08/05/2024
⭕থ্যালাসেমিয়া সাংঘাতিক মানের রক্তস্বল্পতা রোগ।
প্রতিরোধ ঃ
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা খুবই সম্ভব। এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনই থ্যালাসেমিয়া বাহক বা একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক এবং একজন হিমোগ্লোবিন ই এর বাহক হয় তবে প্রতি গর্ভাবস্থায় –
এ রোগে আক্রান্ত শিশু জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ।
বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৫০ভাগ।
আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ।
স্বামী স্ত্রী দুজনের যেকোনো একজন যদি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকেন, তাহলে নবজাতকের থ্যালাসেমিক হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। তবে নবজাতক থ্যালাসেমিয়ার বাহক হতে পারে যা কোন রোগ নয়।
তাই এ রোগের বাহকদের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত এবং প্রতিহত করার মাধ্যমে সমাজে নতুন থ্যালাসেমিক শিশুর জন্ম হ্রাস করা যায়। সুতরাং, দেরি না করে আজই থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় এর জন্য হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামক পরীক্ষাটি করান এবং আপনার শিশুকে এর অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখুন।
এছাড়া ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থাৎ যেসব পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী দুজনই এ রোগের বাহক অথবা যাদের এক বা একাধিক থ্যালাসেমিক শিশু আছে তারা গর্ভস্থ ভ্রুণ পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য থ্যালাসেমিক শিশু নির্ণয় এবং তা পরিহার (গর্ভপাত) করতে পারেন। গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করালে ভালো হয়।
গর্ভস্থ সন্তানের থ্যালাসেমিয়া জানার জন্য যে পরীক্ষাগুলো করতে হবে :
কোরিওনিক ভিলিয়াস স্যাম্পলিং (Chorionic villus sampling)
অ্যামনিওসেনটিসিস (Amniocentesis)
ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং (Fetal blood sampling)
তাহলে আমাদের অনাগত প্রজন্ম যাতে থ্যালাসেমিয়ার মত একটি ভয়াবহ রোগ নিয়ে না জন্মায়, তার জন্য আমাদের প্রত্যেককে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
থ্যালাসেমিয়া বংশগত রোগ। সংক্রামক বা ছোঁয়াচে নয়। এটি পিতামাতার কাছ থেকে সন্তানের মধ্যে আসে। মা-বাবা দুই জনেই যদি রোগী হয় তা হলে সুস্থ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদি মা-বাবার একজন রোগী হয় অন্যজন সুস্থ হয় তাহলে কিছু সন্তান বাহক হবে, কিন্তু সুস্থ হবে। রোগটি মা-বাবার থেকেই সন্তানের মধ্যে সঞ্চালিত হয়। তাই যদি বিবাহ করার পূর্বে রক্তের পরীক্ষা করে নেওয়া যায় যে পাত্র বা পাত্রী কেউই বাহক বা রোগী নয় তা হলে রোগটি সঞ্চালিত হতে পারবে না।
থ্যালাসেমিয়া একটি জন্ম গত বা বংশগত রোগ। এটি একটি ল্যাটিন নাম। নামটি দুভাগ করে পাওয়া যায় ‘থ্যালাসা’ অর্থ সাগর এবং ‘মিয়া’ অর্থ রক্ত। চিকিৎসাক্ষেত্রে অতিরিক্ত রক্তের প্রয়োজন বলেই হয়তো এর নাম রক্তসাগর। থ্যালাসেমিয়ার প্রধান পরিচায়ক লক্ষণ হল–শিশুর রক্তে লোহিত কণিকা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধ্বংস হতে শুরু করে ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
কারণ জিনগত রোগ থ্যালাসেমিয়া। যদি বাবা ও মা দু’জনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন তবে তাদের সন্তানাদি থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে। স্বাভাবিক রক্তের হিমোগ্লোবিনে মোট ৮ জোড়া জিনের মধ্যে
আলফা বিটা ও গামা বা ডেল্টা:
চেইন থাকে। যখনই কোন চেইনের ঘাটতি হয়, তখনই এই রোগের সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিক রক্তে আলফা ও বিটা চেইন থাকে ৯৭% এবং শিশুদের ক্ষেত্রে আলফা ও গামা চেইন থাকে = ৭০–৯০%. তিন প্রকার হিমোগ্লোবিনের মধ্যে অন্যতম হল ফিটাল হিমোগ্লোবিন। শিশুর জন্মের পর এক মাস বয়সে তা কমে ২৫ ভাগে দাঁড়ায় এবং ৬ মাস বয়সে তা নেমে আসে ৫% এ। ফিটাল হিমোগ্লোবিন হ্রাস পেয়ে এডাল্ট হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি পায় এবং তা ৯০–৯৫% এ উন্নীত হয়। এই যে পরিবর্তন তা সুস্থ শিশুতে দেখা যায়। কিন্তু কোন কারণে এর ব্যতিক্রম ঘটলে সৃষ্টি হয় থ্যালাসেমিয়া।
থ্যালাসেমিয়াকে সাধারণত দুইভাগে ভাগ করা হয়:
(১) আলফা থ্যালাসেমিয়া :
যখন জিনে আলফা চেইনের সিনথেসিস ঠিকমত হয় না তখন অতিরিক্ত পরিমাণে বিটা বা গামা চেইন তৈরি হওয়ার দরুন আলফা থ্যালাসেমিয়ার সৃষ্টি হয়।
(২) বিটা থ্যালাসেমিয়া:
যখন বিটা চেইনের সিনথেসিস ঠিকমত না হওয়ায় গামা বা ডেল্টা চেইন অতিরিক্ত তৈরি হয় তখন বিটা থ্যালাসেমিয়া রোগের সৃষ্টি হয়।
লক্ষণ :
(১) শিশুকাল থেকে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় এবং ক্রমশ: বৃদ্ধি পায়।
(২) অনেক সময় রক্তের লোহিতকণিকা অতি দ্রুত ভেঙ্গে গেলে হিমোলাইটিক জন্ডিস দেখা দেয়।
(৩) শরীরে সর্বদা দুর্বলতা ও অবসাদ থাকে এবং মুখমণ্ডল খুব ফ্যাকাশে দেখায়।
(৪) শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঠিকমত হয় না।
(৫) লিভার ও প্লীহা বৃদ্ধি পায়। কখনও কখনও প্লীহা খুব বড় হয়।
(৬) অনেক সময় গালের হাড় খুব উঁচু হওয়ায় শিশুকে মঙ্গোলিয়ানদের মত দেখায়।
(৭) মাথার হাড় এবং অন্যান্য লম্বা হাড়ের একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়।
(৮) অনেক সময় প্রচণ্ড রক্তস্বল্পতায় ভোগার দরুন হৃৎপিন্ড বৃদ্ধি পায় ও অনেক সময় কার্ডিয়াক ফেইলিওর হতে দেখা যায়।
(৯) লোহিত কণিকা অতি দ্রুত ভেঙ্গে যাওয়ার দরুন পিত্তপাথর তৈরি হয়ে যন্ত্রণা হতে পারে।
(১০) অনেক সময় নাক হতে রক্ত পড়ে।
(১১) অনেক সময় শরীরের চামড়ায় কালচে ভাব হয় ও পায়ে ঘা এর সৃষ্টি হয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগ হয়েছে কিনা জানবেন কীভাবে:
১। রক্ত পরীক্ষায় সিরাম বিলিরুবিন লেভেল খুব বেশি থাকে।
২। প্লাজমা হেপাটোগ্লোবিন লেভেল খুব কমে যায়।
৩। প্লাজমা হিমোপেক্সিন লেভেল কমে যায়।
৪। প্লাজমা ফ্রি–হিমোগ্লোবিন, মেথেম এলবুমিন লেভেল বেড়ে যায়।
৫। প্রস্রাবে ইউরো বিলিনোজেন এবং মলে স্টারকো বিলিনোজেন লেভেল বেড়ে যায়।
৬। পেরিফেরাল রক্ত পরীক্ষায় লোহিত কণিকার সংখ্যা কমে যায় এবং রেটিকিউলোসাইটের সংখ্যা খুব বেড়ে যায়। রক্তে সিকেল সেল, স্ফেরোসাইট , এলিপটোসাইট ও টার্গেট সেল (কটরথণফ উণফফ) ইত্যাদি পাওয়া যায়।
৭। বোন ম্যারো পরীক্ষায় দেখা যায় এরিথ্রয়েড হাইপারপ্লাসিয়া।
৮। মাথার হাড়ের ডিপ্লোয়িক স্পেস বৃদ্ধি পায় ও বনি ট্রেবিকিউলি অনেক সময় দেখতে পাওয়া যায়। লম্বা হাড়ের ভেতরের গর্ত চওড়া হয়ে যায়। রোগ নিরুপনের জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। তাছাড়া মাথার খুলির এক্স–রে ও করা হয়।
৯। রেডিও এ্যাকটিভ ক্রেমিয়াম পরীক্ষার দ্বারা জানা যায় এর লাইফ স্প্যান কত। ১০। পেপার–ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষার দ্বারা জানা যায় হিমোগ্লোবিন পিকের অস্বাভাবিকতা।
মনো–দর্শন:
চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রতিটি ঔষধ কমপক্ষে ১০/১২টি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ কয়েক হাজার প্রকাশিত লক্ষণ সমষ্টির উপর পরীক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এগুলি এত সব মানুষের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার উপলব্ধি যে, মিথ্যা বলে দূরে ঠেলার বা অবজ্ঞা করার কোনও সুযোগ নেই। কারণ কোনও ওষুধকে প্যাথলজির টেস্ট ল্যাব থেকে বাস্তব সমাজ জীবনে আনতে হলে অনেক অবস্থার মধ্য দিয়ে আসতে হয়। তারপর আবার চিকিৎসক নিজে প্রুভিং করেন, রোগীকে দেন, ফলাফল যাচাই করে একটা র্ওলভঢটরঢ অবস্থানে ওষুধগুলো আসে। আগামী দিনে কোন্ কোন্ লক্ষণ সমষ্টি নিয়ে কোন্ কোন্ নামের রোগ আসবে তা বহু পূর্বেই পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয়েছে। এখন আমাদের কর্তব্য হল চিকিৎসাক্ষেত্রে উপস্থিত রোগীর লক্ষণ সমষ্টি পর্যবেক্ষণ পূর্বক যথাযথ ওষুধের প্রতিবিধান করা।
যেমন ধরুন কোন রোগী বলছে আমার শরীর অবশ ভাব, হাতে পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরা, মাথা ঘোরা, শরীর ভারীবোধ তাকে দেখতে লাগছে ফ্যাকাশে, ঘুম থেকে দেরীতে ওঠে সারাদিন ক্লান্তি ভাব, শরীর মোটা থলথলে, পাল্স পাওয়া যায় না, সর্বদাই ঝিমুনি ব্যারাম চিন্তায় ধীর গতি (চায়না, ক্যাল্কেরিয়া কার্ব, সিপিয়া) ইত্যাদি।
চিকিৎসা:
চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রথম নিয়ম হল, একসঙ্গে একটি মাত্র ওষুধ পরিবর্তনশীল শক্তিতে প্রয়োজ্য। অর্থাৎ পরিমাণে অল্প, শক্তিতে উচ্চ এবং প্রয়োগে লঘু। এক্ষেত্রে কি কি ওষুধ আসতে পারে তা বিনা বর্ণনায় উল্লেখ করছি। কিন্তু একথা চিরস্মরণীয়–কারণ বিনা যেমন কার্য্য হয় না তেমনি তিন থেকে চারটি মৌলিক ও একটি অদ্ভুত লক্ষণ না দেখে মনগড়া কোন ওষুধ রেপার্টোরাইজ করলে রোগী আরোগ্য লাভ করবে না। এ মারাত্মক ভুলের কারণে যদি রোগ দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করে তার জন্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিদ্যাকে ভূল বোঝার কোন অবকাশ নেই।
পরামর্শ:
যখন কোন যুবক যুবতী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন তার আগে তাঁরা দুজনেই বা যে কোনো একজন স্থানীয় থ্যালাসেমিয়ার পরামর্শ কেন্দ্রে গিয়ে রক্তের পেপার ইলেকট্রোফোরোসিস পরীক্ষার মাধ্যমে অবশ্যই জানবেন যে তারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। যদি পাত্র/পাত্রীর যে কোন একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন তবে তাদের অনাগত সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কম। (সংগৃহীত)