01/11/2025
                                            এই যে,  আপনি তো  ঝর্না আক্তারের স্বামী...তাই না?আপনাদের একটা মেয়ে হয়েছে। মা এবং বাচ্চা সুস্থ আছে আলহামদুলিল্লাহ। একটু পরে দেখা করতে পারবেন। 
ডাক্তারের পিছনে পিছনে একজন নার্সও বেরিয়ে এলো। বিল্লালের দিকে তাকিয়ে বললো,
" খুউব সুন্দর মেয়ে হয়েছে, মাশাআল্লাহ।"
বিল্লাল হাসপাতালের বেঞ্চিতে বসে পড়লো।
ঝর্নার পাশের বেডের রোগীর ছেলে হয়েছে। পরিবারের সবাই খুব খুশি। মামা বা চাচা কেউ একজন মিষ্টি বিলাচ্ছে। একটু আগেও ভালো লাগছিলো দৃশ্যটা দেখতে, কিন্তু এখন আর বিল্লালের ভালো লাগছেনা। বুকটা খচখচ করছে।
পকেটে কয়েকটা চকচকে নোট রাখা।ছেলে হবার খবর পেলে বখশিশ দেয়ার জন্য রেখেছিল। টাকাগুলোকে পকেটের ভিতরে মুচড়ে দিলো বিল্লাল।
আগে  দুই মেয়ে আছে বিল্লালের। মনে খুব  আশা ছিল ,এবার একটা ছেলে হবে। 
যদিও মুখে সেটা কখনো প্রকাশ করেনি। ঝর্না খুব চিন্তায় ছিল ।ডাক্তারকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, আল্ট্রাসাউন্ড করার সময়। কিন্তু ডাক্তার বললো , এইসব তথ্য প্রকাশ করা নিষেধ। 
বিল্লালকে  ভয়ে ভয়ে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল ঝর্না ,মেয়ে হলে মন খারাপ করবে কিনা। সে অভয় দিয়েছে বারবার । অথচ মনে মনে  চেয়েছে, এইবার একটা পুত্র সন্তান আসুক তাদের ঘরে।
একজন বয়স্ক  মহিলা এসে বললো ,
:ভাই ,ডাক্তার সাহেব কোন দিকে গেছেন?
:আপনার কি মনে হয়, ডাক্তারের খবরাখবর দেয়ার জন্য আমারে রাখসে? নাকি ডাক্তার  আমার কাছে বইলা গেছে, কোথায় যাইতেছে? 
বিল্লাল খেঁকিয়ে উঠলো মহিলার সাথে।
সে সদালাপী ,হাস্যজ্জল  মানুষ। সচরাচর কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনা। কিন্তু এই মুহূর্তে খুব অসহ্য লাগছে, এই হাসপাতালের বারান্দায় বসে থেকে। 
অফিস থেকে আজকে ছুটি নেয়া ছিল। 
ভেবেছিল, ছেলে হবার সুখবর নিয়ে অফিসে  যাবে আগামীকাল ।সবাইকে ছোট ছোট প্যাকেটে নাস্তা খাওয়াবে ,সাথে গরম গরম রসগোল্লা। 
সাড়ে এগারোটার মত বাজে।অফিসে চলে গেলে ছুটিটা বেঁচে যায়। সেটা করা যাবে না, সবাই মন খারাপ হবার বিষয়টা বুঝে যাবে।
এই মুহূর্তে ঝর্নার সামনে যাওয়াও ঠিক হবে না । ঝর্না ভীষণ বুদ্ধিমতী মেয়ে,  বিল্লালের মন খারাপটা দেখেই ধরে ফেলবে। 
সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে, দ্রুত পায়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলো বিল্লাল। 
অনেকক্ষণ কিছুই খাওয়া হয়নি। খুব ক্লান্ত লাগছে, খিদেয় পেটটাও চোঁ চোঁ করছে। 
রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো বিল্লাল। একটু ফ্রেশ হয়ে ,তারপর আবার আসবে হাসপাতালে।চোখমুখ ততক্ষণে একটু স্বাভাবিক হবে।
বাসার কাছাকাছি গলির মোড়ে আসতেই, একটা ছোট্ট বাচ্চা রিক্সার সামনে চলে এলো। রিক্সাওয়ালা লোকটা খুব পাকা চালক ।এমনভাবে রিক্সাটা ঘুরিয়ে দিলো, মেয়েটা  পড়লো কিন্তু ব্যথা পেলো না। উল্টো রিক্সাওয়ালাই ব্যথা পেলো জোরে। বিল্লালও  সামান্য ব্যথা পেলো। 
এই রাস্তার পাশেই  বড় বস্তি। অবহেলায় বড় হচ্ছে কতো শিশু।
রিকশাওয়ালাটা উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই বাচ্চা মেয়েটার কাছে গেলো। মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো, একদম বুকের সাথে মিশিয়ে। 
পাশের টং দোকানে, বালতিতে পানি রাখা ছিল। মেয়েটার হাতমুখ সুন্দর করে ধূঁয়ে দিলো।
:আম্মা,আপনে ব্যথা পাইসেন গো? আম্মা, কুন দিকে লাগসে আপনের।দ্যাখান, আমারে দ্যাখান।
বাচ্চা মেয়েটা আদর পেয়ে, একদম যেন গলে পড়ছে।হাসি ছাড়া ছোট্ট মুখে কিচ্ছু নেই।
টং দোকান থেকে, মেয়েটাকে চিপস আর ললিপপ কিনে দিলো লোকটা।
বেঞ্চিতে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে, ললিপপ খাচ্ছে বাচ্চা মেয়েটা।
ভীষণ মায়াবী সেই দৃশ্য।
বিল্লাল কাছে যেতেই বললো,
:লাগে নাই, ভাইজান। ব্যথা পায় নাই শরীলে। আল্লায় বাচাইছে।আহরে...একটা বাচ্চার জইন্য কত্ত মানুষ হাহাকার করে, ভাইজান। আট বছর যাবৎ,আমি আর আমার বউ একটা সন্তানের আশায় আছি। আল্লায় কবে মুখ তুইলা চায়, জানি না।
লোকটার চোখেমুখে একটা সন্তানের জন্য কি আকুতি!
পায়ে বেশ খানিকটা কেটে গেছে লোকটার। রিকশা চালানো ঠিক হবে না। বাকি পথটা হেঁটেই বাড়ি চলে এলো বিল্লাল।
দরজা ধাক্কা দিতেই,ছোট মেয়ে ঝুমুর দরজা খুলে দিলো। বড় মেয়ে ঝিলিক, রান্নাঘরে।
বিল্লাল সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলো।
ইচ্ছামতো ঠান্ডা পানি ঢেলে, গোসল করে বের হয়ে এলো।
বিল্লাল দেখলো, এরমধ্যেই টেবিলে খাবার দেয়া হয়ে গেছে। একগ্লাস শরবতও বানানো।পিরিচ দিয়ে সুন্দর করে ঢেকে রাখা সেটা।
পেটে ভয়ংকর খিদে। দেরি না করে খেতে বসে গেলো বিল্লাল।প্লেটে খাবার নিতে গিয়ে খেয়াল করলো, আলু কুচিয়ে ডিম দিয়ে রান্না  হয়েছে। সাথে পাতলা মসুরের ডাল।
একটু ভাত মুখে দিয়েই ,চোখটা বন্ধ করে ফেললো সে।বড্ড চেনা এই স্বাদ।
ছোটবেলায় সে যখন কিচ্ছু খেতে চাইতো না,মাছ মাংসের বায়না করতো... তখন, মা ঠিক এইভাবে ডিম আর আলু রান্না করে দিতো।
আলু এইভাবে কুঁচি করে দিলে, পেঁয়াজটা একটু কম লাগে। সাশ্রয় আর স্বাদের ব্যালেন্স করার চেষ্টা করতো মা।
আহা!কতো কষ্ট করেছে সেই মা। একটু সেবা করার সুযোগ দেয়নি। তার আগেই চলে গেছে, পৃথিবী থেকে।
:আব্বা, খাইতে ভালো হয় নাই? 
ঝিলিকের কথায়, চোখ মেলে তাকালো বিল্লাল। কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে একেবারে পাকা গিন্নি।কে বলবে, মাত্র সিক্সে পড়ে ঝিলিক? 
বাড়িতে সবসময় ঝর্নাই রান্নাবান্না করে। সে  হাসপাতালে, তাই মেয়েটা  কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে,  কি সুন্দর রান্নাবান্না করে টেবিলে এনে দিয়েছে।কবে শিখলো মেয়েটা,এই রান্না?
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বিল্লালের মনে হলো,
চোখের সামনে শাড়ির আঁচল পেঁচানো, নিজের মা'কে যেন অবিকল দেখতে পাচ্ছে সে।
খালি ঘরে নিজের দুই মেয়েকে, এইভাবে দেখার সুযোগ হয়নি আগে। সারাদিন মায়ের সাথে সাথে থাকে। লেখাপড়া, স্কুল, খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাবার কাছে খুব একটা ঘেঁষে না ওরা। বিল্লালের অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। 
কখন যে মেয়েগুলো এরকম মা হয়ে উঠলো, বুঝতে পারেনি বিল্লাল।
বাবার চিন্তিত মুখ দেখে,ঝুমুর এসে ছোট্ট শরীরে জড়িয়ে ধরে বললো,
আব্বা, আপনার মন খারাপ? আম্মা কখন আসবো?
সামনের চেয়ারে বসে,গালে হাত দিয়ে, বাবার দিকে তাকিয়ে আছে ঝিলিক।
বিল্লালের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চেষ্টা করেও আটকাতে পারছে না সে।ভয় পেয়ে, ঝিলিকও চেয়ার ছেড়ে বাবার কাছে উঠে এলো। বাবার চোখের পানি ছোট্ট হাতে, ওড়না দিয়ে মুছে দিলো।
ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরে এলে,রান্নাঘর থেকে ছুট্টে বেরিয়ে বিল্লালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো মা, 
আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিতো। মায়ের শরীর থেকে রান্নাঘরের মসলার খুব চমৎকার একটা ঘ্রাণ পেতো।
ঝিলিকের হাত আর শরীর থেকে, ঠিক মায়ের ঘ্রাণ পেলো বিল্লাল। আহ্! কতকাল পর মায়ের ঘ্রাণ!
মায়ের শরীরের এই ঘ্রানের কাছে, পুরো পৃথিবীটাইতো তুচ্ছ।
দুই মেয়ের বুকে জড়িয়ে ধরলো বিল্লাল।
:তোদের এই অবুঝ, অধম,পাপী ছেলেকে ক্ষমা করে দে মা। আমি যে আমার মা'কে অসম্মান করলাম। ক্ষমা করে দে, মা। ক্ষমা করে দে। আল্লাহ, বাকি জীবনটা তুমি এই মায়ের পরশে রাইখো আল্লাহ।আর কিচ্ছু চাই না। কিচ্ছু না...
শেষটা সুখের।
ডিম আলুর তরকারি আর মসূরের ডাল দিয়ে পেট পুরে ভাত খেয়ে, মেয়েদের নিয়ে হাসপাতালে এলো বিল্লাল।
ঝর্না বললো,
:এতোক্ষণ কই ছিলেন। আমি তো ভাবলাম, মেয়ে হইসে শুনে আপনি মন খারাপ করসেন। দেখতে আসবেন না আপনি।
বিল্লাল বললো,
:এইটা তুমি কি বলো ,ঝর্না? আমার মা আমার কাছে আসবো, আর আমি মন খারাপ করবো? আমার মতো ভাগ্যবান আর কয়জন আছে বলো তো?বড় দুই মায়েরে আনতে গেছিলাম। মায়ের মুখ দেখবো, তারে কিছু দিতে হইবো না? এইটার জন্য গেছিলাম।
পকেট থেকে ছোট্ট সোনার হার বের করে,মেয়েকে পরিয়ে দিলো বিল্লাল।
তিন মেয়েকে বুকে নিয়ে, মুগ্ধ চোখে দেখছে ঝর্না... 
পুরো হাসপাতালে মিষ্টি বিলি করছে, মেয়েদের বাবা।
সবাইকে জোরে জোরে বলছে, মিষ্টি খান ... মিষ্টি খান...আমার আরো একটা মা আসছে ।
সেই দৃশ্য বড় সুন্দর। দেখতে গেলে চোখ ভিজে ওঠে।
সমাপ্ত 
ভাগ্যবান বাবা 
রুচিরা সুলতানা