
27/06/2025
ভোটের বিশ্বাসঘাতকতা না কি প্রশাসনিক ব্যর্থতা?
ভোটের বিশ্বাসঘাতকতা না কি প্রশাসনিক ব্যর্থতা?
তিন জাতীয় নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তে উচ্চপর্যায়ের কমিটি
- আহমেদ শাহেদ
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক আজকাল এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, নির্বাচন মানেই যেন এক প্রকার শঙ্কা আর সংশয়ের নাম। অথচ, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রাণ হচ্ছে ভোট। জনগণ তাদের ম্যান্ডেট ব্যক্ত করে ব্যালটে, আর সেই ব্যালটের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের, প্রশাসনের, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। তবুও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে- বাংলাদেশে বারবার কেন ভোটের প্রকৃত অর্থ হারিয়ে যাচ্ছে? এটি কি শুধুই প্রশাসনিক ব্যর্থতা, নাকি এটি রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার সুপরিকল্পিত ফল?
নির্বাচনী অনিয়ম বলতে আমরা সাধারণত দুই ধরনের বিষয় বুঝতে পারি-
১. প্রশাসনিক ব্যর্থতা বা দুর্বলতা
২. রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা বা পরিকল্পিত কারচুপি
প্রথম ক্ষেত্রটি অনেকাংশেই প্রযুক্তিগত বা প্রক্রিয়াগত সমস্যা। যেমন, ভোটার তালিকায় গড়মিল, ব্যালট পেপার কম পড়া, কেন্দ্রের নিরাপত্তায় শিথিলতা, প্রিসাইডিং অফিসারদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, বা ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব। এগুলো মূলত প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে হয়। নির্বাচন কমিশন, মাঠ প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতা এখানে বড় প্রশ্ন।
কিন্তু দ্বিতীয় দিকটি অনেক গভীর এবং ভয়াবহ। রাজনৈতিক শক্তিগুলো যখন প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, তখন নির্বাচনের সার্বিক প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। বিরোধী প্রার্থীদের ভয় দেখানো, মনোনয়নপত্র বাতিলের হুমকি, গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ রাখা, ফলাফল আগেই ‘নির্ধারিত’ করা—এ সবই ভোটের বিশ্বাসঘাতকতা। এ ধরনের অনিয়ম কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর সরাসরি আঘাত।
২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল কার্যত একতরফা। বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন করায় ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জয়ী হয়। ভোটারদের বড় অংশ ভোটকেন্দ্রে যাননি। সরকার বলেছিল, নির্বাচন করতে না পারলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতো। বিরোধীরা বলেছিল, এটি জনগণের রায় নয়, বরং ক্ষমতা ধরে রাখার নাটক।
২০১৮ সালের নির্বাচন হয়েছিল আরও বেশি বিতর্কিত পরিবেশে। ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স পূর্ণ হওয়ার অভিযোগ ওঠে। বিরোধী প্রার্থীদের নামে মামলা, গ্রেফতার, সমাবেশ করতে না দেওয়া, সাংবাদিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ- এ সব অভিযোগ গণতন্ত্রের নিঃশ্বাসরোধের আলামত। নির্বাচন কমিশন সেসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনকে “অস্বাভাবিক” বলে অভিহিত করেছিলেন।
২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেও বেশির ভাগ আসনে কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। বিরোধীরা আংশিক অংশ নিলেও ভোটারদের মধ্যে উদ্দীপনা দেখা যায়নি। অনেক কেন্দ্রেই ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। দেশের গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক, এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের মধ্যে ভয়ঙ্কর আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। অনেকেই বিশ্বাস করছেন না যে, ভোট দিয়ে কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব।
এই তিনটি নির্বাচন নিয়ে প্রথমবারের মতো উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন নিঃসন্দেহে একটি বড় পদক্ষেপ। সরকারের ভাষ্য, অনিয়মের অভিযোগগুলো যাচাই করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে নির্বাচন আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে এমন অনেক তদন্ত কমিটি হয়েছে, যার রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি।
এই তদন্ত কি সত্যিই দায়ীদের খুঁজে বের করবে? নাকি এটি হবে আরেকটি “দায়মুক্তির প্রক্রিয়া”? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু প্রশাসনিক ত্রুটি চিহ্নিত করলেই হবে না। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রের শিকড় খুঁজতে হবে।
কারণ, প্রশাসন নিজের ইচ্ছায় ভোট কারচুপি করে না। প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়। প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং এজেন্ট, পুলিশ, র্যাব- সবাই তখন উচ্চপর্যায়ের নির্দেশের বাইরে কিছু করতে সাহস পায় না। সুতরাং, কমিটি যদি সত্যিই নিরপেক্ষ তদন্ত করতে চায়, তবে রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকা বিশ্লেষণ করাই হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
এক সময় বাংলাদেশে ভোট ছিল উৎসব। সকাল থেকে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত, ভোট দেওয়ার পর আঙ্গুলে সিলের দাগ নিয়ে গর্ব করত। এখন সেই দৃশ্য অনেকটাই ইতিহাস।
বারবারের অনিয়ম, ফলাফল বদলের গুজব, বিরোধী দলের প্রার্থীদের হয়রানি, ভোটের আগেই ফলাফল নির্ধারিত থাকার ধারণা- এসব কারণে মানুষ বিশ্বাস হারিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কমছে, গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহও কমছে। এর পরিণতি ভয়াবহ। গণতন্ত্রের শূন্যতায় চরমপন্থা, সহিংসতা, রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে সাধারণ মানুষ। এ পরিস্থিতি রাষ্ট্রের জন্য, সমাজের জন্য, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশের নির্বাচনী অনিয়মের মূলে শুধুমাত্র প্রশাসনিক ব্যর্থতা নেই। রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র, এবং ক্ষমতা ধরে রাখার ভয়ঙ্কর প্রবৃত্তি এখানে মূল চালিকাশক্তি। প্রশাসন একটি যন্ত্র, সেটি যে চালাবে, ফলাফলও সেই অনুযায়ী হবে- এটাই বাস্তবতা। এই কঠিন সত্য মেনে না নিলে কোনো তদন্তই ফলপ্রসূ হবে না।
তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির কাজ শুধুমাত্র রিপোর্ট লেখা নয়। এটি হতে হবে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানোর প্রথম ধাপ। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শেকড় প্রকাশ করা, প্রশাসনিক দুর্বলতা দূর করা- সবকিছুই করতে হবে নিরপেক্ষভাবে। না হলে প্রশ্ন থেকে যাবে- বাংলাদেশে নির্বাচনের অনিয়ম কি শুধুই প্রশাসনিক ব্যর্থতা, নাকি গণরায়ের প্রতি ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতা?
লেখক: কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী।