04/10/2025
একজন নারীর জন্য ট্রমা মানে কেবল শারীরিক নির্যাতন নয়, তা হতে পারে মানসিক নিপীড়ন, প্রতিদিন তাঁর অধিকার কেড়ে নেওয়া, অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে সেই সম্পর্কের পবিত্রতা নষ্ট করা, তার ভালোবাসার প্রতি অবমাননা, এসব কিছু। এসব কিছুর আঘাত একজন মানুষকে ভেতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে। মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে, আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায় এক্ষেত্রে অনেকের, অনেক সময় মানুষ মানসিক রোগী পর্যন্ত হয়ে যায়।
কেউ কি কল্পনা করতে পারে, যখন একজন নারী জানেন তাঁর সঙ্গী অন্যের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত, তখন তাঁর ভেতরে কী প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়? কী অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে তাঁকে বাঁচতে হয়? বিশেষ করে যখন তিনি আর্থিকভাবে সেই পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হয় তখন তো আরো অমানবিক হয় সেই অত্যাচার। সেই অমানবিক যন্ত্রণা কতটা নির্দয় নিস্ঠুর তা কেবল ভুক্তভোগীই জানে।
গুলতেকিন যখন লেখা শুরু করেছেন তাঁর ট্রমার কথা, তখন হুমায়ুন আহমেদ অনেক বছর আগেই প্রয়াত। হুমায়ুন আহমেদ দিনের পর দিন গুলতেকিনকে বঞ্চিত করেছেন - ভালোবাসার দিক থেকে, দায়িত্ব নেওয়ার দিক থেকে, স্ত্রী হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার থেকে। এমন একজন স্বার্থপর, অবিবেচক মানুষকে ঘৃণা করা ছাড়া আর কিছুই মনে আসে না আমার। হ্যা ব্যাক্তি হুমায়ুনকে লেখক হুমায়ুনের মত ভালোবাসা যায় না। এজন্যই হয়তো হুমায়ুন আহমেদ বিয়ে করার পর তার আর কোন বই কেনা হয়নি আমার।
আমি মনে করি আমার পার্টনার যখন অন্য কাউকে আমার জায়গায় বসায়, তার দায় সম্পুর্ন তার। যে আমার জায়গায় আসে, সে তো আসতেই পারতোনা যদি আমার পার্টনার তার বাউন্ডারি বজায় রাখতো। কারো কাছে অপশন হবার মতো অপমান, কস্ট আর কিছুতে নেই। হিন্দিতে একটা কথা আছে, মেরে সিক্কা হি খোটা নিকলা থা। এর মানে আমার পয়সাই ফুটো বের হয়েছে।
হুমায়ুন সন্তানদের দায়িত্বও পুরোপুরি নেননি। আমি মনে করি সন্তান জন্ম দিলেই কেউ বাবা হয়ে যায় না; বাবা হতে হলে দায়িত্ব নিতে হয়, পাশে থাকতে হয়। এই কথাটা কেউ কেউ জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জানেন।
গুলতেকিনের ট্রমা কয়েক বছরের নয়, এটি বহু বছরের সঞ্চিত ক্ষত। যখন তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়, তখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। তখন তিনি হয়তো সাহিত্যচর্চাতেও ততটা যুক্ত ছিলেন না। আলাদা হওয়ার পর তাঁর জীবনের একদম নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল। একজন সারাজীবনের গৃহিণীকে তখন নিজের টিকে থাকার লড়াই শুরু করতে হয়েছিল, শুধু আর্থিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও।
অনেকে বলেন, তিনি কেন মুখ খুললেন না তখন। মনে রাখবেন মানুষ সবসময় সবকিছু পারে না। তখন তাঁর সংগ্রাম ছিল অন্য জায়গায়: সন্তানদের বড় করা, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। অনেক সময় অনেক কিছু বলা যায় না, শুধু বেঁচে থাকাটাই তখন এক যুদ্ধ হয়ে ওঠে। অনেকে আছেন জীবনের প্রতি বহু কস্ট, পার্টনারের অবহেলার জন্য জীবন থেকে দূরে সরে যান। মা'রা তা পারে না। বেচে থাকেন তার সম্তানের জন্য। সেই বেচে থাকা প্রতি মুর্হুতের জন্য হয় মানসিকভাবে সাংঘর্ষিক।
গুলতেকিনের সন্তানরা ক্রমে বড় হয়েছে, জীবনের ঝড় ধীরে ধীরে থেমেছে। এখন জীবনের পরিণত বয়সে এসে তিনি হয়তো অনুভব করেছেন, এবার বলা যায়। কারণ তাঁর অভিজ্ঞতা হয়তো অন্য নারীর জন্য শিক্ষার, সাহসের উৎস হবে। হয়ত এখন তার সেই মানসিকতা হয়েছে। পর্দার আড়াল থেকে বের হবার সক্ষমতা আমি বলবো এটাকে। কয়জন পারবে আমাদের নিজেদের উপর হওয়া অবহেলা অনাদর সবার সামনে এভাবে মেলে ধরতে। এটলিস্ট আমরা অনেকেই পারবো না, সামাজিকতার ভয়ে।
কষ্ট, অপমান, অবহেলা, ছোট করা - এসব কখনও মুছে যায় না। ভালোবাসা না থাকলেও সেই তীব্র কস্ট, অপমান, অবহেলা, অবমূল্যায়নের ভার সারাজীবন মানুষ বয়ে বেড়ায়। আমৃত্যু বয়ে বেড়ায়।
Anwar আপা