06/10/2025
সে আর দশজন সাধারণ সিরিয়াল কিলারের মতো না। তার খুন করার ধরণটা আলাদা। বেশ আলাদা। সে তার শিকারের হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে জীবিত অবস্থাতেই। সেই সময় তার সেই হতভাগ্য শিকার অবর্ণনীয় আতঙ্ক আর সীমাহীন যন্ত্রণা নিয়ে নিজের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। ধীরে ধীরে ঘটে পুরো ব্যাপারটা। এখানেই শেষ না। অমন নৃশংসভাবে শিকারদের খুন করার পর এই খুনি তাদের কেটে ফেলা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে এক প্রকার বীভৎস ভাস্কর্য তৈরি করে। তারপর সেটা সাজিয়ে রেখে যায় পুলিশের জন্য।
কি, ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে এসব? হওয়ারই কথা। লস অ্যাঞ্জেলেসের সাবেক ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ডেরেক নিকোলসনকে যখন তার হাত-পা ছিঁড়ে খুন করা হলো, তখন সবার ওপরেই একটা অজানা আতঙ্ক এসে ভর করলো। হতভাগ্য নিকোলসনের লাশ আবিস্কারের পর স্বাভাবিকভাবেই কেসটা এসে পড়লো রবারি-হোমিসাইড ডিভিশনের চৌকস ডিটেকটিভ রবার্ট হান্টারের কাঁধে। একজন ক্যান্সার আক্রান্ত বৃদ্ধকে কে এমন বীভৎস ভাবে খুন করবে? আর কেনই বা তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হাত-পা দিয়ে কিম্ভূতকিমাকার ভাস্কর্য বানিয়ে রেখে যাবে?
কেসটা হাতে নিয়েই ডিটেকটিভ রবার্ট হান্টার আর তার পার্টনার ডিটেকটিভ কার্লোস গার্সিয়া অতল জলে পড়লো। এবারের এই খুনি খুবই স্মার্ট। কোন ক্লু-ই পেছনে ছেড়ে যাওয়ার অভ্যাস নেই তার। এই কেসে হান্টারদেরকে সাহায্য করার জন্য বর্তমান ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ডোয়াইন ব্র্যাডলি অ্যাপয়েন্ট করলেন তাঁরই অফিসের মেধাবী কম্পিউটার রিসার্চার এলিস ব্যোমন্টকে। এদিকে উন্মাদ সেই খুনির মরণ-তাণ্ডব যেন থামছেই না। এবারে খুন হয়ে হয়ে গেলেন এক রিটায়ার্ড পুলিশ ডিটেকটিভ। এবারেও পাওয়া গেলো একটা বীভৎস ভাস্কর্য। খুনি আসলে পুলিশকে কি মেসেজ দিতে চাইছে?
পোড় খাওয়া ডিটেকটিভ রবার্ট হান্টার এবার এমন এক খুনির পেছনে ছুটছে, যে নিজেকে বেশ ভালোভাবেই আড়াল করে রাখতে জানে। সে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলো, খুনিকে যতো দ্রুত সম্ভব থামাতে হবে। আর সেটা না পারলে নিজেকে আর্টিস্ট ভাবা এই উন্মাদ খুনি আরো কিছু ছিন্নভিন্ন মানবদেহের ভাস্কর্য রেখে যাবে তাদের জন্য। হান্টার কি পারবে খুনিকে ঠেকাতে? নাকি এবার নিজের চেয়েও স্মার্ট কারো কাছে হার মেনে নিতে হবে ওকে?
'দি ডেথ স্কাল্পটর' ক্রিস কার্টারের রবার্ট হান্টার সিরিজের চতুর্থ বই। বরাবরের মতোই এখানে এক সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলারের মুখোমুখি করা হয়েছে ডিটেকটিভ রবার্ট হান্টারকে। ক্রিস কার্টারের এই সিরিজটার পূর্ববর্তী বইগুলোতে অ্যান্টাগনিস্ট হিসেবে যাদেরকে দেখানো হয়েছে তারা সবাই বেশ ধুরন্ধর সাইকোপ্যাথ। 'দি ডেথ স্কাল্পটর' বইয়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এখানে যে খুনিকে লেখক সামনে নিয়ে এসেছেন তার খুন করার আলাদা তো বটেই, সেই সাথে পৈশাচিকতায় ভরা। ক্রিস কার্টার যেভাবে ক্রাইম সিনের বর্ণনা দেন, তাতে পুরো ব্যাপারটাই যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। তাঁর এই বইয়ে সেই বর্ণনাগুলো যেন একটু বেশিই গ্রাফিক লেগেছে আমার কাছে। ক্রাইম সিনের বর্ণনার পাশাপাশি ফরেনসিকের বর্ণনারও একই অবস্থা। ক্রিস কার্টারের রবার্ট হান্টার সিরিজ নিয়ে বরাবরই আমি যা বলি, এবারও তাই বলবো। সেটা হলো, এই সিরিজটা মোটেও দুর্বল হৃদয়ের পাঠকদের জন্য না।
পুরো উপন্যাস জুড়ে প্রোটাগনিস্ট রবার্ট হান্টারের তদন্ত প্রক্রিয়া ছিলো উপভোগ্য। ঠান্ডা মাথার ধীরস্থির এই জিনিয়াস ডিটেকটিভের কাজকর্ম আমি বরাবরই বেশ উপভোগ করি। 'দি ডেথ স্কাল্পটর'-এও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পার্টনার ডিটেকটিভ কার্লোস গার্সিয়ার সাথে তার বন্ডিংটাও বরাবরের মতো ভালো লেগেছে। ক্রিস কার্টার এবারও বইয়ের ছোট ছোট অধ্যায়গুলোর শেষে একটার পর একটা সাসপেন্স বিল্ড করতে করতে এগিয়েছেন। আর এভাবেই যখন শেষটা এসেছে, ধাক্কার মতো খেয়েছি। মনে হয়েছে পাপের গল্প তো পড়েছি। এবার পাপের পেছনের পাপের গল্পটাও পড়া হলো। ক্রিস কার্টার আবারও মানুষের মনের ভেতরের পশুর সাথে পাঠককে মুখোমুখি করলেন বেশ সফলভাবে।
কয়েক সপ্তাহ আগে আমি রবার্ট হান্টার সিরিজের তৃতীয় বই 'দ্য নাইট স্টকার' পড়েছিলাম। সেটা পড়ার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর কিছু ছিলো না। 'দি ডেথ স্কাল্পটর' সেটার তুলনায় ভালোই লেগেছে। তবে কাছাকাছি সময়ে সিরিজের দুটো বই পড়ার কারণে অনেক জায়গাতেই একঘেয়ে লেগেছে। ক্রিস কার্টারের গল্প বলার ধরণ চিত্তাকর্ষক হলেও তা সবসময় একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নই ফলো করে চলে। শুধু অ্যান্টাগনিস্ট আর তার কর্মপদ্ধতি আলাদা হয়। উল্লেখ করার মতো কোন আউট অভ দ্য বক্স কিছু 'দি ডেথ স্কাল্পটর'-এ পেয়েছি, এমনটা বলতে পারছি না। এরপর একটা লম্বা বিরতি না নিয়ে রবার্ট হান্টার সিরিজের কোন বই ধরবো না সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
রাইদ রাফসানের অনুবাদ ভালো লেগেছে। ভালো মানে বেশ ভালো। তাঁর অনুবাদ এতোটা সুখপাঠ্য হবে, তা আমার নিজেরও এক্সপেকটেশন ছিলো না। ভবিষ্যতে তাঁর অনুবাদ চোখ বন্ধ করে কিনতে পারবো। কিছু জায়গায় দুই-একটা ভুল-ভ্রান্তির দেখা পেয়েছি। যেমন ডিস্ট্রিক্ট শব্দটাকে সব জায়গাতে ডিস্ট্রিক লেখা হয়েছে। বিস্ফারিত শব্দটাকে লেখা হয়েছে বিস্ফোরিত। ফন্টের গোলযোগের কারণে ব্র্যাডলি শব্দটার যুক্তবর্ণ ভেঙে যাওয়া লক্ষ্য করেছি সব জায়গায়। আরেকটা জায়গায় একটু খটকা আছে আমার। সেটা হলো, বইয়ের প্রায় সব নারী চরিত্রের চুলের বর্ণনাতেই সাদা চুল কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লেগেছে আমার কাছে। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিলো যেন টার্গেরিয়ান ফ্যামিলির নারীদের চুলের বর্ণনা পড়ছি। এটা কি অনুবাদকের ভুল নাকি মূল বইয়েই এমন সাদা চুল বিষয়ক বর্ণনা দেয়া আছে, আমি ক্লিয়ার না।
পরাগ ওয়াহিদের করা প্রচ্ছদটা চমৎকার লেগেছে। বইটার প্রোডাকশন নিয়েও আমি স্যাটিসফায়েড। আগ্রহীরা চাইলে পড়ে ফেলতে পারেন 'দি ডেথ স্কাল্পটর'।
বই: দি ডেথ স্কাল্পটর (রবার্ট হান্টার # ৪)
লেখক: ক্রিস কার্টার
অনুবাদ: রাইদ রাফসান
প্রকাশক: নয়া উদ্যোগ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ঘরানা: সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার
প্রচ্ছদ: পরাগ ওয়াহিদ
পৃষ্ঠা: ৩৯৫
মুদ্রিত মূল্য: ৭০০ টাকা
ফরম্যাট: হার্ডকভার
রিভিউঃ দ্বীপ দা