27/04/2023
মার্কেট থেকে ফিরেই আম্মার ঘরে গেলাম। দুটো শপিং ব্যাগ আম্মার হাতে দিয়ে বললাম,'দুই ব্যাগে দুটো শাড়ি। তোমার জন্য কফি কালারেরটা।আর আমার শাশুড়ির জন্য খয়েরি কালারের টা।'
আম্মা আমার শাশুড়ির নাম শুনেই ছ্যাঁৎ করে জ্বলে উঠলেন। শপিং ব্যাগ দুটো দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন,'এইসব ঢং আমার পছন্দ না! শুধু শাড়ি কিনছস কেন শাশুড়ির জন্য।একসেট সোনার গয়না তৈয়ার করে গিফট করতি! '
আমি একটু সামনে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা ব্যাগ দুটো হাতে তুলে নিতে নিতে বললাম,'কী হয়েছে মা? একটা শাড়িই তো উনাকে দিচ্ছি। তোমাকে দিতে পারলে তাকে দিতে পারবো না কেন? তুমি যেমন আমার মা,তিনিও তো আমার মা!'
মা রাগের গলায় বললেন,'এইসব মেয়েলিপনা আলাপ এসে আমার কাছে করবি না। এইসব আমি একদম পছন্দ করি না! শশুর বাড়ির মুরিদ হয়ছস!যা এখন থেকে ওইখানে বসবাস করা শুরু কর গিয়ে। বেতন ভাতা যা পাস তাদেরকেই দিয়ে দে সব।'
আমি কিছুই বুঝতে পারিনি মা কেন এমন করছে।
রোজার বিকেল ছিল ।ভেবেছি মার বোধহয় রোজাটা ধরেছে। কষ্ট হচ্ছে।তাই একটু এমন করছে।
আমার ঘরে আসতেই দেখি জবা কাঁদছে চুপিচুপি।নিঃশ্বব্দে।তার চোখ থেকে শুধু জল গড়িয়ে পড়ছে গালের উপর।
আমি ওর পাশে বসে বললাম,'কী হয়েছে? কাঁদছো কেন জবা? মা এসব বলেছে বলে তাই না?'
জবা এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কিছু বলতে পারে না।আমি ব্যাগ দুটো খাটের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি শক্ত করে।জবা আমার বুকের ভেতর মিলিয়ে যেতে যেতে যে কথাগুলো আমায় বললো তা আমার ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছিলো লজ্জার আগুনে।সে বললো,'কেন কিনতে গেলে দুটো শাড়ি? আমার মায়ের কী শাড়ি নেই? দেখো গিয়ে আমার চার ভাই মায়ের জন্য কম করে হলেও চার জোড়া শাড়ি কিনে দিয়েছে। আমার তিন বোন জামাই কিনে দিয়েছে। তুমি কেন কিনতে গেলে? আমার মাকে অপমান করবার খুব শখ হয়েছিল তোমার তাই না?'
আমি জবার এই কথাগুলোর জবাবে একটি কথাও বলতে পারিনি তখন। শুধু নিরব থেকে এটা ভেবেছি যে,এই পৃথিবীর মেরুদন্ডহীন পুরুষগুলোর একজন আমি।
'
রোজার আটাশ।ঈদ আগামীকাল হবে নাকি এরপর দিন হবে এ নিয়ে বিরাট আলোচনা চলছে।
জবার মন একটু ভালো হয়েছে।আমি ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ম্যানেজ করেছি। কিন্তু ওই শাড়িটা আর আমার শাশুড়িকে দিতে দেয়নি।সে বলেছে, এই শাড়ি আমার মাকে দিলে এটা হবে আমার মাকে অপমান করার শামিল। তুমি যদি আমার মাকে অপমান করতে পছন্দ করো তবে শাড়ি দিয়ে আসো গিয়ে।আমি আর কিছু বলবো না।জবার এমন কথার পর আর যাই হোক শাশুড়ি মায়ের জন্য শাড়িটা পাঠানো যায় না।শেষে মাকেই দিলাম দুটো শাড়ি।মা নিয়ে কোন কিছু বলেনি আমায়।তার হাব ভাব দেখে বোঝা গেছে মা আমার প্রতি খুবই বিরক্ত। আমাকে এখনও তার নিজের অযোগ্য সন্তানই মনে করছেন তিনি।
রাতের খাবার খাচ্ছি। অনেকক্ষণ আগে জবার কাছে ডাল চেয়েছি।ও নিয়ে আসছে না।রাগ লাগছে আমার।
জবা দেরি করে ডাল নিয়ে ফিরতেই রাগ দেখিয়ে বললাম,'কখন বলেছি ডাল আনতে? এতোক্ষণ লাগে কেন? কী করেছিলে এতোক্ষণ তুমি?'
জবা ওড়না টেনে কপালের ঘাম মুছে বললো ,'দুলাভাই এসেছেন। শরবত করে দিয়েছি। তরমুজ কেটেছি।'
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেন দুলাভাই এসেছে তা জানতে।
জবা বলার আগেই মা ডাকতে শুরু করলেন আমায়।
'রুহান,দেখে যা এক্ষুনি।তোর মেজো দুলাভাই এসেছে রে । এক্ষুনি আয়।'
আমি মার কথা শুনে তাড়াহুড়ো করলাম না খাবারে।আস্তে ধীরেই খেলাম। খাবার শেষ করে মার ঘরে গিয়ে দেখি দুলাভাই চেয়ারে বসে আছে।তার মুখে পান। তার মানে জবা আমার সামনে ডাল দিয়ে এসে দুলাভাইকে সুপুরি কেটেও দিয়েছে।এই মেয়েটা কী যে পরিশ্রম করে! রোজা রেখে আমি একটু কিছু করলেও কেমন হাঁপিয়ে উঠি।কেউ কিছু বলতেই চেত করে জ্বলে উঠি।গলা কর্কশ করে কথা বলি। কিন্তু ওর কিছুতেই কিছু হয় না। সবকিছুই সে ঠিকঠাক ভাবে করে।ও যেন একটা কাজের মেশিন। ওই যে সন্ধ্যা বেলায় একটা খেজুর খেলো।এক গ্লাস পানি খেলো।আর আমি জোর করে আধ গ্লাস শরবত খাওয়ালাম,ওটুকুই। এরপর আর কিছু খায়নি। খাওয়ার সময়ই তো পায়নি। ঘরের কতো যে কাজ!
'
মা ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এসে হাসি হাসি মুখে খাটের একপাশ থেকে তিনটি শপিং ব্যাগ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,'এই দেখ জামাই কী এনেছে! আমার জন্য শাড়ি।তোর জন্য পাঞ্জাবি।বউমার জন্য ত্রিপিস।'
আমি কাপড়গুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। অনেকক্ষণ ধরে। তারপর বললাম,'সুন্দর। অনেক সুন্দর। পছন্দ হয়েছে।'
তারপর টেবিলের উপর ব্যাগ গুলো রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। এখানে ওখানে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরাফেরা করে ঘরে ফিরলাম অনেক পরে। ততোক্ষণে দুলাভাই চলে গেছেন।মা বসে আছেন।তসবির দানা ধরে ধরে দোয়া জপছেন।
আমি মার পাশে বসলাম তখন। চুপচাপ বসে রইলাম।
মা বুঝলেন কিছু বলতে চাই আমি।তাই তসবি পড়া দ্রুত শেষ করে তসবির শেষ দানায় চুমু খেয়ে বললেন,'কিছু বলবি রে বাবা?'
আমি আরো খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থেকে বললাম,'মা, দুলাভাই কী কাজটা ঠিক করেছেন?'
মা অবাক হয়ে বললেন,'কোন কাজটা?'
'ওই যে তোমার জন্য, আমার জন্য আর জবার জন্য, আমাদের ঘরের সবার জন্য ঈদের গিফট দিয়ে গেলো। এটা কী ঠিক হয়েছে? জামাইদের পক্ষ থেকে শশুর বাড়িতে কোন গিফট দেয়া কী ভালো কাজ মা?'
মা আমার এই কথা শুনে হঠাৎ কেমন চুপ হয়ে গেলেন।চুপ বলতে একেবারে চুপ। একটি কথাও আর বললেন না।আমি অনেকক্ষণ মার পাশে বসে রইলাম তার জবাবের অপেক্ষায়।মা কোন জবাব দিলেন না।শেষে রাত বাড়ছে বলে মার ঘর থেকে আমার ঘরে গেলাম।জবা তখনও জেগে আছে।পড়ছে। হুমায়ূন আহমেদের 'অপেক্ষা' বইটা তার ভীষণ রকম পছন্দের।এই বই পড়ে সে কাঁদতে কাঁদতে চোখে নদী বইয়ে দেয় একেবারে।
এখনও এই বইটিই পড়ছে।
আমাকে রুমে ঢুকতে দেখেই সে একটা পাতা ভেঙে বইটা খাটের পাশে টেবিলের উপর রাখলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,'কাজটা মোটেও ভালো করোনি তুমি!'
আমি বললাম,'কোন কাজটা?'
জবা বললো,'মা বৃদ্ধ মানুষ। সেদিন না হয় মা এরকম একটা আচরণ করেছেন তোমার সাথে।বুঝতে পারেননি! তাই বলে তুমিও আজ তার সাথে এমন করবে? মা তোমার এই আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছেন! তুমি এভাবে না বললেই ভালো হতো! কাজটা অনেক খারাপ হয়েছে রুহান!'
আমি শুধু বললাম,'জবা,মা হোক আর যেই হোক তার ভুলটা ধরিয়ে দেবার প্রয়োজন আছে। ভুল না ধরিয়ে দিলে একটা মানুষ বুঝবে কী করে তাকে সঠিক পথে আসতে হবে? আমরা মানুষ। মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত। আশরাফুল মাখলুকাত ভুল করে,অন্য একজন তার ভুল ধরিয়ে দেয়, তারপর ভুলকারী আবার সঠিক পথে ফিরে আসে।এটাই তো বিউটি।'
জবা এ নিয়ে আর কিছু বলেনি। বিছানা ঝেড়ে দিয়ে শুধু বললো ,'শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে।'
আমি বললাম,'আচ্ছা।'
'
পরদিন দুপুর বেলা মা হুট করে জবাকে বললেন,'বউমা রেডি হও। মার্কেটে যাবো।'
জবা মার কথা নিয়ে তেমন ঘাঁটে না।সে জানে মার রাগ বেশি।
সে বরং রেডি হয়ে মার সাথে গেলো।
তারা বাসায় ফিরলো ইফতারের আগে আগে।
বাসায় ফিরেই মা আমায় ডাকলেন।
'রুহান, এইদিকে আসো বাবা।'
আমি খিঁচুড়ি রান্না করছিলাম। ওদের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে নিজেই ইফতারির রান্না করতে শুরু করলাম। ভাবলাম জবা ক্লান্ত হয়ে ফিরবে, এরপর আবার রাঁধতে গেলে ওর উপর জুলুম হবে।তাই নিজের এক্সপেরিমেন্ট কাজে লাগালাম।
মা ডাকলেও কিচেন থেকে মার কাছে গেলাম না। এদিকে আবার কখন পাতিলের তলায় খিচুড়ি বসে যায়!
আমি যাইনি বলে মা নিজেই আমার কাছে এলেন। তার হাতে পাঁচটি ব্যাগ।মা আমার হাতে ব্যাগ গুলো ধরিয়ে দিয়ে বললেন,'একটা তোর শাশুড়ির,আর বাকী চারটা বউমার চার ভাইয়ের জন্য।আজ রাতেই তুই যাবি। দিয়ে আসবি গিয়ে।'
আমি এবারেও কোন কথা বললাম না।চুপ করে রইলাম।
মা আমায় চুপ করে থাকতে দেখে বললেন,'বাবা,আমি যে সেদিন কাজটা করেছি এটা নিতান্তই গর্হিত কাজ। শাশুড়ি মায়ের মতই। তাকে উপহার দেয়া আর নিজের মাকে উপহার দেয়া তো সমান কথাই। আমি ভুল করেছিলাম সেদিন বাবা। এরপর আর এরকম ভুল হবে না।'
আমি মৃদু হাসলাম। মায়ের এই কাজটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।কেউ যদি তার নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং এই ভুল থেকে সে সঠিক পথে ফিরে আসে এটা তো আনন্দেরই কথা।
#ভুল_ভাঙনের_গল্প
#অনন্য_শফিক