14/09/2024
সাংগঠনিক শক্তিতে বিএনপি অপ্রতিদ্বন্দ্বী!
তাদের চুড়ান্ত বিজয় কতদূরে?
আব্দুল বারী :
১৬/১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সংগে লড়তে লড়তে বিএনপি এখন সাংগঠনিক শক্তিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলে পরিনত হয়েছে। বিএনপিকে হটিয়ে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তি দেশে নেই বললেই চলে। ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রভূত্ব এখন "প্রকট"।
এমতাবস্থায় নির্বাচন হলে বিএনপির ল্যান্ড স্লাইড বিজয় অনিবার্য। বিএনপির এই "প্রভূত্ব" কত দিনে তাদের দেশের শাসন ব্যবস্থায় ফেরাবে তা এখনো নিশ্চিত নয় বলে কেউ কেউ বলছেন।
২৮ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহা সচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাঁরা এখনো ১/১১ কথা ভুলে যাননি। যখন ওই চেহারাগুলো সামনে আসে, তখন যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়, প্রশ্ন এসে যায়। এক-এগারোর মতো বিএনপিকে লক্ষ্য করে, বিরাজনীতিকীকরণের চেষ্টা হচ্ছে।
৩০ আগস্ট রাজশাহী বিভাগের নেতা কর্মীদের সাথে মতবিনিময়ের সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন আগামী নির্বাচন হবে একটি কঠিন পরীক্ষার নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফলের জন্য বিএনপি সবসময়ই জনসমর্থনের ওপর নির্ভরশীল।'
এই দুটি বক্তব্যের মধ্যে কিসের যেন একটি ছায়া দেখা যাচ্ছে। এই ছায়া দেখে কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি এবার ক্ষমতায় আসতে পারবে কি?
আমি বলছি নিশ্চয়ই পারবে। না পারার তো কোনো কারণ দেখছিনা। তারপরও এমন প্রশ্ন এখন কেন? এ প্রশ্ন তো ছিল ৫ আগস্ট এর আগে। তাহলে ৫ আগস্ট এর পরও কেন এমন প্রশ্ন? এর উত্তর খুঁজতেই আজকের এই প্রতিবেদন।
একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় যেতে হলে তার প্রথম প্রয়োজন হয় সংগঠন। তারপর লাগে জনপ্রিয়তা। এর সবই তো বিএনপির আছে। সাংগঠনিক শক্তিতে বর্তমানে বিএনপি'র ধারে কাছেও কোন রাজনৈতিক দল নেই।
বাংলাদেশের জনমত সবসময়ই দুইভাবে বিভক্ত। এর একটি হল প্রো আওয়ামী লীগ। অপরটি হল এন্টি আওয়ামী লীগ। একইভাবে যদি বলা হয় তাহলে বলতে হবে একটি হলো প্রো বিএনপি। অপরটি হল এন্টি বিএনপি।
এছাড়াও আরও যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তার প্রায় সবগুলিই দুই জোটে বদ্ধ। তার বাইরে যারা আছে তাদের আকার একেবারেই অনুবিক্ষনিক।
৯০ এর গণ আন্দোলনের পর তত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৯৯১ সনের ২৭ জানুয়ারীর সেই নির্বাচনে ভোটার ছিল ছয় কোটি ২১ লাখ ৮১ হাজার সাতশত ৪৩ জন।
এই নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল এক কোটি ০৫ লাখ ০৭ হাজার ০৫ শ' পয়তাল্লিশ ভোট। প্রাপ্ত ভোটের রেশিও ছিল ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ। আসন সংখ্যা ছিল ১৩৬ টি।
আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ০১ কোটি ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮ শত ৬৬ ভোট। প্রাপ্ত ভোটের রেশিও ছিল ৩০ দশমিক ০১ শতাংশ। আসন সংখ্যা ছিল ৯২ টি।
এই হিসাবে দেখা যায় বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে ২ লাখ ৪৭ হাজার ০৬শ' ৮৩ ভোট বেশি পেয়েছিল। একই হিসাবে ৪৪ টি আসনও বেশি পায়।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ৬ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন বিএনপি একক ভাবে নির্বাচন করে। আন্দোলনের মুখে মাত্র ১৫ দিনে নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। কাজেই এই নির্বাচনের কথা বাদ।
১৯৯৬ সনের ১২ জুন তত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে অনুষ্ঠিত হয় ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ০১ কোটি ৫৮ লাখ ৮২ হাজার ০৭শ' ৯২ ভোট। প্রাপ্ত ভোটের রেশিও ছিল ৩৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। আসন ছিল ১৪৬টি।
বিএনপি পেয়েছিল ০১ কোটি ৪২ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯ শ' ৮৬ টি। প্রাপ্ত ভোটের রেশিও ছিল ৩৩ দশমিক ০৬ শতাংশ। আসন ছিল ১১৬টি।
এই হিসাবে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে ১৬ লাখ ২৬ হাজার ০৮শ' ০৬ ভোট বেশি পেয়েছিল। একই হিসাবে ৩০টি আসন বেশি পায়।
২০০১ সনের ০১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ০২ কোটি ২৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯ শ' ৭৮ ভোট। প্রাপ্ত ভোটের রেশিও ছিল ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আসন ছিল ১৯৩ টি।
আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ০২ কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার ০৫ শ' ১৬ ভোট। প্রাপ্ত ভোটের রেশিও ছিল ৪০ দশমিক ১৩ শতাংশ। আসন সংখ্যা ছিল ৬২ টি।
ভোটের পার্থক্য ছিল ০৪ লাখ ৬৮ হাজার ০৪শ' ৬২ টি। আসনগত পার্থক্য ছিল ১৩১ টি।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ০৩ কোটি ৩৮ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫১ ভোট। ভোটের রেশিও ছিল ৪৯ দশমিক ০০ শতাংশ। আসন সংখ্যা ছিল ২৩০টি।
বিএনপি পেয়েছিল ০২ কোটি ২৯ লাখ ৬৩ হাজার ০৮শ'৩৬ ভোট। ভোট রেশিও ছিল ৩৩ দশমিক ২০ শতাংশ। আসন সংখ্যা ছিল ৩০টি।
ভোটের ব্যবধান ছিল ০১ কোটি ৯ লাখ ২৩ হাজার ৬১৫। আসনের ব্যবধান ছিল ২০০ টি।
১৯৯১ সনের ২৭ জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সনের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পঞ্চম ষষ্ঠ সপ্তম অষ্টম নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যতীত সব নির্বাচনই অংশগ্রহণমূলক হয়েছে।
সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সপ্তম অষ্টম ও নবম সহ ৪ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে ভোট পড়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তার নিরিখে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি অনেকটাই সমান্তরাল।
২০১৪ সনে দশম ২০১৮ সালে একাদশ ও ২০২৪ সনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এককভাবে করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে।
জনপ্রিয়তা হারালেও তাদের সাংগঠনিক শক্তি বিদ্যমান ছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করায় দলের প্রকৃত ত্যাগী নেতা এবং কর্মীরা দল থেকে ছিটকে পড়ে। সেই সুযোগে দলে শুরু হয় হাইব্রিড রাজনীতির চর্চা।
কেন্দ্রীয় হাইব্রিড নেতা মাহাবুবুল আলম হানিফ অনৈতিক বানিজ্যে লিপ্ত হয়ে রূট লেবেল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত হাইব্রিডদের জয়জয়কার অবস্থান তৈরি করে ফেলেন।
হাইব্রিডদের দাপটে টিকতে না পেরে দলের ত্যাগী নেতা কর্মীরা দল থেকে ছিটকে পড়েন। একইভাবে করোনা পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বেষ্টনীর কাজে নিয়োজিতদের সিন্ডিকেটের মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলেন।
এই সিন্ডিকেট কে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার সাথে তার দলের মন্ত্রী এমনকি সিনয়র নেতাকর্মীরাও দেখা করতে পারতেন না। এতে তিনি পুরোপুরি জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতে গিয়ে দল ও জোটের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন শেখ হাসিনা নিজে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নিজের দলের কর্মীদের বিরুদ্ধেই ভোটে লিপ্ত হন। ভোটের পর একে ওপরের জানের শত্রু হয়ে লড়াই শুরু করেন। এতেই শেষ হয়ে যায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি।
এরপর ট্যাক্স বৃদ্ধি দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতি দুর্নীতি অবিচার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তান্ডব তাকে এবং তার দলকে নি:শেষ করে দেয়। এতে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ও জনপ্রিয়তায় জিরো পজিশনে চলে যায়। যার জলন্ত উদাহরণ ৫ আগষ্টের গণ অভ্যুত্থান।
সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তায় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের স্ট্যাটাস ছিল প্যারালাল। ৫ আগস্ট এর গণ অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। একথা এখন বলা যেতেই পারে।
সেই হিসাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে বিএনপি'র সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তা এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে। তাদের সাংগঠনিক শক্তির কাছে কে যে ম্রিয়মাণ নয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এমতাবস্থায় যদি নির্বাচন হয় তাহলে বিএনপির বিজয় সুনিশ্চিত। আবার কোন শক্তি যদি মনে করে নির্বাচন না দিয়ে অনির্বাচিত থেকেই রয়ে যাবে, তা একেবারেই অসম্ভব। এমন ক্ষেত্রে তাদের আন্দোলন দমানোর অবস্থানও কারো নেই।
কাজেই একথা বলা যেতেই পারে যে বিএনপির ক্ষমতারোহন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
তবে জনগণের চোখে দুই দলের প্রকৃতি প্রায় সমান। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যে অত্যাচার অনাচার করেছে তা থেকে বিএনপির অবস্থান স্বচ্ছ হওয়া দরকার। তা না হলে ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের বিজয় ঢেকুর বিএনপির জন্য হরিষে বিষাদ হতে সময় নিবে বলে মনে হয়না।