25/10/2025
আপনি কখনও জীবনানন্দ দাশকে পড়বেন না। যদি পড়েন, আপনার ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি কোনোদিন কবিতা ভালোবাসিনি। আমার নিকট পৃথিবীর গুটিকয়েক অপছন্দের জিনিসের মধ্যে একটি ছিল কবিতা। প্রচণ্ড হতাশা আর দুঃখ-কষ্টের দিনে প্রথম আমি জীবনানন্দকে পড়তে শুরু করি, কৌতূহলবশত।
তারপর? তারপর বড্ড ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল আমার।
আমি আর কোনোদিন কবিতাকে ঘৃণা করতে পারিনি।
কবিতা যে ব্যর্থ মানুষদের ভাষা, তা আমি জেনেছিলাম জীবনানন্দ দাশকে পড়ার পর।
জীবনানন্দকে পড়ার পর বহুবার আমার তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছে হয়েছিল। কারণ, আমার শুধু মনে হয়েছিল জীবনানন্দ আমার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় লিখে গিয়েছেন। লিখে গিয়েছেন আমার দুঃসময়, সুসময়, আমার শৈশব, আমার আনন্দ, আমার বেদনা। যা আমি কখনো মনে করতে চাইনি, শুধু ভুলে যেতে চেয়েছিলাম গোপনে।
আফসোস, মৃত মানুষদের দ্বিতীয়বার হত্যা করা যায় না।
পৃথিবী যে দুঃখের কাছে ঋণী, জীবনানন্দ তা তাঁর কবিতায় গুঁজে দিয়েছেন। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, তোমার সমস্ত ব্যথা এক-একটা ফুল। যদিও তা যন্ত্রণার, তবু বাঁচার জন্য তা প্রয়োজন ছিল খুব।
জীবনানন্দ মনে করিয়ে দিয়েছেন মায়ের আঁচলের কথা, মমতার কথা, নক্ষত্রের রাতে বাবার আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠা জীবনের কথা। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন আমার স্বাদের শৈশব, ধানসিঁড়ির মাঠ, প্রাণহীন নদী, পাহাড়, মেঘ, পাখি, ফুলের কথা।
জীবনানন্দ লিখেছেন জীবনে জড়িয়ে থাকা এক টুকরো সবুজ ঘাস থেকে নক্ষত্র, পতিতা থেকে দেবী, মসজিদ থেকে মন্দির। তিনি লিখেছেন আমার প্রেমিকার চুলের বেনী, বেনীতে ঝুলে থাকা জারুলফুল। লিখেছেন মনের সদরদুয়ার দিয়ে প্রেমিকার হেঁটে চলে যাওয়া নিষ্ঠুরতম দু’খানা পায়ের কথা। তিনি জানিয়েছেন, ভালোবেসে কতটুকু কাঙাল হওয়া যায়, ঈর্ষা করা যায়।
জীবনানন্দকে আমি যথেষ্ট ঘৃণা করি। অতটা লিখতে নেই জীবন, যতটা লিখলে নিজেকে গোপন করে রাখার মতো অবশিষ্ট আর কিছুই থাকে না।
আমি বলছি, আপনি জীবনানন্দকে পড়বেন না। যদি পড়েন, আপনার বড্ড ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাবে। আপনি কস্মিনকালেও ভুলতে পারবেন না জীবনের মোড়ে মোড়ে পাওয়া যাবতীয় দুঃখ। যদি একান্ত জেদের বসে ভুলে যাওয়ার চেষ্টাও করেন, তবে কোনো এক জোৎস্নামুখর রাতে জীবনানন্দ এসে আপনাকে মনে করিয়ে দেবে,
"পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আঁচড় ঢের, অশ্রু গেছি রেখে,
তবু ঐ মরালীরা, কাশ, ধান, রোদ, ঘাস এসে এসে মুছে দেয় সব।"
ফিসফিস করে নক্ষত্ররা বলে উঠবে,
"এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।"