08/10/2025
বানোয়াট
নজওয়ান দারবিশ
সৃজনানুবাদ : আনিসুল হক
পুরো জিনিসটাই বানোয়াট। আমি কখনোই এই গল্প বিশ্বাস করি না যে তোমাকে জবাই করা হয়েছিল। আর তোমার রক্ত ঝরে পড়ছিল ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত পুরোটা পথ, কেবল সাগরের খাদ্য হওয়ার জন্য। আমি নিশ্চিত পুরো জিনিসটাই বানোয়াট। রোজ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে টেলিভিশন উপস্থাপক দ্বয়— মেরিয়াম কারশেনবম আর শ্লোমো গানোর।
আলহারা, ‘স্বাধীন’ [স্যাটেলাইট চ্যানেল], আল আরাবিয়া, ‘আরবি’, আলজাজিরা, ‘অন্তরীপ’ । তিনটা একসঙ্গে করলে দাঁড়ায় “স্বাধীন আরবি অন্তরীপ”। মেরিয়াম কারশেনবম আর শ্লোমো গানোর। আমি নিশ্চিত, এরা বানোয়াট।
আমার ডাকবাক্সে বিল ভরে দিয়ে গেছেন যে ব্যক্তি, তাকে আমি চিনি না। আমার বংশের নাম তিনটা ভিন্ন ভাষায়। সেসবও বানোয়াট। আমাকে ইমেইলে ভালোবাসে এই নারীটি।
হাইফা, সেও বানোয়াট। এই কারণে আমি রাস্তায় বের হই না। এবং আমি সমুদ্রের দিকে তাকাই লম্বভাবে। আমাদের বন্ধুত্ব কারও অ্যাকাউন্টেই নাই। এটাকে বানোয়াট করে তোলার মতো সময় কেউ ব্যয় করেনি। এই কারণে এটা সত্য রয়ে গেছে। ওহ, বলতে ভুলে গেছি, সব সত্য বানোয়াট। এই কারণেই আমি পছন্দ করি আপনাদের সঙ্গে শুরা, আপেল, বাদাম ইত্যাদি ভাগ করে নিতে।
আমাকে কিছুই চাপে ফেলে না। এ কারণেই আমি ভেঙে পড়ি না, যখন আমি দেখি আমাদের দেশ আমাদের কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই ডাকাতিটা বানোয়াট, চেকপয়েন্টগুলো বানোয়াট, আর সৈন্যরা তো কতগুলো শিশু যারা এখনও তাদের কাপড় ভিজিয়ে ফেলে। মুরুব্বি গ্রিক অর্থোডক্স মহিলা যারা এই সকালবেলা বেথলিহেমের ভেতরে যাচ্ছেন চেকপয়েন্ট পেরিয়ে, তারাও বানোয়াট। বানোয়াটভাবে বলা হচ্ছে—‘ক্রুশের নামে’। গুড ফ্রাইডে বানোয়াট। নাজারেথের ম্যারোনটাইন গির্জার বাইজেনটাইন সুর বানোয়াট। আমার শত্রুরা বানোয়াট। আমার আত্মীয়রা বানোয়াটের প্রতিমূর্তি। নরক বানোয়াট। স্বর্গ আরও নিপুণ ও অগণিতভাবে বানোয়াট। (ধুর। গায়িকা ফাইরুজের কণ্ঠস্বর কি বানোয়াট!)
দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়া করে না, দুঃস্বপ্ন বানোয়াট। আমার দেহ ঘড়ির ওলটপালট আমাকে ভোগায় না। সূর্যের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নাই। আমার জন্মগত প্রকৃতির কারণে আমার কোনো ভোগান্তি নাই... এই সবই বানোয়াট উপাধি।
আমিও বানোয়াট। আমি কে, তা নয়, সব ধরনের সর্বনাম হলো বানোয়াট।
আমি দালালদের ঘৃণা করি না। দেখো আমি কীভাবে তাদের সংবাদ ভাষ্য শুনি কিন্তু বমি করি না।
আমি অ্যালার্ম ঘড়ি, এইডস কিংবা আণবিক অস্ত্র ভয় পাই না। আমি ঘণ্টাধ্বনি, কিংবা টেলিফোনের রিংয়ের শব্দে আতঙ্কে ভুগি না। আগামীকাল দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে না। এসবই বানোয়াট খবর।
আমি একুশ শতাব্দীর রোমান্টিকতায় ক্লান্ত। রোমান্টিকতা সব সামাজিক শ্রেণীর ভোক্তাদের গুয়ে মাখা। বেঁচে থাকতে হলে তোমাকেও এসবের সঙ্গেই মিলেমিশে থাকতে হবে। এটাও আরেকটা বানোয়াট তত্ত্ব।
আনন্দ করো, ফুর্তি করো। তোমার পিতামহের বিছানার নিচে পরাজয়ভরা বাক্সগুলো বানোয়াট। আর তোমরা এত বছর ধরে চিত্কার করে কাঁদছ তোমাদের ভূমি হারানোর দুঃখে। বন্ধু। (ওহো! যেমন বলে ধ্রুপদি ভঙ্গিতে) হারানো বানোয়াট। একটা বিরাট মিথ্যা তোমাদের অস্তিত্ব লুটেরারা বানিয়ে তুলেছে।
মেরিয়াম কারশেনবম আর শ্লোমো গানোর। আলহারা আল আরাবিয়া আলজাজিরা এবং অচ্ছুত ব্যক্তিটি, যার হাতে রিমোট কন্ট্রোল।
আরশোলা আর দালালরা চমত্কার জীব। দেখো, একটা কী ভদ্র, আরেকটার কদর্যতাও কী মিষ্টি।
তারা সস্তাপনা বিষয়ে আমাদের যে গতানুগতিক ধারণা—তাও বানোয়াট।
ঘুমে পাওয়া একদল লোক ড্রয়িংরুমে বসে ইজরাইলি ভাষ্য শুনছে। একদল শ্রদ্ধেয় মহিলা সালাদ বানায় আর আমাদের গণ মর্যাদাকে কবরস্থ করার পরবর্তী অবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। ভেবো না, এ সবই বানোয়াট।
আমরা আমাদের বাড়ির সামনের কয়েকটা বৃক্ষকে শ্রদ্ধা করতে পারি না, আমাদের ঘুমের মধ্যে যারা জাল পাতে তাদের জন্যে ছেড়ে দিতে পারি না পর্বতগুলোকে।
১৯৪৮ সালের ২২ এপ্রিল হাইফা আত্মসমর্পণ করে। তারিখটা বানোয়াট। ১৯১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর কয়েকজন এফেন্ডিস তাদের সাদা পতাকা বয়ে নিয়ে যায় এবং জেরুজালেম সমর্পণের ছবি তোলা হয়। এই ঘটনা সত্যি ঘটেছিল কিন্তু ছবিটা বানোয়াট। তুমি, যেকোনো নির্ধারিত সময়ে, কিছু সংখ্যক এফেন্ডিসকে জড়ো করতে পারো, তাদেরকে বলতে পারো সাদা পতাকা নিয়ে জাফা তোরণ পর্যন্ত যাত্রা করতে, যাতে একটা ছবি তোলা যায়। সময়টা ছিল ২০১০ সালের ১১টা ৩০, দুপুরের ঠিক আগে আগে। প্রত্যেকে ঘুমিয়ে পড়েছিল এবং জেগে উঠেছিল। আমিও জেগে ছিলাম। বালিশগুলো বানানো। দুই সপ্তাহের মধ্যে আমি বৈরুতে যাব। ভিসা খুবই প্রকটভাবে বানোয়াট প্রতিবন্ধকতা। ও আমাদের লেবাননের ভদ্রমহিলা, আমাদের জন্যে প্রার্থনা করুন (যদিও আমরা জানি, আপনার প্রার্থনাও বানোয়াট)
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমুতে যাব, যখন আমার আমুদে বান্ধবী নাজারা থেকে বাসে চড়বে। হিব্রু শব্দগুলো তার চারপাশে ভনভন করে উড়ছে কারণ সে মনে করে শত্রুর ভাষা একটা লাশের মতো, তাই আমি তাকে বলি, তার এই ধারণা বানোয়াট, শত্রুর ভাষা লিঙ্গহীন রোবটের মতো। সে একটা লাস্যময় বানোয়াট হাসিতে ফেটে পড়ে। ও খোদা, আমরা মরব না। আমরা চলে যাব অনন্তের দিকে, আমাদের হাওয়াই চপ্পলে শব্দ তুলে। অমরত্ব বানোয়াট। যা কিছু আগে ভাগে ঘটছিল তার সবই বানোয়াট। যা কিছু আসবে সবই বানোয়াট। এবং প্রতিটা জীব বৃক্ষের মতো বাহু মেলে দাঁড়াচ্ছে এই বানোয়াট কবিতাটিতে।
……………………………………………
ফিলিস্তিনের জন্য পঙক্তিমালা ।। পর্ব-৪
#বিশেষসংখ্যা
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#ফিলিস্তিনের_জন্য_পঙক্তিমালা
#নজওয়ান_দারবিশ
#আনিসুল_হক