07/10/2025
গির্জা কর্তৃক চর্চিত যাজকতন্ত্রের জুলুম ও দৈহিক-চিন্তাগত আগ্রাসনের ফলস্বরূপ ফরাসি বিপ্লবের পর শাসনব্যবস্থা হিসেবে ইউরোপে গণতন্ত্র আত্মপ্রকাশ করে। এই শোষণ ছিল জনগণ ও বিশেষভাবে বহু বৈজ্ঞানিক ইস্যুতে গির্জার বিরোধিতাকারী বিজ্ঞানী ও চিন্তকদের ব্যাপারে গির্জার কথিত আসমানি সত্যের একমাত্র ঠিকাদারিত্বের দাবি।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ঘটনায় তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যা থাকত, যা হতো গির্জার অবস্থানের বিরোধী ও সাংঘর্ষিক। এটি ছিল এমন বিষয়, তৎকালে গির্জার পক্ষে যা মেনে নেওয়া বা সহ্য করা সম্ভব ছিল না। এটি গির্জার যাজকদেরকে গির্জা ও গির্জার শিক্ষাদীক্ষা, ইনকুইজিশন ট্রাইব্যুনাল ও সেখানকার গণহত্যা, নরহত্যা, পাশবিক অত্যাচার, গির্জার তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত বা পরিচালিত প্রহসনমূলক বিচার ইত্যাদি সকল কিছুর যারা বিরোধিতা করে তাদেরকে খতম করতে ও কষ্ট দিতে উদ্বুদ্ধ করে। এসব জনগণের অগোচরে থাকেনি কিছুই।
এমন পরিবেশে আধুনিক গণতন্ত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই কারণে গণতন্ত্রকে গির্জার শিক্ষা ও ধর্মের নামে প্রচলিত প্রতিটি বিষয়ের ব্যাপারে ক্রুদ্ধ দেখা যায়। গির্জার শিক্ষাদীক্ষা ও আল্লাহর নামে মানুষের ওপর গির্জা যা চাপিয়েছে সবকিছুর প্রতি বিদ্বেষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গায় গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে যায়।
এই প্রতিহিংসার কারণ হলো, গির্জা মনে করত আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে কথা বলার অধিকার একমাত্র তারই রয়েছে, এই অধিকার আর কারও নেই। এরপর গণতন্ত্র গির্জার পোপদের থেকে সার্বভৌমত্বের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়। যেন জনগণের সার্বভৌমত্বের নীতি বাস্তবায়নের নামে গির্জার পোপদের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তা পুরোপুরি সঁপে দেওয়া যায় প্রতিনিধিত্বকারী আইনসভার পোপদের অধিকারে। ফলে সার্বভৌম কর্তৃত্ব চলে যায় এক মাখলুক থেকে ভিন্ন মাখলুকের কাছে। এক সৃষ্টির প্রভুত্ব থেকে ভিন্ন সৃষ্টির প্রভুত্বে। তবে দ্বিতীয় পর্যায়ের এই সৃষ্টির প্রভুত্ব এসেছে ধর্ম ও গির্জা থেকে দূরে, নামসর্বস্ব প্রজাতন্ত্রের নামে!!
এভাবেই গণতন্ত্র সর্বপ্রথম ধর্মকে রাষ্ট্র, শাসনব্যবস্থা ও জীবনব্যবস্থা থেকে পৃথকীকরণের নীতি প্রায়োগিকভাবে তৈরি করে। এটিই প্রসিদ্ধ স্লোগানটি তৈরি করে, "রাজার অধিকার ও আল্লাহর অধিকার প্রতিটি চলবে আপন আপন ক্ষেত্রে।"
গণতন্ত্র বলে, আল্লাহর জন্য রয়েছে শুধুই উপাসনালয় ও গির্জাসমূহের কোণায় বসে বসে ইবাদত, বাকি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বিচারিক এসব জীবনের সুযোগ-সুবিধার সাথে সম্পর্কিত জীবনের ক্ষেত্রসমূহে আল্লাহর বিশেষ স্বকীয়তা বলে কিছু নেই। এগুলো হলো জনগণ ও জনপ্রতিনিধির বেশ ধরে থাকা সম্রাটের করায়ত্তে। জনগণের অধিকার ও আল্লাহর অধিকার—প্রতিটি চলবে আপন আপন ক্ষেত্রে। যা আল্লাহর অধিকারে দেওয়া হয়েছে সেগুলোতে আবার জনগণের প্রবেশাধিকার রয়েছে। যেহেতু মানুষ মসজিদ ও উপাসনালয়ের কর্মকাণ্ড ও ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি যা কিছু তাদের ধারণায় আল্লাহর জন্য রাখা হয়েছে, সেগুলোতে হস্তক্ষেপে পুরোপুরি সক্ষম ও তার হকদার।
পক্ষান্তরে যা রাখা হয়েছে মানুষের ভাগে, তাতে আল্লাহর ভাগ তৈরি হয় না, আল্লাহর অধিকার নেই তাতে সিদ্ধান্ত দেওয়ার... (তারা যা বলে তা থেকে আল্লাহ তাআলা অনেক ঊর্ধ্বে)। আল্লাহ তাআলা সত্য বলেছেন,
وَجَعَلُوا لِلَّهِ مِمَّا ذَرَأَ مِنَ الْحَرْثِ وَالْأَنْعَامِ نَصِيبًا فَقَالُوا هَٰذَا لِلَّهِ بِزَعْمِهِمْ وَهَٰذَا لِشُرَكَائِنَا ۖ فَمَا كَانَ لِشُرَكَائِهِمْ فَلَا يَصِلُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَا كَانَ لِلَّهِ فَهُوَ يَصِلُ إِلَىٰ شُرَكَائِهِمْ ۗ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন তার মধ্য হতে তারা আল্লাহর জন্য একটি অংশ নির্ধারণ করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, এটা আল্লাহর জন্য আর এটা আমাদের দেবতাদের জন্য, যা তাদের দেবতাদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, অথচ যা আল্লাহর অংশ তা তাদের পৌঁছায়। তারা যা মীমাংসা করে তা নিকৃষ্ট। (সুরা আনআম : ১৩৬)
এমনইভাবে গণতন্ত্র একটি জীবনব্যবস্থা ও ধর্মের মতো অস্তিত্ব, অবিনশ্বর সত্তা ও জীবন সম্পর্কে বিশেষ ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। বিশেষ ব্যাখ্যা প্রদান করেছে স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়েও।
যে বলে ‘কোনো স্রষ্টা নেই, জীবন হলো বস্তু’, গণতন্ত্র তাকে বলে, কোনো আপত্তি নেই তোমার ওপর, যতক্ষণ তুমি গণতান্ত্রিক রয়েছ, আল্লাহর ব্যাপারে যা খুশি আকিদা পোষণ করতে পারো। এরই নাম আকিদার স্বাধীনতা।
বই: ইসলাম ও বহুজাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা
লেখক: আবদুল মুনয়িম মুস্তফা হালিমাহ
অনুবাদ: Ammarul Hoque
প্রকাশক: রিশাহ্ পাবলিকেশন্স