17/07/2025
জাকারিয়া কামাল: একজন ধ্যানমগ্ন ঋষি!
নাজমুস সায়াদাত
জাকারিয়া কামাল। সাবেক সেনা কর্মকর্তা- লেফটেন্যান্ট কর্নেল। একটা ইউটিউব চ্যানেলের আলোচনায় তাকে প্রথম দেখি। পরবর্তীতে রিয়ার এডমিরাল (অব.) বজলুর রহমান স্যারের সাথে যখন একটা কুরআন অনুবাদ প্রকাশনার কাজে যুক্ত হলাম তখন তিনি বললেন, জাকারিয়া কামালের বাসায় আসো, আমরা ওখানেই আলাপ-আলোচনা করব। গেলাম মেরুল বাড্ডা মন্দির সংলগ্ন রাস্তার মাথায়। পাশে এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, জাকারিয়া কামালের বাসা কোনটা? দোকানি হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলেন, ঔটা। বুঝলাম উনি তাহলে বেশ পপুলার, আশপাশের লোকজন ভালোই চিনেন। একটু পর বজলু স্যার এলেন। আমরা বাসার নিচে গ্যারেজে ঢুকতেই দেখলাম জবুথবু বেশে আলুথালু চেহারা-সুরতে একটা ফতুয়া আর ট্রাউজার পরিহিত জাকারিয়া কামাল বসা। তিনি আমাদের দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন, তারপর সালাম বিনিময় করলেন। হাসিমুখে বললেন, ভেতরে নিতে পারবো না স্যার, বাসায় অনেক বিড়াল। বজলু স্যার বললেন, না ঠিক আছে, এখানেই বসি, একটা টুল দাও। একটু পর কে এস ইসলাম এলে আমাদের ইনফরমাল মিটিং শুরু হল। সিদ্ধান্ত হলো, প্রকাশিতব্য কুরআনের অনুবাদটা জাকারিয়া কামাল স্যারও রিভিউ করবেন। আসার সময় জাকারিয়া কামাল স্যার আমাকে সময় করে আরেকদিন দেখা করতে বললেন।
পরে ফোনের আলাপে সিদ্ধান্ত হলো যে, জাকারিয়া কামাল স্যারের সাইন্টিফিক তাফসীরটা বাংলায় প্রকাশ করবে সরলরেখা। বাংলা অনুবাদক কিংডম গ্রুপের এমডি নুসরত সাহেবের সাথে বসতে হবে বলে দিনক্ষণ ঠিক হলো। নির্দিষ্ট দিনে আমরা মহাখালীর রাওয়া ভবনের সামনে মিলিত হয়ে ডিওএইচএস গেলাম। জাকারিয়া কামাল স্যারকে আজ বেশ স্মার্ট লাগছে। কোর্ট প্যান্ট পড়া নীরেট ভদ্রলোক। আমরা একই রিকশায় উঠলাম। গেলাম কিংডমে। দুপুরে বিরাট লাঞ্চের ব্যবস্থা। একজন বিসিএস কর্মকর্তাও আমাদের সাথে। খাবার পরিবেশন করছিল যে, তাকে খাবার সার্ভ করার একটা স্টাইল শেখানোর উদ্দেশ্যে জাকারিয়া কামাল স্যার নিজেই উঠলেন। তারপর কীভাবে ডিসটা ধরতে হয় কীভাবে তা সার্ভ করতে হয় সেই টেকনিকটা একজন প্রফেশনাল ওয়েটারের মতোই ডামি আকারে উপস্থাপন করলেন তিনি। আমরা বিষয়টিতে মুগ্ধ হলাম।
ভোজনের পর দীর্ঘ আলাপচারিতা। মহাবিশ্ব, কুরআন, তাওরাত, যবুর, বাইবেল, লাল গরু সমাচার, ফোটনতত্ব, খেলাফত, মিশর বিজয়, বাংলাদেশে হাল হকিকত- কী নেই সেই আলোচনায়। মিশর বিজয়ী প্রথম সেনাপতির নাম কেউ মনে করতে পারছিলেন না। আমি একটু ভেবে বললাম, আমর ইবনুল আস। জাকারিয়া কামাল স্যার বললেন, আপনি তো বেশ জানাশোনাওয়ালা মানুষ।
সিদ্ধান্ত হলো বৈজ্ঞানিক তাফসীর সূরা ফাতিহা প্রকাশনার। এই কাজ করতে গিয়ে জাকারিয়া কামাল স্যারের সাথে আমার আর আকিবের ঘনিষ্ঠ এক পথচলা শুরু হলো। স্যারকে বেশ নিকট থেকে জানার সুযোগ হলো। আমরা তাকে উপাধি দিলাম মাজঝুব বা ধ্যানমগ্ন এক ঋষি! পরবর্তীতে সুরা ফাতিহার তাফসীর বই মেলায় এলো। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, জাকারিয়া কামাল স্যার বইমেলায় হাজির! স্টলে বসলেন, অটোগ্রাফ দিলেন, এটিএন বাংলায় সাক্ষাৎকারও দিলেন। ইতোমধ্যে তার ভিডিও লেকচারগুলো ইউটিউবে দেখে ফেলেছি। বজলু স্যারের নেতৃত্বে আমরা কুরআন অনুবাদের জন্য কয়েকটা সেশন করেছিলাম। জাকারিয়া কামাল ছাড়াও ক্যপ্টেন জিল্লুর রহমান ভূইয়া, কে এস ইসলাম, মুরাদ বিন আমজাদ, সাব্বির আহমেদ খানসহ আমি ও আকিব এতে উপস্থিত ছিলাম। পরে কুরআনের অনুবাদটি বের হলে একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়েছিল মিরপুর ডিওএইচএস। সেই অনুষ্ঠানে বজলু স্যারের গাড়িতে করে জাকারিয়া কামাল স্যারসহ আমরা গেলাম।
আল কোরআনের আলোকে মহাবিশ্বের যে মানচিত্রটি জাকারিয়া কামাল স্যার অঙ্কন করেছেন তা আমাকে দিনের পর দিন ভাবাতে লাগলো। এই চিত্রটা প্রিন্ট করে আমি আমার পূর্বাচলের অফিসে ঝুলিয়ে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতাম! কুরআনকে কত গভীরভাবে উপলব্ধি করলে এরকম একটি গ্রাফিক্স অঙ্কন করা যায়, তাই শুধু ভাবি এখন! এরপর সূরা বাকারাও প্রকাশিত হলো। এখন সূরা আলে ইমরানের কাজ করছি। গত সপ্তাহে স্যারের সাথে দীর্ঘ ফোনালাপ হলো।
১৪ জুলাই ২০২৫। সকালে তার ভাইয়ের ফেসবুক বার্তায় জানতে পারলাম, তিনি দুনিয়ার সফর শেষ করে মানিকগঞ্জের পথে! রাতে দেখলাম, সেনাবাহিনী গার্ড অব অনার দিয়ে জাকারিয়া কামাল স্যারকে চির বিদায় জানাচ্ছে।