23/11/2025
#সুখের_আশায়_বাঁধি_খেলাঘর
#লামিয়া_ইসলাম
#পর্ব_১২
-তুই কোনো ধরনের চিন্তা করবি না। তোর এই ভাই এখনো বেঁচে আছে। আমি আবার আপিল করবো।যত টাকা খরচ করা লাগবে তা আমি করবো।
রাহাত তনুকে সান্তনা দিয়ে কথাগুলো বললো। রিমিও তার কথায় সায় দিয়ে বললো,
হ্যা, তনু। তুমি একদম ভেঙে পড়বে না। ওদের পৈশাচিক হাসি আর বেশি দিন হাসতে পারবে না। সব গুলোকে নিয়ে জেলে ঢুকাবো।
-ভাইয়া, ভাবী এসবের একদমই প্রয়োজন নেই। কেস নিয়ে আমি আবার আপিল করতে চাইছি না।
রাহাত আর রিমি তনুর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো।
-এসব কিছু বলছো তনু? যারা তোমাকে এবার অত্যাচার করেছে তাঁদের এভাবেই ছেড়ে দেবে?
-কে বলেছে ছেড়ে দিয়েছি ভাইয়া? আমি আল্লাহর কাছে বিচার করেছিলাম আর আল্লাহ অলরেডি ওদের শাস্তি দেয়া শুরু করে দিয়েছে।
-মানে?
-ওদের বাড়ির পাশে এক পরিচিত ভাবীর সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। উনি একটু আগে ফোন দিয়েছিলো। মাহমুদের বড় বোন ভাবনার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। ভাবনা আর শশুরবাড়ি যেতে চাচ্ছে না। আর ওর ছোট বোন হেনা নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে। জানি না হেনা কই গিয়েছে তবে যেখানে গিয়েছে সেখানে ভালো থাকুক। আমার বদদোয়া অলরেডি ওদের গায়ে লেগেছে।
-তারপর ও.... ওরা এইভাবে ছাড় পেয়ে যাবে।
-ভাবী এখন আবার আপিল করলে একগাদা টাকা নষ্ট হবে। আমি ওদের মতো বাজে মানুষের পিছনে এই টাকা গুলো নষ্ট করতে চাই না। তুমি আর ভাইয়া মিলে আমাকে উন্মুক্ততে ভর্তি করে দেও। আমি আবার পড়াশুনা শুরু করতে চাই।
- খুব ভালো ডিসিশন নিয়েছো এটা। কাল তো তোমার থেরাপি সেশন শেষ হচ্ছে। পরশু আমি তোমার ভর্তির ব্যবস্থা করছি।
-----------------
-এখনই যাওয়ার লাগবে তোর?মাত্র ১ মাস হলো বাড়ি ফিরলি। আবার কবে না কবে ফিরবি। আরো কয়টা দিন থেকে যা।
-সম্ভব না মা। হায়ার অথোরিটি থেকে কল এসেছে।আমাকে ইমিডিয়েটলি থাইল্যান্ড যেতে হবে।
-তো আবার কবে ফিরছিস?
-শিউর বলতে পারছি না। তবে মনে হয় না যে ৩ মাসের আগে ফিরতে পারবো।
-এতদিন ঐখানে কি করবি?
-মা আমার হাতে এবার একটা নতুন কেস এসেছে, কেসটা খুব কনফিডেন্সিয়াল। সেটার ইনভেস্টিগেশনের জন্য যাওয়ার লাগছে।
-তাহলে আমাকে কথা দে তিন মাস পর ফিরে এসে তুই বিয়ে করবি।
-মা বাচ্চাদের মতো এমন জেদ কেনো করছো?
-ঠিক আছে,তোর যেখানে ইচ্ছে সেখানে যা। আমি খাবার ও ঠিকমতো খাবোনা। প্রেসারের ওষুধ ও খাবো না। যা ইচ্ছে হয়ে যাক আমার। তোর তো তাতে কিছু যায় আসে না।
-ঠিক আছে, করবো।তবে আমার কিন্তু ম্যাচিউর টাইপের মেয়ে লাগবে। কোনো আন্ডার এইজের বাচ্চা মেয়েকে আবার আমার জন্য পছন্দ করে রেখো না।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
আরমান তার পাসপোর্ট কাজের ফাইল সব একে একে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। আরমানের মা আশা আহমেদের চোখে জল চিকচিক করছে।পুরো রুমজুড়ে আলাদা এক নীরবতা নেমে এলো, সেই নীরবতার ভেতরে ছিলো গভীর মমতা আর অদ্ভুত টান।
৩ মাস পর,
বিকেলের নরম আলো পুরো বাড়িটাতে এক রকমের আরামদায়ক আবহ ছড়িয়েছে । তনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে টবে লাগানো বেলি গাছে পানি দিচ্ছিল। হালকা বাতাসে কচি পাতাগুলো দুলে উঠছে।এই তিন মাসে তনুর জীবন অনেক বদলে গেছে। অস্থিরতা আর ভয়ের জায়গা দখল করেছে পরিপক্বতা আর শান্তি। নিজের জন্য সময় রাখা, নিজের মত করে দিন সাজানো এসব যেন সে আবার শিখে নিয়েছে।।ঠিক তখনই রান্নাঘর থেকে রিমির হাসির শব্দ ভেসে আসে।
—তনু, দেখো তো! পুচকিটা আজকে আবার লাথি দিল!
রিমি দু’হাত দিয়ে পেটটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে অদ্ভুত এক খুশির আলো।রাহাত তার কাছে ছুটে এসে বলল,
—ডাক্তার তো বলেছে আর মাত্র ৩ মাস, তার পরেই ও আমাদের কাছে চলে আসবে … আমার তো বিশ্বাসই করতে পারছি না যে আমি বাবা হতে চলেছি!
তনু এক দৃষ্টে রাহাত আর রিমির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষগুলোই তার ভালো থাকার একমাত্র কারণ। এই মানুষগুলোকে যেনো বিধাতা সকল বদনজর থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এতদিন পর প্রথমবার তনুর মনে হলো,জীবনে মানুষের ছোট্ট জীবনে যেকোনো ভাবে যেকোনো সময় সুখ ফিরে আসতে পারে।ঠিক সে মুহূর্তে দরজা বেল বাজল। তনু দরজা খুলতেই দেখল আচারের বয়াম হাতে দুইজন পরিচিত মুখ দাঁড়িয়ে আছে। কবির আহমেদ আর আশা আহমেদ হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো। ২ মাস আগেই তারা পাশের ফ্ল্যাটে শিফট হয়েছে।তনু কৌতূহলী কণ্ঠে বললো,
-আংকেল, আন্টি আপনারা! আপনারা বান্দরবন ট্রিপ থেকে কবে ফিরলেন?
-এইতো আজ সকালেই। রিমি সেদিন পাহাড়ি আচারের কথা বলেছিলো। সেটাই নিয়ে এসেছি।
-এতোগুলো?
-হ্যা, দুইজনে মিলে ধীরে ধীরে খাবে। মাঝে মাঝে একটু রোদে দিও, তাহলে অনেকদিন ভালো থাকবে।
রিমি তাঁদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-আন্টি আপনি যে এই ২ মাসে আমার জন্য কত কিছু করলেন।
কবির আহমেদ তার কথায় বাধা দিয়ে বললো,
-একদম ভুল বললে রিমি। লাস্ট কয়েক বছরে মধ্যে লাস্ট দুই মাস আমাদের জীবনের বেস্ট সময় ছিলো।
ছেলে তো থেকেও না থাকার মতো। আমাদের দুই বুড়ো বুড়িকে তো তোমরাই গত ২ মাসে যাবত আগলে রেখেছো।
--------------
রাত তখন প্রায় বারোটার উপর। শীতের হালকা কুয়াশা পুরো গ্রামটাকে যেন ধোঁয়ার মতো ঢেকে ফেলেছে। চারপাশ এমন নীরব মনে হয় কেউ নিঃশ্বাস নিলেও শব্দ শোনা যাবে। দূরে-দূরে দু একটা কুকুরের ডাকার আওয়াজ উঠছে, আবার থেমেও যাচ্ছে। কাঁচা রাস্তার ধুলোবালি ঠাণ্ডা বাতাসে উড়ে এসে মিলিদের উঠোনের কোণায় জমেছে।
মিলিদের টিনের ঘরের ভেতর ম্লান হারিকেন জ্বলছে। আলোটা এমন দুর্বল যে ঘরের কোনায় কোন তাকালে মনে হয় ছায়া নড়ছে। মিলি বারান্দার খাটের পাশে বসে আছে, গায়ে পাতলা শাল জড়ানো। ভেতরে তার মা ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু মিলির চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটা নেই।এতো ঠান্ডা হাওয়াতেও তার কপালে ঘাম জমে গেছে।
ঠিক এমন সময় দূর থেকে কারো হেঁটে আসার ক্ষীণ শব্দ শোনা যায়।কাঁচা মাটিতে চটি ঘষা পড়ার টুপটাপ শব্দ। মিলির নিশ্বাস আটকে যায়। উঠোনের বাঁশঝাড়ে বাতাস লাগতেই খসখস শব্দ হয়, মনে হয় কেউ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশের গেটটা আস্তে করে ধীরে ধীরে খুলে যায়।হারিকেনের আলোয় পুরু শাল গায়ে একজন পুরুষের ছায়া দেখা যায়।আফজাল হোসেন দাঁড়িয়ে আছে। মিলির বুকের ভিতর ধড়ফড়ানি আরও বেড়ে যায়।
- এতো রাতে তুমি এই বাড়িতে ডাকলা কেন? ঐ বাড়িতে গেলেই হইতো। এইখানে তো তেমন ব্যবস্থা ও নাই।
- আমি আপনারে এইখানে পিরিত দেখাইতে ডাকি নাই। জরুরি কথা আছে?
-তো কইয়া ফেলো।
-আমি এক মাসের পোয়াতি।
- মানে....মানে কি? কার বাচ্চা এইডা?
-কার বাচ্চা মানে আমি আপনি বাদে আর কার লগে শুই?
-এটা তো আমার বাচ্চা হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।
-তো আপনি কি কইতাছেন যে আমি অন্য কারো জিনিস আপনার ঘাড়ে চাপাইতাছি।
-চাপাইতেও পারো। তুমি কার লগে দেখা সাক্ষাৎ করো তা তো আর আমি জানি না।
-মুখ সামলাইয়া কথা কন। মনে রাইখেন আমার ইজ্জত গেলে আপনার ইজ্জত ও থাকবো না।
মিলির মুখে এরকম কথা শুনে আফজাল হোসেন একটু হতচকিয়ে গেলো। মিলিকে ধীরে সুস্থে হ্যান্ডেল করতে হবে। নইলে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে।
-আইচ্ছা আমারই। তাইলে কালকে আমার লগে শহরে চলো। পরিচিত ডাক্তার আছে ঐখানে আমার । সে খালাস কইরা দেবে আনে।
- শহরে গেলে কেউ যদি যাইনা যায়?
-আরেহ অনেক বিশ্বস্ত লোক আমার। কাকপক্ষী ও টের পাইবো না।
-ঠিক আছে কালকে আমি বাজারের মাথায় দাড়াই থাকমু। আপনি ঐখান থেকে আমারে লইয়া যাইয়েন।
চলবে.......