08/09/2025
আউটসোর্সিং কর্মচারীর বিলাসবহুল জীবন: সামান্য বেতনে কোটি টাকার সাম্রাজ্য, দুদকের তদন্ত দাবি:
ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কার্যালয়ের আউটসোর্সিং কর্মচারী মোঃ মাসুদ পারভেজের নাম এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে। তিনি একজন সাধারণ কার্য সহকারী হয়েও কোটি টাকার মালিক, আলিশান বাড়ির মালিক এবং বিমান ভ্রমণের মতো বিলাসী জীবনের অধিকারী। কয়েক হাজার টাকার মাসিক বেতনে এ ধরনের জীবনযাপন দেখে সাধারণ মানুষ যেমন বিস্মিত, তেমনি ক্ষুব্ধও হয়েছেন। স্থানীয়দের মতে, তার এ অবৈধ সম্পদ ও প্রভাবশালী আচরণ প্রশাসনের প্রতি আস্থা নষ্ট করছে।
মাসুদ পারভেজ বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও গান্ডিকারী গ্রামের বাসিন্দা। সম্প্রতি তিনি একটি দোতলা আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এলাকার মানুষ জানায়, বাড়িটি শুধু আকারে বিশাল নয়, বরং এর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, আসবাবপত্র ও নির্মাণশৈলী এতটাই ব্যয়বহুল যে তা একজন সাধারণ চাকরিজীবীর নাগালের বাইরে। দামি টাইলস, আধুনিক শৌখিন আসবাবপত্র এবং অভিজাত স্থাপত্যশৈলীর জন্য বাড়িটি এখন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
কেবল বাড়ি নয়, মাসুদ পারভেজের যাতায়াতও মানুষের চোখে বিস্ময়ের। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ঢাকায় যাতায়াতের জন্য নিয়মিত বিমান ব্যবহার করেন। অফিসিয়াল কাজে ঢাকায় যাওয়া হোক কিংবা ব্যক্তিগত কারণে কক্সবাজার ভ্রমণ—বিমান তার কাছে যেন সাধারণ যাতায়াতের মাধ্যম। এমনকি অনেকে বলেছেন, তার বিমান ভ্রমণ এত ঘন ঘন হয় যে স্থানীয়রা মনে করেন তিনি সরকারি কর্মকর্তা বা বড় ব্যবসায়ী। অথচ তিনি কেবলমাত্র একজন আউটসোর্সিং কর্মচারী।
অফিস সহকর্মী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, মাসুদ পারভেজ সরকারি প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনৈতিক প্রভাব খাটান এবং নিয়মিত ঘুষ গ্রহণ করেন। কারও কাজ যদি তার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয় তবে তাকে বাধ্য হয়ে অর্থ দিতে হয়। নইলে প্রকল্পের অনুমোদন বা বরাদ্দ আটকে যায়। স্থানীয়রা বলেন, এটি কোনোভাবেই একজন সাধারণ কর্মচারীর কাজ হতে পারে না। তারা মনে করছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অর্থ উপার্জন করেই তিনি এত সম্পদের মালিক হয়েছেন।
আউটসোর্সিং কর্মচারীর মাসিক বেতন যেখানে কয়েক হাজার টাকার বেশি নয়, সেখানে কোটি টাকার সম্পদ, দোতলা বাড়ি আর বিলাসী জীবনধারা কোনোভাবেই বৈধ আয়ে সম্ভব নয়। সচেতন মহল বলছে, এর পেছনে দুর্নীতি ও অনিয়ম ছাড়া আর কিছু নেই। প্রকল্প অনুমোদন, টেন্ডার প্রক্রিয়া, এমনকি সরকারি বরাদ্দ গ্রহণের ক্ষেত্রেও মাসুদ পারভেজের প্রভাব এত বেশি যে স্থানীয়রা তাকে “গেটকিপার” হিসেবে অভিহিত করেন। তার সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া কোনো কাজই সহজে সম্পন্ন হয় না।
সংবাদ প্রকাশের আগে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। তবে এক পর্যায়ে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে বলেন, “আমার বাবা জমিদার, আমি যা খুশি করতে পারি। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, আমার বিরুদ্ধে নিউজ করে কোনো লাভ হবে না। ঢাকায় যাওয়ার জন্য অফিস বিমানের টিকিট দেয়।” তার এই বক্তব্যে স্থানীয়দের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। অনেকেই বলছেন, তিনি শুধু দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনই করেননি, বরং প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ মানুষকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।
প্রশাসনিক মহলের একাধিক সূত্র জানায়, একজন আউটসোর্সিং কর্মচারীর হাতে এত প্রভাব থাকা এবং কোটি টাকার সম্পদ অর্জন প্রশাসনের জন্য ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত। সাধারণত এ ধরনের কর্মচারীরা সামান্য বেতনে সহায়ক কাজ করে থাকেন, কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে তারা অস্বাভাবিক সম্পদশালী হয়ে উঠছেন। এতে প্রশাসনের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ভেঙে পড়ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, “এটা শুধু একজন কর্মচারীর দুর্নীতি নয়, পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর আঘাত। এর প্রতিকার না হলে ভবিষ্যতে নিম্নপদস্থ কর্মচারীরাও একইভাবে দুর্নীতিতে উৎসাহিত হবে।”
এলাকাবাসীও একই দাবি তুলেছেন। তারা বলছেন, এ ধরনের কর্মচারীরা প্রশাসনকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছায়। ফলে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। এক বৃদ্ধ কৃষক বলেন, “আমাদের প্রকল্পের কাজ করতে গেলে টাকা দিতে হয়। নইলে কাজ হয় না। অথচ এই টাকার কোনো হিসাব নেই। সব যায় ওই কর্মচারীর পকেটে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাসুদ পারভেজের মতো কর্মচারীরা যদি অবাধে সম্পদ গড়ে তুলতে থাকে, তবে প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা চূর্ণ হবে। দুর্নীতি সমাজে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এর ফলে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
একজন সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, “এটি একটি ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত। যদি একজন অফিস সহায়ক এভাবে কোটি টাকার মালিক হতে পারে, তবে আগামী দিনে প্রশাসন আরও বড় সংকটে পড়বে। দুর্নীতি ও অনিয়মের সংস্কৃতি যদি রোধ করা না যায়, তবে জনগণের ক্ষোভ বিস্ফোরণের পর্যায়ে পৌঁছাবে।”
বর্তমানে এলাকায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত সবার মুখে একই দাবি—দুদকের স্বচ্ছ তদন্ত। তারা মনে করছেন, সঠিক তদন্ত ছাড়া এ অভিযোগের সত্যতা যাচাই সম্ভব নয়। তবে যদি প্রমাণিত হয়, তবে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কারণ একজন কর্মচারীর দুর্নীতির দায় শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি পুরো প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি।
মাসুদ পারভেজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে তা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হয়ে দাঁড়াবে। স্থানীয়রা আশা করছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায় বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখবে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
কারণ জনগণ বিশ্বাস করে—দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলে প্রশাসনের প্রতি আস্থা আবারও ফিরবে। কিন্তু যদি এই দুর্নীতি ও অনিয়ম উপেক্ষিত হয়, তবে হতাশা, অবিশ্বাস ও ক্ষোভ আরও বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদে তা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে।