ল। আমি প্রস্তাব দিলাম, গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে শহরে নিজেদের ঘর তুলি। আপনি আপত্তি করলেন, বললেন—ওখানে আপনার স্মৃতি, শ্বশুরবাড়ির শিকড়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনাকে রাজি করালাম। আর সই করার পরই আমি ঠিক করলাম—আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাব।
যখন আপনি চলে গেলেন, আমি যেন হালকা হয়ে গেলাম। ফোনে যখন শুনলাম আপনি মারা গেছেন, মনে মনে বলেছিলাম—“যাক, শেষ হলো ঝামেলা।”
আজ ভাবি, সেই কথাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ।
সময় ঘুরে ফিরে এল আমার কাছেই। ছেলে বড় হল, বিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম, আমার বউমা আমার বন্ধু হবে, কিন্তু সে-ও আমার কথায় বিরক্ত হয়। আমি বুঝলাম, আমি এখন সেই জায়গায়, যেখানে আপনি একসময় ছিলেন।
এরপর আপনার ছেলে, আমার স্বামী, স্ট্রোকে মারা গেল। ছেলে বলল—“মা, আমরা ফ্ল্যাট বানাবো, তুমি রাজি হও।” আমি রাজি হতে চাইনি, কিন্তু কান্নাকাটিতে শেষ পর্যন্ত সই করে দিলাম। ফ্ল্যাট তৈরি হলো, কিন্তু সেখানে আমার জন্য জায়গা রইল না। বলল, “মা, তুমি নাতনির ঘরেই থাকো।”
নাতনি বড় হতে থাকল, আমার উপস্থিতি তার পছন্দ না। একদিন হঠাৎ ছেলে আর বউমা বলল—“মা, তোমার আর কষ্ট করে থাকার দরকার নেই, বৃদ্ধাশ্রমে গেলে শান্তিতে থাকবে।”
আজ আমি সেই বৃদ্ধাশ্রমে, যেখানে আপনি একসময় ছিলেন। প্রতিদিন রাতে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি—মিটমিটে তারার আলোয় আপনার মুখ ভেসে ওঠে। মনে মনে বলি,
“মা, আমি দেরিতে হলেও বুঝেছি, আপনি খারাপ ছিলেন না। আমি ছিলাম অন্ধ।
যদি পারেন, আমায় ক্ষমা করে দিন।”
সংগৃহীত