03/09/2022
ফড়িংয়ের পাখা ঝলকানোর মত ঝলকময়, বিহঙ্গের পুচ্ছ দোলানোর মত দোলকময়, ভোমরার গুনগুনের মত গুঞ্জনময় যে দুরন্তবেলা , পড়ালেখার অজুহাতে সেখান থেকে টেনে-হিঁচড়ে এনে বাবা আমাকে আবদ্ধ করলেন খুলনা শহরের এক চিপা গলিতে।
যেখানে কোন ঝোপ-জঙ্গল নাই, পাখিরবাসা নাই, ভাঁটফুল আর ঘাসের গন্ধ নাই। গোল্লাছুটের মাঠ নাই, কেরসিনের বাতি নাই।
আছে শুধু বিজলির ঝলকানি, পাকা ড্রেন আর আবর্জনার স্তূপ। আট বছরের একটা রঙিন শৈশব তার সব রং ঝেড়ে ফেলে নিমিষে হয়ে গেল পাংশু।
আমি যাতে মন খারাপ না করি, মায়ের জন্য না কাঁদি, ভাইবোনেদের কথা না ভাবি, বাবা আমাকে সাইকেলের পেছনে করে ঘুরাতে লাগলেন সারা শহর। আমি মুগ্ধ চোখে অবাক শহর দেখে সবকিছু ভুলে গেলাম।
কিন্তু এভাবে কতদিন! আমাকে নিয়ে শুধু ঘুরলে তো বাবার চলে না। তার অনেক কাজ। সামান্য বেতনের চাকরি। বাড়তি কিছু ইনকামের জন্য তাকে শহর ভরে ঘুরতে হয়। বাবা আমাকে অতঃপর আর সঙ্গে নেন না। ক্লাস ছুটির পর আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন তার কাজে।
আমি ঘরের জানালা খুলে একাকি বাসায় বসে থাকি। বারবার হিটারের দিকে তাকাই। বাবা কাজ সেরে কখন ফিরবেন, রান্না করবেন হিটারে। খুব তো খিদে লেগেছে!
বাবা সহজে ফেরেন না। অনেক দেরি করেন। আমি খিদের কথা ভুলে রংপেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতে বসি।
ঘরবাড়ি, নদী, নৌকা, খড়ের পালা, খেঁজুর গাছ, বাংলাদেশের পতাকা।
'কিশোর কণ্ঠ' খুলে গল্প পড়ি- লাড্ডু এবং তার আজব আংটি, যাদুর বাঁশি, আলোর ফোয়ারা, পরীর অভিমান, আরো কত কি!
এভাবেই কিশোর কণ্ঠ আমার অন্তরে এক গভীর ছাপ ফেলে। অজান্তে মনের মধ্যে কখন বপন করে দেয় সাহিত্যের বীজ।
কাজ সেরে এসে বাবা কখন রান্না-বান্না সেরে ফেলেছেন আমি তা টেরই পাই না, গল্পের নেশায় বুদ হয়ে থাকি। বাবা ডাকেন- 'ভাত খাও।'
'আরেক পাতা পড়ি বাবা।'
'আগে খাও। তারপর পড়। বইয়ের পড়াও পোড়ো।'
গল্পের পাতা ভাঁজ করে বই বন্ধ করে খেতে বসি। গরম ভাত আর ডিমের ফিনফিনে ঝোল। গুঁড়া মশলার সঙ্গে আলু আর পানি জ্বাল দিয়ে বলক ওঠার পর তাতে ডিম ভেঙে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। আমি গপাগপ খাই, মন আমার পড়ে রয়েছে গল্পের মধ্যে।
আমার একাকীত্ব আমাকে নিরেট এক পড়ুয়া বানিয়ে ছাড়ে।
আফিমের মত ক্ষুরধার হয়ে ওঠে গল্পের বই আর কিশোর কণ্ঠের নেশা। গল্পের বই তেমন কেনা হয় না পয়সার অভাবে। বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে পড়ি। হুমায়ূনের প্যাকেজ গল্পের বই 'একব্যাগ হুমায়ূন' পড়েছিলাম একজনের কাছ থেকে ধার করে এনে। সেই পড়ার মুগ্ধতা মনে হলে এখনো সেই ঘোরে চলে যাই!
বাবাকে অনেক বলে-কয়ে মাসে দশটাকা বাজেট পাশ করি। প্রতিমাসে তখন আমার ঘরে আসতে থাকে কিশোর কণ্ঠ। গোল্লাছুটের দুরন্তপনা আামি খুঁজে পেতে থাকি গল্পের বইয়ের পাতায়।
হঠাৎ কখনো মন উদাস হয়ে ওঠে। মাসের পর মাস বাবা ছুটি পান না। আমারও তাই বাড়ি যাওয়া হয় না। মায়ের জন্য মন কেমন কেমন করে। ভাইবোনের চেহারা চোখে ভাসে। মাকে কতদিন দেখি না!
চক্ষু আদ্র হয়ে ওঠে। বাবা বিষয়টা ধরে ফেলেন। আবার তাই আমাকে সাইকেলের পেছনে নিয়ে ঘুরতে বের হন। বাবা মাকে চিঠি লেখেন। আমি একটা দীর্ঘ চিঠি লিখে বাবার চিঠির মধ্যে গুঁজে দেই। মা এই চিঠির উত্তর দেন না কখনো। খুব মন খারাপ হয়। আমি বুঝি না কেন মা উত্তর দেন না।
এখন বুঝি- বাবার অপারগতার প্রতি প্রতিশোধ নিতেই মা এই চিঠির উত্তর দেন না। বাবা ঠিকমত টাকা পাঠাতে পারেন না। সংসারের চিন্তায় মাকে উদভ্রান্ত হয়ে থাকতে হয়। জোড়াতালি দিয়ে মাস চালানোর দুর্বোধ্য যন্ত্রণা তাকে দিনের পর দিন পোহাতে হয়। তাই এই প্রতিশোধ!
এভাবে বছর শেষে ঈদ এসে গেল। বাবা তিনদিনের ছুটি পেলেন। বহুদিন পর বাবা আর আমি সাইকেলে চেপে বাড়ির পানে ছুটলাম। ব্যাগভরে সেমাই-চিনি, চাল-ডাল নেওয়া হল। ঈদের জামাও নেওয়া হল। মা ঈদের কাপড় কোনদিনও পরেন না। তাই আর তার জন্য ঈদের কাপড় নেওয়া হল না।
বাবার পাঞ্জাবী আছে অনেকগুলো, তিনিও আর নতুন করে নিলেন না। বড় আপার কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে। তার দায়িত্ব থেকে বাবা মুক্তি পেয়েছেন। তার জন্য তাই আর কিছু নেওয়া লাগেনি। ছোটবোনের জন্য একটা লাল স্কার্ট স্বল্প মূল্যে পাওয়া গেছে।
আমার জন্য একটা কাবলি সেট। আর পিচ্চি ভাইটার জন্য কোর্ট প্যান্ট। নতুন কোর্ট প্যান্ট পেয়ে পাঁচ বছরের ভাইটা বেতাল খুশি। নেচে নেচে সবাইকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। তার খুশি দেখে আমরা সবাই উৎফুল্ল। বাবার মুখে কেবল হাসি দেখি না। ছোটভায়ের এই আনন্দ দেখে বাবার মুখ হয়ে গেছে পাথরের মত স্তব্ধ।
কারন তার ছোটছেলের এই কোর্ট প্যান্ট তিনি নতুন কিনতে পারেননি। অনেক হিসেব কষার পর তাকে পুরনো কিনে আয়রন করে আনতে হয়েছে। এই কাপড় ঝুলানো ছিল রাস্তার পাশের এক পুরান কাপড়ের দোকানে!
১৬.০৬.১৭