26/08/2021
অপরাজেয় ইসলামী বিশ্ব : খ্রিস্টীয় আদর্শ 'সার্বজনীন' মনে করার মূর্খতাকে আফগানিস্তান উন্মোচন করে দিয়েছে
-
আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পুরো সময়জুড়ে কী কী ভুল হয়েছে, সেটা নিয়ে দশকের পর দশক ধরে ইতিহাসবিদ, যুদ্ধবিশারদ এবং রাজনীতিবিদদের বিতর্ক চলমান থাকবে। কিন্তু বহু বছর ধরেই খুব সহজ যে বিষয়টি স্পষ্ট, তা হলো আমরা (পশ্চিমারা) প্রচেষ্টার অভাবে এই যুদ্ধে পরাজিত হইনি। বরং এই পরাজয়ের কারণ হচ্ছে, আমাদের সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির একার পক্ষে ইসলামি দুনিয়াকে দীর্ঘমেয়াদে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
৯/১১ এর বিচার করতে গিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ২০ বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছিল। কিন্তু দ্রুতই একটি সার্বজনীন সভ্যতা তথা রাজনৈতিক সম্প্রদায় নির্মান করতে গিয়ে সেখানে আমরা যেসব মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছিলাম, সমগ্র বিশ্বের মানুষ আমাদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হবে বলেই আমরা ধারণা করেছিলাম। একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে, রাজনীতি সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল আর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে ধর্মের আদলে। যুক্তরাষ্ট্র যে খ্রিস্টধর্মের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগানিস্তান যে ইসলামের কারনেই আফগানিস্তান— এটা আমরা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছি।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন যথার্থই বলেছিলেন যে, ইসলামি সমাজব্যবস্থা একটি স্বতন্ত্র সভ্যতার ভিত্তিতে দন্ডায়মান যা বলপূর্বক বিদেশি মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টাকেই তা প্রতিরোধ করে। আমরা এই যুক্তি স্বীকার করি কিংবা না-ই করি, আমাদের গচ্চা যাওয়া ট্রিলিয়ন ডলার, হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার জীবন এবং দুই দশকের যুদ্ধ কিন্তু এরচেয়ে ভিন্ন কিছু প্রমাণ করেনা।
তবুও, অনেকেই স্পষ্ট সত্যকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, লিবিয়া এবং নাইজেরিয়ার সহিংসতাকে আপাতদৃষ্টিতে অসম্পর্কিত মনে হলেও আসলে এর সাধারন মতাদর্শ ও কর্মীদের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য একই। কিন্তু এগুলোর মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের কূটনীতিক ও কৌশলবিদরা এই দিকটিকে উপেক্ষা করে সকলক্ষেত্রে একই প্রতিক্রিয়া দেখাতে চান। সিরামিকের টিলায় পা পর্যন্ত ডুবে থাকা অদূরে দাঁড়ানো হাতিকে লক্ষ্য না করে ঘরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সিরামিকের টুকরোগুলোকে যেনো তারা সযত্নে আঠা দিয়ে যুক্ত করে চলছেন।
মূলত সকল মানুষকে সমান এবং পরিবর্তনীয় সত্তা হিসেবে (যাদের কাছে ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতি হলো দ্বৈব দূর্ঘটনার ফল) দেখার মহৎ আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অন্ধত্বের উদ্ভব। কিন্তু এই কথিত দুর্ঘটনাই লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে ধ্রুব সত্য, যার পক্ষে যুদ্ধ নেমে আত্নসমর্পণের বদলে তারা মৃত্যুকেই বেঁছে নিবে। এটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়া আমাদের আত্মিক শূন্যতার লক্ষণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার খ্রিস্টীয় গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে বুঝতে পারছে না যে, বিশ্বাস কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সংঘবদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
‘বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য’ -এর মত আবেগী ধারনা একীভূত ইসলামী বিশ্বের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। মুসলমানদের নিজেদের এই ধরনের বক্তব্য কিংবা ইন্দোনেশিয়া ও মরক্কোর মধ্যকার স্থানীয় বৈচিত্র্য যে মুসলিম জাতীয়তাবাদের মৌলিক সংঘবদ্ধতাকে ক্ষুণ্ন করে না- সেটা খেয়াল রাখতে হবে। ইসলাম নামের ঘরটিতে অনেকগুলো কক্ষ থাকলেও এর খুঁটি সংখ্যা অল্পই। ‘আল্লাহর চূড়ান্ত বাণী কুরআন সমস্ত মানবজাতির জন্য অবতীর্ণ হয়েছে’, ‘ধর্মবিশ্বাস ব্যক্তিগত ইবাদতের পাশাপাশি সার্বজনীন আইনের সাথেও সম্পর্কিত’, ‘ইসলামি আইনে পরিচালিত রাস্ট্রে বসবাস করা উত্তম’, এবং ‘সম্ভব হলে মুসলমানদের উচিত অমুসলিমদের উপর বিজয়ী হওয়া যাতে আল্লাহর আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যায়’— এসব মৌলিক চিন্তাই তা লে বা ন, আ ল-কা য়ে দা এবং হা মা স এর মতো দলগুলোকে ইসলামের ঐতিহাসিক ভূখন্ড দখলে রাখা ‘ইহুদি ও ক্রুসেডারদের’ বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্ধুদ্ধ করে। কিন্তু তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো মোটেই চরমপন্থা নয়৷ অধিকাংশ মুসলমানই সেগুলোকে আদর্শ হিসেবে দেখে, যদিও তদানুসারে তারা আমল করতে পারে না। নতুন প্রবণতা হয়তো পরিবর্তিত সময়ের সূচনা করতে পারে।
চারটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বন্ধুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি ছিল একটি ঝুকিপূর্ণ ও স্থুল পদক্ষেপ, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ধর্মপ্রান ও ধর্মনিরপেক্ষ নির্বিশেষে সকল মুসলমানই যেখানে ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মধ্যকার ইহুদীয় যোগসূত্রতার ব্যাপকভাবে বিরুদ্ধাচরণ করে, সেখানে এ ধরনের কাজ এখনও অসঙ্গতই। রক্ষনশীল মতবাদগুলোকে উদারতার সবক দিতে চাওয়া লোকেরা সাহসী হলেও তারা এখনো সংখ্যালঘু।
ইসলামী বিশ্বকে পরিবর্তন করতে না পারলেও বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে পাশ্চাত্যের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। পিছু হটা থেকে শুরু করে দমন, মূল্যবোধ ও আইন প্রতিষ্ঠা করার বদলে মার্কিন স্বার্থ ও তার মিত্রদের প্রতিরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়াই এক্ষেত্রে সেরা কৌশল। আমেরিকান মুসলমানরা স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য নাগরিকদের মতো একই অধিকার লাভ করে। যেসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা স্থাপন করতে চায়, বিশেষ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, তারা যখন কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়- তখন তাদেরকে সাদরে গ্রহন করে নেওয়াই উচিত। মার্কিন সরকার সহিংসতার মাঝে আটকে পড়া অমুসলিমদের জন্য বিশেষ উদ্বেগের পাশাপাশি আন্তঃ মুসলিম লড়াইয়ে হতাহতদের মানবিক সহায়তা প্রদানও চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বাগ্রে পিছু হটতে হবে। মার্কিন মূল্যবোধকে সম্মান করার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে এই মূল্যবোধের প্রত্যাখ্যানকারীদের উপর একে জোর করে চাপিয়ে দেয়া বন্ধ করা।
একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রই মুসলমানদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। ওয়াশিংটনকে অবশ্যই তাদের মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংগঠিত সমাজ তৈরির অধিকার মেনে নিতে হবে; কারন একটা সময়ে তারা এটা করেই ছাড়বে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত সীমাকে অতিক্রম করলেও আমরা চুপ থাকবো৷ তবে এ কাজ করার অধিকার যে তাদের রয়েছে, এটাকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে।
ইসলামি দুনিয়ার পরিবর্তন হতেও পারে আবার নাও হতে পারে৷ কিন্তু এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া কখনোই আমাদের দায়িত্বের মধ্যে ছিল না। যে আত্মিক পীড়া আমাদেরকে অন্ধ করে রেখেছে, সেটা নিরাময়ের উপরেই আমাদের অধিক মনোযোগ দেওয়া উচিত। তাহলেই আমরা আমাদের নিজস্ব সভ্যতার অনুভূতিকে পুনরুদ্ধার করতে পারবো এবং তদানুযায়ী আমাদের অগ্রাধিকারগুলিকে পুনর্বিন্যাস করতে সক্ষম হবো।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রকাশিত
The Unconquerable Islamic World :
Afghanistan shows the folly of mistaking Christian ideals for ‘universal’ ones. অবলম্বনে
মূল: রবার্ট নিকলসন
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট
অনুবাদ : সিদ্দিক ইবনে মুসা
#সাপ্তাহিক_বিশেষ_আয়োজন