09/07/2024
আসুন একটু সতর্ক হই
মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান
বছর ঘুরে মহররম মাস এলে আমরা নতুন করে আহলে বাইতের ভালোবাসায় উজ্জীবিত হই। কারবালার শহীদগণকে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার সাথে স্মরণ করি। রাসূল (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা থেকেই মূলত এটি করে থাকি। কেননা, আহলে বাইতকে ভালোবাসা হুব্বে রাসূলের কারণেই। এই ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে কেউ কেউ বাড়াবাড়িও করে থাকেন। আহলে বাইতের ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে কখনো কখনো কোনো সাহাবীর প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন। এটি মোটেই কাম্য নয়। কারণ, সাহাবায়ে কিরামও আমাদের ভালোবাসার পাত্র। তাঁদের ভালোবাসা আমাদের আকীদা-বিশ্বাসের অংশ। তাঁদেরকেও আমরা আল্লাহর রাসূলের কারণেই ভালোবাসি। আহলে বাইতের মর্যাদা যেমন কুরআন-হাদীস দ্বারা স্বীকৃত, তেমনি সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদাও কুরআন-হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। তাই তাঁদের একশ্রেণির কারো প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে অন্যশ্রেণির কারো সমালোচনায় প্রবৃত্ত হবার সুযোগ নেই।
সাহাবায়ে কিরাম (রা.) উম্মাতের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। অবশ্য, তাঁদের পারষ্পরিক মর্যাদার মধ্যে তারতম্য রয়েছে। তাঁদের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন পর্যায়ক্রমে চার খলীফা। তাছাড়া আশারায়ে মুবাশশারা, মুহাজির, আনসার, আসহাবে বদরীন, আকাবার প্রথম শপথে অংশগ্রহণকারী, মক্কাবিজয়ের পূর্বে ইসলামগ্রহণ ও জিহাদে অংশগ্রহণকারী, বাইআতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণের বিশেষ বিশেষ মর্যাদার কথা পবিত্র কুরআন কিংবা হাদীসে কিংবা উভয়টিতে বর্ণিত আছে। এছাড়া অন্যান্য অনেক সাহাবীর বিশেষ মর্যাদার বর্ণনা স্বতন্ত্রভাবে হাদীস শরীফে রয়েছে। আহলে বাইতের মধ্যে হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এর বিশেষ মর্যাদার বহু বর্ণনা হাদীস শরীফে রয়েছে। যিনি সাহাবী, তিনি সাহাবীদের পারষ্পরিক মর্যাদার যে স্তরেই হোন না কেন, তিনি সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কিত আল্লাহ তাআলার সাধারণ ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহর একটি ঘোষণা رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ -'আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট, তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।' আরেকটি ঘোষণা, وَكُلًّا وَعَدَ اللهُ الْحُسْنَى -'তাঁদের সকলের জন্য আল্লাহ উত্তম ওয়াদা করেছেন।' উত্তম ওয়াদা কী? অন্য আয়াত থেকে এর ব্যাখ্যা হলো জান্নাত। অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরামের সকলের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাতের ওয়াদা করেছেন।
সাহাবায়ে কিরাম মা’সূম নন। কিন্তু তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির ঘোষণাপ্রাপ্ত, জান্নাতের ওয়াদাপ্রাপ্ত। তাই এ মহান মানুষদের মন্দ আলোচনা করে আমরা আমাদের ইহ-পরকাল যেন বরবাদ না করি সেজন্য আমাদের পূর্বসূরীগণ আমাদের জন্য একটি বিশেষ কর্মপন্থা ঠিক করে দিয়েছেন। ইমাম আবূ হানীফা (র.) বলেছেন, لاَ نَذْکُرُ مِنْ اَصْحَابِ رَسُوْلِ اللّٰه اِلاَّ بِخَیْر ‘আমরা সাহাবায়ে কিরামের ভালো ছাড়া অন্য কিছু আলোচনা করি না’ (আল ফিকহুল আকবার)। ইমাম তাহাভী (র.) বলেছেন, আমরা তাদের ভালো ছাড়া অন্য কিছু আলোচনা করি না। তাদের ভালোবাসাই হলো দ্বীন, ঈমান ও ইহসান। আর তাদের প্রতি শত্রুতা হলো কুফর, নিফাক ও সীমালঙ্ঘন (আল আকীদা আত তাহাভিয়্যাহ)। এ কথা শুধু ইমাম আবূ হানাফী কিংবা ইমাম তাহাভীর নয়, বরং এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত আকীদা।
সাহাবায়ে কিরাম যেহেতু মাসূম নন সেহেতু তাদের থেকে মানবীয় প্রবৃত্তির এক-দুটি বিচ্ছিন্ন প্রকাশ ঘটা অসম্ভব নয়। হযরত উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীতে মুসলিম ইতিহাসে যা সংঘটিত হয়েছে তা কোনোভাবেই সুখকর নয়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা, যা হবাব তা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এগুলো উল্লেখ করে উম্মাহর সবচেয়ে মর্যাদাবান কাফেলার কারো পবিত্র মান-মর্যাদার প্রতি আঘাত করা মোটেই সমীচীন নয়। জেনে রাখা উচিত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো সমালোচনার পথ খুললে তা একের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এক থেকে অন্যতে স্থানান্তরিত হবে। এ কারণেই আমাদের সলফে সালিহীন মূলনীতি ঠিক করে এ সমালোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। হযরত ইবনু আব্বাস (রা۔) এর একজন গোলাম হযরত মুআবিয়া (রা۔) এর সমালোচনা করলে তিনি তা করতে নিষেধ করেন। বুখারী শরীফে আছে, একদা হযরত মুআবিয়া (রা.) ইশার নামাযের পর এক রাকাত মিলিয়ে বিতর আদায় করেন। তখন তাঁর নিকট হযরত ইবন আব্বাস (রা.) এর একজন আযাদকৃত গোলাম উপস্থিত ছিলেন। তিনি ইবন আব্বাস (রা.) এর নিকট এসে ঘটনাটি বর্ণনা করলে ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, دَعْهُ فَإِنَّهُ صَحِبَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -তাঁর কথা (সমালোচনা) বাদ দাও। নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহ রাসূলের সাহচর্য লাভ করেছেন (বুখারী, হাদীস নং ৩৫৫৩)। এ বর্ণনার মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। আমাদের পীর ও মুরশিদ হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) আমৃত্যু এ মূলনীতিতে অটল ছিলেন। মাওলানা মওদুদী সাহেব ইতিহাসের সূত্র ধরেই সাহাবায়ে কিরামের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। এটি তার অন্যতম বিভ্রান্তি ছিলো। সমকালীন ও পরবর্তী উলামায়ে কিরাম তার কর্মপন্থার ঘোর বিরোধিতা করেছেন। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)ও মওদুদী সাহেবের এ বিভ্রান্তির সমালোচনা আজীবন করেছেন। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর এ অবস্থান থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
নববী মর্যাদার পর সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা হলো সুহবতে রাসূলের মর্যাদা। পরবর্তী কেউ যতই শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার অধিকারী হোন না কেন, তিনি কোনো অবস্থাতেই একজন সাধারণ সাহাবীর মর্যাদার সমান হতে পারবেন না। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (র.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, হযরত মুয়াবিয়া (রা.) ও হযরত উমর ইবন আবদুল আযীয (রা.) এর মধ্যে কে উত্তম? জবাবে তিনি বলেছিলেন,والله إن الغبار الذي دخل في أنف معاوية مع رسول الله صلى الله عليه وسلم أفضل من عمر بألف مرة ، -আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে থাকাবস্থায় মুয়াবিয়া (রা.) এর নাকে যে ধুলো প্রবেশ করেছিল তাও উমর ইবন আবদুল আযীয থেকে হাজার গুণ উত্তম (ওয়াফিয়াতুল আ’ইয়ান, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৩)। সুতরাং আমরা যেন সাহাবীদের আলোচনায় সতর্ক থাকি। কোনো সাহাবীর সম্মানহানি হয় এমন আলোচনা থেকে দূরে থাকি। ইতিহাসের অন্ধকার গলিতে অধিক হাটাহাটি না করি। কারণ, এতে নিজে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।