07/07/2025
টেস্ট ক্রিকেটে TIER SYSTEM : শক্তির ভারসাম্য ও ঐতিহ্য রক্ষায় অপরিহার্য পদক্ষেপ
Wiaan Mulder-এর সম্ভাব্য রেকর্ড ভাঙার প্রসঙ্গটি আমাদের টেস্ট ক্রিকেটের বর্তমান কাঠামোর একটি গভীর সমস্যার দিকে আঙুল তুলেছে। ব্রায়ান লারার মতো ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের ৪০০ রানের ঐতিহাসিক রেকর্ড যদি জিম্বাবুয়ের মতো দুর্বল ও বর্তমানে অনিয়মিত টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত একজন অলরাউন্ডার ভেঙে ফেলেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে এই অর্জনের প্রকৃত মূল্য কতটুকু? এই ঘটনা শুধু একটি রেকর্ডের প্রশ্ন নয়, এটি টেস্ট ক্রিকেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সমতা (Competitive Integrity) এবং Prestige সংক্রান্ত মৌলিক বিতর্কের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
Mulder এর উদাহরণ দিয়ে কেন বলছি?
১. প্রতিপক্ষের দুর্বলতা: জিম্বাবুয়ে বর্তমানে টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে অংশগ্রহণ করে না, তাদের দলে অভিজ্ঞতার অভাব এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাদের অবস্থান আগের চেয়ে দুর্বল। এ ধরনের দলের বিপক্ষে রেকর্ড গড়া নিঃসন্দেহে শীর্ষ স্তরের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় (যেমন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) রেকর্ড গড়ার মতো কঠিন নয়।
২. Mulder কে : Wiaan Mulder একজন প্রতিশ্রুতিশীল অলরাউন্ডার, কিন্তু তিনি এখনও জ্যাক ক্যালিস বা বর্তমানের বেন স্টোকসের মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারদের কাতারে উঠতে পারেননি। লারার মতো কিংবদন্তির রেকর্ড ভাঙার জন্য যে Class এর খেলোয়াড় প্রত্যাশিত, তিনি বর্তমানে সেই স্তরে আসেন নাই।
৩. রেকর্ডের মূল্য কমে যাওয়া : ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন ও মর্যাদাপূর্ণ ফরম্যাটে রেকর্ড ভাঙার অর্থ হওয়া উচিত চূড়ান্ত ধৈর্য, দক্ষতা এবং শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে রেকর্ড ভাঙলে তা ঐতিহাসিক রেকর্ডগুলোর মূল্য কমিয়ে দেয় এবং ভবিষ্যতে রেকর্ডগুলোর প্রেক্ষাপট বোঝা কঠিন করে তোলে।
এই সমস্যার মূল কারণ: শক্তির অসমতা
টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সংকট হল দলগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড শক্তির বৈষম্য। শীর্ষ ৪-৫ দল (ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা) প্রায় সর্বদাই পরবর্তী র্যাংকের দলগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে। তারও নিচে আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান, জিম্বাবুয়ের অবস্থান। এই দলগুলো যখন শীর্ষ দলগুলোর মুখোমুখি হয়, প্রায়শই তা একপেশে (One Sided) হয়ে যায়।
ফলাফল?
বোরিং ক্রিকেট: ৫ দিনের আগেই খেলা শেষ হয়ে যাওয়া, ইনিংস পরাজয়, দর্শকদের অনুপস্থিতি।
রেকর্ডের বিকৃতি: দুর্বল দলের বিপক্ষে সহজে রান বা উইকেট পাওয়া।
আর্থিক ক্ষতি: কম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলা দর্শক ও স্পনসর আকর্ষণ করে না।
টেস্টের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়া: "এলিট" ফরম্যাটের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সমাধান: টেস্ট ক্রিকেটে টায়ার সিস্টেম (Tier System) চালু করা
উপরোক্ত সমস্যাগুলোর কার্যকর ও যৌক্তিক সমাধান হতে পারে একটি সুপরিকল্পিত টায়ার সিস্টেম বা স্তরভিত্তিক পদ্ধতি। আমার প্রস্তাবিত মডেলটি নিম্নরূপ হতে পারে :
১. টায়ার ১ (শীর্ষ স্তর):
* সদস্য: র্যাঙ্কিং অনুযায়ী শীর্ষ ৮টি দল (টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে)।
* খেলার কাঠামো: এই দলগুলো কেবল একে অপরের সাথে নিয়মিত টেস্ট সিরিজ খেলবে (হোম-অ্যান্ড-অ্যাওয়ে)।
* উদ্দেশ্য: Elite Competition নিশ্চিত করা। সমান শক্তিধর দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে, খেলার মান উন্নত হবে, ফলাফল Predictable হবেনা, রেকর্ডের সত্যিকারের মূল্য থাকবে। দর্শক ও Broadcaster রা অধিক আগ্রহ দেখাবে।
২. টায়ার ২ :
* সদস্য: শীর্ষ ৮ এর বাহিরের র্যাঙ্কিংধারী দলগুলো (যেমন: আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান, জিম্বাবুয়ে) এমনকি সেটা বাংলাদেশের জন্যেও প্রযোজ্য
* খেলার কাঠামো: এই দলগুলো নিজেদের মধ্যে নিয়মিত টেস্ট সিরিজ খেলবে। এছাড়াও, তাদের জন্য টায়ার ১ দলগুলোর বিপক্ষে খেলার সুযোগ থাকবে (Promotion/Relegation Playoff) এর মাধ্যমে।
* উদ্দেশ্য: উন্নয়ন এবং দলগুলো সমান শক্তির প্রতিপক্ষের সাথে প্রতিযোগিতা করে অভিজ্ঞতা অর্জন, আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর এবং টেস্ট ক্রিকেটে টিকে থাকার দক্ষতা বিকাশের সুযোগ পাবে। একপেশে খেলা কমবে।
৩. Promotion & Relegation :
* এটি টায়ার সিস্টেমের সবচেয়ে Important & Dynamic দিক।
* প্রতি Cycle ২ বছর পর পর, টায়ার ১-এর সর্বনিম্ন র্যাঙ্কিংধারী দল এবং টায়ার ২-এর শীর্ষ র্যাঙ্কিংধারী দল (বা চ্যাম্পিয়ন) একটি বা একাধিক টেস্ট ম্যাচের সিরিজে মুখোমুখি হবে।
* এই প্লে-অফ সিরিজের বিজয়ী, পরবর্তী cycle এর জন্য টায়ার ১-এ খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে।
* পরাজিত দল টায়ার ২-এ অবনমিত হবে (বা থাকবে)।
* উদ্দেশ্য: টায়ার ১-এ স্থান ধরে রাখার জন্য দলগুলোর ক্রমাগত ভালো করতে হবে। টায়ার ২-এর দলগুলোর টায়ার ১-এ ওঠার দৃঢ়তা ও লক্ষ্য থাকবে।
টায়ার সিস্টেমের Benefits :
প্রতিদ্বন্দ্বিতার মান উন্নয়ন: টায়ার ১-এ শুধুমাত্র শক্তিশালী দলগুলোর মধ্যে খেলা হলে প্রতিটি ম্যাচই হবে Competitive and professional
রেকর্ডের সত্যিকারের মূল্য রক্ষা: Top Tier এ রেকর্ড ভাঙা হবে প্রকৃত প্রতিভা ও কঠিন Competition এর প্রমাণ (যেমন লারা নিজেই করেছিলেন), দুর্বল দলের বিপক্ষে সহজ রানের বিনিময়ে নয়।
নিচের দলগুলোর জন্য তখন নিজেদের ক্রিকেটের উন্নয়নের সাথে তাদের সেরা খেলা টা খেলার চেষ্টা করবে
টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা সংরক্ষণ: Top Tier এর দলগুলোর মধ্যে নিয়মিত প্রতিযোগিতা টেস্ট ক্রিকেটকে তার "এলিট" স্থান ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
তবে এখানে চ্যালেঞ্জ রয়েছে :
আর্থিক প্রভাব: টায়ার ২-এ অবনমিত বড় দলগুলোর (যেমন ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশ) আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। এর জন্য ক্ষতিপূরণ বা বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে।
টায়ার ২-এর জন্য অর্থায়ন: টায়ার ২-এর দলগুলো যাতে টেস্ট ক্রিকেট চালিয়ে যেতে পারে, তার জন্য ICC-এর Sponsorships বাড়ানো জরুরি।
দর্শক আকর্ষণ: টায়ার ২ টেস্ট ম্যাচে দর্শক আকর্ষণ করা চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে সমান শক্তির দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা একপেশে খেলার চেয়ে ভালো দর্শনীয় হতে পারে।
উপসংহার:
Wiaan Mulder-এর ঘটনা শুধু উপসর্গ মাত্র, মূল সমস্যা হল টেস্ট ক্রিকেটে দলগুলোর মধ্যে clear শক্তির বৈষম্য। এই বৈষম্য শুধু রেকর্ডকেই অসম্মান করছে না, টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার মান কেও হুমকির মুখে ফেলছে। একটি সুপরিকল্পিত টায়ার সিস্টেম, যেখানে শীর্ষ দলগুলি নিজেদের মধ্যে খেলে, বাকি দলগুলোর জন্য আলাদা Tier ও Promotion এর সুযোগ থাকে, তা এই অবস্থার সবচেয়ে Logical Solutions হতে পারে। এটি Top Tier এ বিশ্বমানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করবে, ঐতিহাসিক রেকর্ডের মর্যাদা রক্ষা করবে এবং বাকি ক্রিকেট দল গুলো কে টেস্টে টিকে থাকার ও এগিয়ে যাওয়ার বাস্তব সুযোগ দেবে। ক্রিকেটের এই প্রাচীন ফরম্যাট কে ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত ও প্রাসঙ্গিক রাখতে আইসিসি এবং ক্রিকেট বোর্ডগুলোর উচিত Tier System এর প্রস্তাবটি গভীরভাবে বিবেচনা করা।
শক্তির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনাই হোক টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যতের মূলমন্ত্র।
©Nazmus Sakib Shoeb | Inside Edge | 07.07.2025