28/09/2025
Power Of Silence : মৌনতার শক্তি
একটি জটাংক উপলব্ধি.....................................................................................................
কারো আচরনে বিরক্ত হলে কী করেন?
মুখের উপরে দুটো কথা শুনিয়ে দেন নিশ্চয়।
কেউ আগ্রাসী ভঙ্গীতে যদি আপনার উপরে রাগ ঝাড়তে থাকে, আপনি হয়তো বসে থাকবেন না; প্রতিবাদী হয়ে উঠবেন। আর বাবা-মা বংশ নিয়ে কেউ গালাগালি দেয়, তাহলে তো কথাই নেই। আজ তার একদিন কী আপনার একদিন। স্বাভাবিক, এই পৃথিবীতে যাবতীয় অনিয়ম, অপবাদ আর অবিচারের বিপরীতে কঠিন জবাব দেয়ার অধিকার আপনার আছে।
কিন্তু সেটা কতক্ষন? মানে আঘাত আর আঘাতের জবাব দিতে দিতেই যদি আমরা একটা জীবন পার করে ফেলি তাহলে নিজের কাজটা করবো কখন?
এই জায়গাটিতে এসেই জ্ঞানীরা একটা প্রাচীন সমাধান খুঁজে নেন। সেটা হলো, মৌনতা বা নীরবতা।
মৌনতা কী? সাধারণত মৌনতা বা নীরবতা হলো একটি শব্দহীন বাস্তবতা। কোনো কারণে আপনি যদি চুপ করে থাকেন তাহলে সেটাই মৌনতা।
কিন্তু মুশকিল হলো মানুষ মুখ বন্ধ রাখলেও তার ভেতরটা চুপ থাকেনা। সে নানা কিছু ভাবতে থাকে। নিজের মনের সাথে বকবক করতেই থাকে। তাই সঠিক সংজ্ঞা হলো; মৌনতা মানে ভেতরের এমন এক অবস্থা—যেখানে চিন্তা থেমে যায়, কিন্তু সচেতনতা জেগে ওঠে। এটা এক ধরণের শক্তি, যাকে বিজ্ঞান বলে “stillness of the brainwaves”, দর্শন বলে “আত্মার ভাষা”, আর মিস্টিকরা বলে “মিলনের দরজা”।
যাইহোক; চলুন চট করে ৫টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজি।
প্রশ্ন-১: আমরা যখন নীরব থাকি, তখন আমাদের ভেতরে এবং বাইরে কী ঘটে?
উত্তর:
আমরা যখন নীরব থাকি, তখন প্রথম কয়েক মিনিট বিক্ষিপ্ত চিন্তা মাথায় আসতে থাকে। ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে মন ও মস্তিষ্কের সংযোগটা শক্ত হতে থাকে। এই অবস্থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘ব্রেনের ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক’ সক্রিয় হওয়া। নীরব থেকে যদি ৩০ মিনিট পার করেন, আপনার পর্যবেক্ষন ক্ষমতা বেড়ে যাবে। আপনার মনে পড়বে আজ ঠিক কোন কাজটা করার কথা ছিল যেটা করা হয়নি। কাউকে কোনো কথা দিয়েছিলেন কিনা ইত্যাদি। বেশীরভাগ মানুষ এই ৩০ মিনিট পরেই মৌনতা ভেঙে ফেলে হাতের মোবাইলের স্ক্রিনটা অন করে ফেলেন।
আপনি যদি চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঘন্টাখানেক নীরব থাকতে পারেন, দেখবেন আপনার লোকালয় ভালো লাগছে না। মানে শব্দ নিতে পারছেন না। বেশীর ক্ষেত্রে এই সময় আপনার ঘুম পাবে। বা ঝিমুনি আসবে। যদি আপনি এমন জায়গায় থাকেন যেখানে ঝিমানো বা ঘুমানোর সুযোগ নেই, যেমন অফিস বা ক্লাসে বা সেমিনারে ইত্যাদি; তখন বিকল্প হিসেবে আপনি কোনো একটা ইস্যু নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে যাবেন।
যদি এমন হয় যে আপনি আপনার বাসায়, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, কবরস্থান বা নির্জন কোনো জায়গায় অন্তত ৪০দিন এক ঘন্টার জন্য চুপ থাকতে পারছেন; তখন চারটি স্তরের মধ্যে ঘুরতে থাকবেন।
১) স্মৃতিচারণ: নীরবতায় ডুবে থেকে আপনি ক্ষনে ক্ষনে পুরোনো স্মৃতিতে হারিয়ে যাবেন। অনেকের কথা মনে পড়বে যাদের সাথে আপনার আর যোগাযোগ নেই। অতীতের দূর্ঘটনার কোনো স্মৃতি কিংবা বড় কোনো অর্জণ সব মনে আসতে থাকবে একে একে। এগুলো ভেবে আপনি আনমনে হেসে উঠতেই পারেন। ফেলে আসা দিনের কথা ভেবে বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে হাহাকার।
২) নীরবতার দ্বিতীয় স্তর- ভুল:
নীরবতা চর্চার মাঝে অবধারিতভাবেই আপনার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষকে নিয়ে ভাবতে শুরু করবেন। যেহেতু অপছন্দের মানুষটির সাথে আপনার ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বারবার দেখছেন, তাই প্রতিবারই নতুন নতুন উপলব্ধি হাজির হবে।আপনি বুঝতে শুরু করবেন, মানুষটির শুধু একার দোষ না আপনারো কিছু ভুল ছিল। আপনি যদি অন্যভাবে চেষ্টা করতেন, সম্পর্কটা খারাপ হতো না। আস্তে আস্তে দেখবেন, আপনার ভুল আপনার অপছন্দের মানুষের চেয়েও বেশী ছিল।
৩) ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: আপনার কিছু চাওয়া আছে।সেই চাওয়া পূরনের জন্য তো পরিকল্পনা দরকার, আপনার নীরবতা আপনার সেই পরিকল্পনার দরজা খুলে দেবে। আপনি ফিল করতে পারবেন, কোন কাজটা করা দরকার। ক্যারিয়ারের জন্য, পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য কোন দক্ষতাগুলো দরকার ইত্যাদি নানা আইডিয়া পাবেন।
৪) নীরবতার চর্তূথ ধাপে খুলে যাবে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার দরজা। আপনি বুঝবেন, ধর্ম নিয়ে বিশ্বে যা চলছে তার অনেকটা স্রেফ পাগলামি। ধর্ম হানাহানিকে প্রশ্রয় দেয়না, ধর্ম একটি পরিছন্ন জ্ঞান, যেটা জীবনকে প্রশান্তিতে পূর্ণ করে। নীরবতার এই স্তরে স্রষ্টা আর সৃষ্টির উপরে এক গভীর মমতা ফিল করবেন। সেসময় আপনার মন আপনাকে বলে দেবে কোন কাজটা করা উচিত। সাধকরা তাই জীবনের যেকোন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য নীরবতার এই স্তরে চলে আসেন।
এভাবে নীরবতার চর্চা বাড়িয়ে দেয় সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা হয় তীক্ষ্ণ। নীরবতার ভেতরেই আমরা নিজেদের অজানা ভয়, ক্ষত আর শক্তির সাথে মুখোমুখি হই।
আপনি যখন নীরবতাকে এভাবে আঁকড়ে ধরছেন, বাইরের মানুষের কাছে তখন আপনি রীতিমত রহস্যময় একটি চরিত্র হয়ে উঠেছেন। পরিচিতরা যেন আপনার সাথে একটু বেশী মমতা আর সম্মান নিয়েই কথা বলছেন। আপনি উপভোগও করতে শুরু করবেন।
..................................................................................
প্রশ্ন-২: কীভাবে শুধু চুপ থেকেই জীবনের জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায় ?
উত্তর:
দেখুন আমাদের সমস্যার বেশীরভাগের জন্মই হয় নেতিবাচক অনুভূতি থেকে। মানে একটা ঘটনা আপনার সাথে ঘটে যাবার পর আপনি যখন ফিল করেন, এটা আপনাকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে, আপনাকে পিছিয়ে দিচ্ছে আপনি তখনই ক্ষোভে ফেটে পড়েন, প্রতিক্রিয়া জানানো শুরু করেন। সমস্যটা তৈরি হয় তখনই। এখানে কিন্তু আমাদের দোষ নেই, কারণ আমরা বেশীরভাগ মানুষই মনে করি সব সমস্যার সমাধান শব্দের মধ্যে লুকানো। চুপ থেকেও যে টেবিলটা ঘুরিয়ে দেয়া যায়, এটা আমাদের মাথায় আসেনা।
ধরুন, অফিসে আপনার দক্ষতাকে মূল্যায়ণ করা হচ্ছেনা। জুনিয়র কেউ আপনার বসকে তোষামোদ করে অনেক উপরে উঠে গেল। বেতন-প্রোমোশন সব তার হচ্ছে আপনার হচ্ছে না।আপনার করণীয়টা কী?
আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এক্ষেত্রে আপনি যদি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান আপনার ক্যারিয়ার শেষ হওয়াটা কেবল সময়ের ব্যপার। এটা করা যাবেনা। আপনার উচিত হবে নীরবতার পথ বেছে নেয়া। এই নীরবতা আপনাকে শান্ত করবে। ফলে সহজেই বুঝতে পারবেন আপনার এখন কী করা উচিত। আপনি ঠান্ডা মাথায় আপনার যোগাযোগের ক্ষমতা ব্যবহার করে নতুন চাকরীর চেষ্টা চালাতে পারেন। পাশাপাশি বর্তমান অফিসে আমার কাজের মাত্রা ও কোয়ালিটি বাড়িয়ে দিতে পারেন। অফিসে আপনি যখন নীরব থেকে দূর্দান্তভাবে কাজ করছেন, আপনার বস একটা ধাক্কাখাবে। আর যখন নতুন চাকরি ঠিক করে ফেলবেন এবং বসের কাছে কৃতজ্ঞতা ভরে বিনয়ের সাথে রিজাইন লেটারটা ধরিয়ে দেবেন, আপনার বস দ্বিতীয় ধাক্কাটি খাবেন। সে সময় আপনাকে বেতন বাড়ানো, প্রোমোশনসহ নানা কিছু অফার করা হবে। আপনি তখন নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে অফার নিয়ে থাকবেন নাকি নতুন চাকরীতেই যাবেন।
আবার ধরুন, প্রিয় মানুষটি আপনাকে বুঝতে পারছেন। আপনি শতভাবে চেষ্টা করেও সম্পর্কটা ঠিক করতে পারছেন না, ধীরে ধীরে সম্পর্কটা ভেঙে যাচ্ছে, কী করবেন? এখানেও প্রয়োজন নীরবতা। আপনি নিরাপরাধ হবার পরও যদি প্রিয় মানুষটি ক্রমাগত উচ্চস্বরে ঝগড়া করতে থাকে এবং আপনি যদি তার প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকেন, সম্পর্ক হয়েও উঠবে আরো তেতো। বিশ্বাস করুন, চিৎকার করে আজ পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক মেরামত করা যায়নি। এরচেয়ে ভালো হয় যদি চুপ হয়ে যান। একদম সাইলেন্স। সে যে আপনাকে বোঝেনি এই আক্ষেপটা থাকুক আপনার মনের গভীরে, প্রকাশ করার দরকার নেই। আপনি যখন থেমে গেলেন, আপনার প্রিয় মানুষটির ঝগড়াও থামবে। কারন একতরফা ঝগড়া খুবই ক্লান্তিকর। একটা পর্যায়ে দুজনই চুপ। আপনাদের দুজনের এই চুপ থাকার অর্থ আপনাদের সম্পর্কটা নি:শ্বাস নিচ্ছে। ধীরে ধীরে অক্সিজেন পেয়ে সম্পর্কটা ঠিক হবে। আর যদি সেটা ঠিক না হয়, অন্তত শান্তিপূর্ণ সমাধান আসবে। আসলে প্রকৃতির একটা প্রাচীন নিয়ম আছে, নিরাপরাধ মানুষকে শেষ পর্যন্ত সম্মানিত করা হয়।
এভাবে জীবনের বহু সমস্যার বিপরীতে নীরবতাই হচ্ছে সবচেয়ে চমৎকার সমাধান।
..................................................................................
প্রশ্ন-৩: সব ধর্মে ও সাধনায় নীরবতা কেন অপরিহার্য?
উত্তর:
এই অংশটা বোঝার জন্য তিনটা সত্যি ঘটনা বলা প্রয়োজন। প্রথম ঘটনাটি গৌতম বুদ্ধের। একদিন বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে অরন্যে বসেছিলেন। তখন এক ব্যক্তি এসে রাগে-ক্ষোভে গালি দিতে লাগল। "তুমি মিথ্যুক!" "তুমি লোক ঠকাও!""তুমি মানুষকে ভুল পথে চালাও!" ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই অবাক হয়ে গেল। কিন্তু বুদ্ধ? তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নীরব। শুধু শান্তভাবে তাকিয়ে রইলেন।
কিছুক্ষণ পরে সেই ব্যক্তি ক্লান্ত হয়ে বলল—"তুমি কিছু বলছো না কেন? আমি এত গাল দিলাম, অথচ তোমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই!"
তখন বুদ্ধ মৃদু হেসে বললেন—"যদি কেউ তোমাকে উপহার দেয়, আর তুমি তা গ্রহণ না করো—সেই উপহার কার কাছে থেকে যায়?"
লোকটি বলল— "আমার কাছেই।"
বুদ্ধ বললেন—"তাহলে তোমার রাগ, তোমার গালি—আমি গ্রহণ করিনি। সেটা তোমার কাছেই রয়ে গেছে।"
দ্বিতীয় ঘটনাটি জেসাসের। একবার ফারিসীরা অর্থ্যাৎ তৎকালীন ধর্মীয় নেতারা জেসাসের কাছে এক নারীকে নিয়ে এল। তারা বলল:
“এই নারী ব্যভিচারে ধরা পড়েছে। আমাদের ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী এর শাস্তি পাথর ছুঁড়ে হত্যা। এখন তুমি কী বলো?”
ভিড় জমে গেল।মানুষ অপেক্ষা করছে, যিশু কী উত্তর দেন। যদি তিনি বলেন ‘মাফ করো’, তবে আইন ভাঙা হবে। আর যদি বলেন ‘শাস্তি দাও’, তবে তাঁর করুণা ও দয়ার শিক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
যিশু (আঃ) সরাসরি কিছু বললেন না। তিনি নীরব রইলেন…ঝুঁকে মাটিতে লিখতে লাগলেন আঙুল দিয়ে।
ভিড়ের মানুষ জোর করতে লাগল: “বলুন! উত্তর দিন!”
তখন তিনি ধীরে নীরবতা ভাঙলেন, বললেন:
“যার মধ্যে কোনো পাপ নেই, সে-ই প্রথম পাথর নিক্ষেপ করুক।”
সবাই চুপ হয়ে গেল। এক এক করে ভিড় সরে গেল।শেষে শুধু সেই নারী দাঁড়িয়ে রইল।
যিশু তাকে বললেন: “আমি তোমাকে দোষী করছি না। যাও, আর পাপ করো না।”
তৃতীয় ঘটনাটি হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর। একবার এক বেদুঈন অর্থ্যাৎ মরুভূমির সাধারণ মানুষ, সে এসে মসজিদে নববীতে অশোভন আচরণ শুরু করল। চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল, এমনকি কিছু অশ্লীল কথাও বলছিল। সাহাবারা রেগে গিয়ে তাকে থামাতে চাইলো।কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ নীরব রইলেন। তিনি কোনো রাগ দেখালেন না, কোনো কটু কথা বললেন না।
সবাই অবাক।কিছুক্ষণ পর তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন:
“তাকে ছেড়ে দাও। মানুষ জানে না, আল্লাহ তাকে জানাবেন।” পরে তিনি সেই মানুষকে কাছে ডাকলেন, নরমভাবে বললেন: “এটা আল্লাহর ঘর। এখানে পবিত্রতা ও শান্তি বজায় রাখতে হয়।”
লোকটি ভীষণ লজ্জিত হলো, এবং বলল:
“আল্লাহর কসম, হে মুহাম্মদ ﷺ, আপনার মতো সহনশীল ও মহান কাউকে আমি দেখিনি।”
এই তিনটি ঘটনা থেকে কী বোঝা গেল। প্রথমত ক্রোধ আর রাগকে দমন করতে নীরবতা একটা শক্তিশালী জবাব। বুঝতে পারলাম তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় সমাধান আসেনা, বরং নীরবতা সেখানে সৃজনশীল সমাধানের দরজা খুলে দেয়। আপনি দেখবেন এজন্য সবধর্মেই নীরবতা চর্চা শেখানো হয়। যেমন, ইসলাম ধর্মে নবীদের তপস্যা ও নির্জনতায় বসে স্রষ্ঠার স্মরণকে মাথায় রেখে ৪০ দিনের নিস্তব্ধতাকে উৎসাহিত করা হয়। ইসলামিক আধ্যাত্মিকতায় বিশেষ করে সুফিবাদে, দুনিয়ার কোলাহল থেকে কিছুটা সময়ের জন্য দূরে সরে গিয়ে নির্জনে আল্লাহর স্মরণে ডুবে যাওয়ার কথা বলা আছে।
ওদিকে বৌদ্ধধর্মে একটা টেকনিক প্রয়োগ করা হয়, সেটার নাম Vipassana. এটা কী? বৌদ্ধ ধর্মে বিপাশনা হলো সবচেয়ে প্রাচীন আর গভীর ধ্যানপদ্ধতিগুলোর একটি। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে আরাম করে বসে নি:শ্বাসে মনোযোগ দিতে হয়। যেটাকে বলে Anapana. এসময় ধ্যানী ব্যক্তি শুধু নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস লক্ষ্য করেন। কিভাবে বাতাস নাক দিয়ে ঢুকছে ও বের হচ্ছে, শুধু সেটা খেয়াল করা। এতে মন শান্ত হয়, অস্থিরতা কমে। পরের ধাপে শরীর স্ক্যান করা হয়।মানে ধীরে ধীরে শরীরের প্রতিটি অংশে মনোযোগ দেওয়া হয়। কোথাও চাপ, ব্যথা, শীতলতা, উষ্ণতা—যা অনুভূত হয় তা শুধু পর্যবেক্ষণ করা। তৃতীয় ধাপে আছে অনিত্যতা উপলব্ধি। এসময় আপনাকে উপলব্দি করতে হবে সবকিছুই অস্থায়ী। সুখ-দুঃখ, ব্যথা-আনন্দ—কোনোটাই স্থায়ী নয়। এই অনুভূতি আপনার আসক্তিকে বিলীন করে দেবে। এরপরের ধাপ হলো হীরন্ময় মৌনতা বা নোবেল সাইলেন্স। এসময় কথা বলা একদম নিষিদ্ধ। শুধু নিজের ভেতরের কণ্ঠস্বর শোনা। মাত্র ৩০মিনিট করলেই এক সতেজ অনুভূতিতে মন আচ্ছাদিত হয়। ওদিকে হিন্দু দর্শনে বিশ্বাস করা হয় মৌন সাধনায়। এই দর্শন মতে সৃষ্টি শুরু হয় নিস্তব্ধতা থেকে। মৌন ব্রত পালনের কিছু টেকনিক আছে। যেমন, কিছু সময়ের জন্য সম্পূর্ণ নীরব থাকা। শুধু নিজের ভেতরের “শব্দ” শোনা। যথারীতি নি:শ্বাসে মনোযোগ দেয়া। ধীরে ধীরে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করা। এখানে প্রতিটি শ্বাসের মাঝে ছোট্ট বিরতিটাই হলো “মৌনতা”।এসময় ধীরে ধীরে “ওঁ” ধ্বনি জপা হয়, অথবা “মা” শব্দটি উচ্চারণ করা হয়।
খ্রিস্টধর্মে Desert Fathers বা মরুভূমির পিতা বলে একটা দর্শন আছে, যেটার মূল কথা নীরবতা একটি প্রার্থনার পথ। খ্রিস্টধর্মে ৩য়-৪র্থ শতকে মিশরের মরুভূমির সন্ন্যাসীদের বলা হয় Desert Fathers, এটা ছিলেন একদল খ্রিস্টান মিস্টিক, যারা সভ্যতা ছেড়ে নির্জন মরুভূমিতে চলে গিয়েছিলেন। তাদের ধ্যানপদ্ধতির মূলই ছিল — Silence + Solitude।
এসময় ৪টি স্তরের ধ্যান করেন। প্রথমটি হলো Solitude বা একাকিত্ব। এসময় তারা মরুভূমি বা গুহায় দীর্ঘ সময় নির্জনে বসবাস করেন। সম্পূর্ণ নীরব জীবনযাপন আরকি।দ্বিতীয় স্তরের নাম Prayer of the Heart বা হৃদয়ের প্রার্থনা। এসময় ঠোঁটে নয়, গভীর নীরবতায় প্রার্থনা করা হয়। ধ্যানের তৃতীয় স্তরের নাম Guarding the Tongue বা জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ। এসময় ধ্যানীরা বিশ্বাস করেন- “যত কম বলবে, তত বেশি শুনতে পাবে।” অকারণ কথা বলা একেবারে নিষিদ্ধ।
চতূর্থস্তরের নাম Listening to God in Silence: তাদের বিশ্বাস— ঈশ্বরের কণ্ঠ কখনো কোলাহলে শোনা যায় না, শুধু নীরবতাতেই শোনা যায়। ধ্যানীরা তাই দীর্ঘ সময় বসে থাকতেন, কোনো প্রতিক্রিয়া না দিয়ে, শুধু ভেতরের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য।
এভাবেই প্রতিটি ধর্ম-মৌনতা বা নীরবতা একটা অলংকার হয়ে দাঁড়ায়।
..................................................................................
প্রশ্ন-৪: নীরবতা কীভাবে মনের সাথে আত্মার সংযোগ ঘটায়? এসময় নিজের ভেতরে ডুবে কোন কাজগুলো করবেন?
উত্তর:
মৌনতা বা নীরবতা দুই ধরনের। প্রথমটি হলো Passive Silence—ভয়ের নীরবতা, দুর্বলতা এবং Power Silence—শক্তির নীরবতা, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ।
নীরবতার কারণ যেটাই হোক, প্রশ্ন হলো আপনি যখন নীরব থাকছেন, তখন কী করবেন?এক্ষেত্রে আধ্যাত্ব্যবাদ থেকে কিছু পরামর্শ খুব কাজে আসে।
যেমন,
বুক ভরে নি:শ্বাস নেয়া এবং নি:শ্বাসের দিকে মনোযোগ দেয়া প্রতিটি শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ লক্ষ্য করা।এই নি:শ্বাসের ফাঁকেই লুকানো আছে আত্মার দরজা। এরপর চিন্তাকে পর্যবেক্ষণ করা। মাথায় আসা প্রতিটি ভাবনা কেবল দেখুন, প্রতিক্রিয়া জানাবেন না। দেখবেন আকাশে যেমন মেঘ আসে আর চলে যায়—তেমনি ভাবনাগুলোও যাবে আসবে।
আমরা যখন নীরব থাকছি তখন তিনটি কাজ করতে পারি। যেমন অন্তর্দর্শন বা Self-reflection. এসময় নিজেকে প্রশ্ন করুন যে “আমি আসলে কে?” কেন আমি এই পৃথিবীতে এসেছি? কীভাবে আমি আমার উপার্জন বাড়াতে পারি? কীভাবে এই পৃথিবীতে সেবা দিয়ে কিংবদন্তি হতে পারি?
দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে কৃতজ্ঞতা চর্চা। নীরবে মনে মনে কৃতজ্ঞ হওয়া। আমরা একটু চিন্তা করলে দেখবো এমন অনেক কিছুই আছে যেগুলোর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এমন কিছু আছে, যেটা অনেকের নেই। সেগুলোর জন্য অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। আরকিছু না হোক, নি:শ্বাসের জন্য, জীবনের জন্য, অস্তিত্বের জন্যও তো আমরা কৃতজ্ঞ হতেই পারি। আপনি যদি স্রষ্টায় বিশ্বাসী হন, প্রাণভরে কৃতজ্ঞতা জানান তাঁকে। আর যদি স্রষ্টায় বিশ্বাস না করেন তাহলে নিজেকে অন্তত ধন্যবাদ দিন।
তৃতীয় কাজটি হলো ধ্যান বা Meditation. ধ্যান বিষয়টিকে অনেকে খুব জটিল মনে করেন। আসলে বিষয়টি তেমন জটিল নয় মোটেই। চোখ বন্ধ বা খুলেও আপনি ধ্যান করতে পারেন। কোনো অরণ্য, নদী বা মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থেকেও ধ্যানের স্তরে পৌঁছতে পারেন আপনি। আপনার এই নীরবতায় মন আর আত্মাকে এক করে দেবে।
..................................................................................
প্রশ্ন- ৫: সবশেষে প্রতিদিনের জীবনে ‘নীরবতা’ ব্যবহারের কয়েকটা টেকনিক
︎সকালবেলা ৩০ মিনিট ফোন ছাড়া সময় কাটান। ব্যবহার শেষ হলে ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন। এভাবে দিনে কিছু সময় ডিজিটাল ডিটক্স করুন।
সময় পেলেই নিশ্বাসের মনোযোগ দিন। ভাবুন ভেতর শান্তি টেনে নিচ্ছেন। মৌনতা মানে শুধু মুখ বন্ধ করা নয়—মনকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া ।
কানে প্রবেশ করা শব্দগুলোর মধ্যে থেকে ফিল্টার করে নেগেটিভ শব্দগুলো পরিহার করা।
রাগ হলে Pause দিন, প্রতিক্রিয়া নয়।
জ্ঞানের জন্য স্পঞ্জ হও, কথার জন্য নয়।
শেষকথা:
আমাদের যেমন ভাষা আছে, ঠিক তেমনই আমাদের আত্মা বা রূহেরও একটা ভাষা আছে। এই ভাষার নামই নীরবতা। এটা এমন এক দরজা, যার একপাশে মন আরেক পাশে আত্মা। নীরবতার দরজা যখন খুলে যায়, তখন মন আর আত্মার একটা গভীর সংযোগ ঘটে। আপনার জীবনের সব টক্সিক মানুষের জন্য একটা কাজই করবেন-নীরবতা। আপনার এই নীরবতায় উপযুক্ত জবাব।
লেখা : জটাংক
……………………………....................................
Disclaimer:1......................
The ideas, analysis, and examples presented in this video are intended for educational and reflective purposes only. This content does not represent any religious decree, medical advice, or personal attack. Viewers are encouraged to interpret the topics based on their own beliefs, knowledge, and experiences.