
22/11/2024
জিরো রিটার্ন মহামারি: সাবধান
সোনালী ব্যাংকের এক ভদ্রলোক উনার অনলাইনে জমা করা রিটার্ন এর কপি নিয়ে এসেছেন যেখানে আয় শূন্য সম্পদ শূন্য ট্যাক্স শূন্য উনার এক কলিগ ই-রিটার্ন এক্সপার্ট তিনি ব্রাঞ্চের সবার রিটার্ন করে দিয়েছেন। অনেক ক্লাইন্ড এর রিটার্নও করে দেন। ভদ্র লোকের মনে হল শূন্য দেখানো এই একটাও তো শূন্য হবার কথা নয় এখন কিভাবে ঠিক করা যায়। আমি আগ্রহী হয়ে ই-রিটার্ন এক্সপার্ট ভদ্র লোকের সাক্ষাৎ প্রার্থী হয়ে উনার কাছে জানতে চাইলাম সব শূন্যের যুক্তি কি?
ভদ্রলোক যথেষ্ট স্মার্ট খুভ ফানি ভাবেই বলেন জিরো রিটার্ন এ এই গুলো লাগে না যদি দরকার হত রিটার্ন সাবমিট নিতই না। আমাদের তো সব সোর্সে ট্যাক্স কেটেই নেই তাই না? তাছাড়া একজন করদাতার কি আছে না আছে সব তো ডাটাবেইজই আছে এইগুলো অটোমেটিক সিনক্রোনাইজ হয়ে যাবে। উকিলদের দিন শেষ। আমি ই-রিটার্ন এর সাইট থেকেই কিছু ইনফরমেশন দেখালাম তারপর আইনের কয়েকটা ধারা দেখালাম উনি রীতিমতো ঘেমে উঠেন।
এক বড় ভাই এর সাথে দেখা আমাকে দেখেই তার ট্যাক্স রিটার্ন এর কথা মনে হল। জিজ্ঞেস করলাম কে করে দেন। উনি জানালেন মহল্লায় এক ভদ্র লোক মাঠে একসাথে সকালে ব্যায়াম করি বন্ধু মানুষ এলাকার অনেকের রিটার্ন করেদেন ৫০০ টাকা করে নেন। উকিল দের কাছে গেলে তো বেশি টাকা নেয় তাই উনাকে দিয়েই জমা করাই উনি সব কম্পলিট করে দিয়ে যায়। আমি আগ্রহ নিয়েই উনার রিটার্ন দেখলাম দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম ভাই পাচতলা বাড়িটা কি আপনার নামে না? আগের কোন বছরই বাড়ি দেখানো হয়নি কোন কালে কোন ট্যাক্স দেয়া হয়নি। ইনকাম কোন মত একটা দেখানো তাও বিসনেস ইনকাম। অনেক কথার সামারি হচ্ছে এই করদাতার কোন সম্পদ নাই।
বিগত ৬/৭ মাস আগে ঢাকার এক থানায় গিয়েছিলাম। পাশে কম্পিউটার এর দোকানে প্রিন্ট করে সাটানো জিরো রিটার্ন করা হয়। থানার অনেকেই তার কাছ থেকে সার্ভিস নেন। একজন পুলিশ অফিসার এর কাছে ট্যাক্স অফিস থেকে নোটিশ এসেছে। উনার নামে গাড়ি আছে কিন্তু ট্যাক্স রিটার্ন এ গাড়ী দেখানো হয়নি। দোকানদার জানান উনি জিরো রিটার্ন ছাড়া অন্য কোন রিটার্ন করতে পারেন না। উনিতো সাইনবোর্ডই দিয়েছেন জিরো রিটার্ন এর।
ঢাকার বাইরের অবস্থা আরো ভয়াবহ। কুমিল্লা থেকে এসেছে ভিসা প্রসেসিং করতে। এম্বাসিতে আয়কর রিটার্ন এর প্রাপ্তি এবং সার্টিফিকেট জমা করতে হবে। উনার রিলেটিভ সিনিয়র এডভোকেট তার এসিস্ট্যান্ট কে দিয়ে অনলাইনে রিটার্ন জমা করে দিয়েছেন। উনি জিরো রিটার্ন দেন নাই। ট্যাক্স প্রদান করেছে ৪০ হাজার আয় দেখিয়েছে ২ লাখ সম্পদ শূন্য। বছরে ২ লাখ টাকা আয় আর সম্পদ শূন্য লোকের জন্য ভিসা প্রাপ্তি কল্পনা।
প্রতিদিন এমন নতুন নতুন জিরো রিটার্ন এর কেরামতি দেখছি।
বর্তমানে ভার্চুয়াল মিডিয়ায়, বিশেষত ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, একশ্রেণির কনটেন্ট ক্রিয়েটর বা তথাকথিত কর-পরামর্শদাতা "জিরো রিটার্ন" নামে একটি ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এটি করদাতাদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করেছে যা অনেকটা মহামারীর মত।
"জিরো রিটার্ন" নামে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার এই প্রক্রিয়া কতটা সঠিক বা আইনসম্মত? আসুন এই বিষয়ের বিস্তারিত বুঝার চেষ্টা করি।
জিরো রিটার্ন বলতে কী বোঝানো হয়।
"জিরো রিটার্ন" বলতে বোঝানো হচ্ছে এমন একটি আয়কর রিটার্ন যেখানে করদাতা নিজের আয়ের কোনো হিসাব না দিয়ে "শূন্য আয়" বা "কোনো আয় নেই" এর সাথে শূন্য সম্পদ বা কোন সম্পদ নেই বলে কোন রকম একটি রিটার্ন জমা করা। এটিকে অনেকেই "সহজ এবং ঝামেলামুক্ত" উপায় হিসেবে প্রচার করছেন। তাদের বক্তব্য, আয় না থাকলে কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। জিরো রিটার্ন এ কোন ঝামেলা নেই তাই জিরো রিটার্ন নিরাপদ।
---
বাস্তবে জিরো রিটার্ন বলতে কিছু নেই
বাংলাদেশের আয়কর আইনের আলোকে "জিরো রিটার্ন" নামে কোনো বৈধ প্রক্রিয়া নেই। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ অথবা আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, একজন করদাতা যে কোনো অর্থবছরের জন্য আয়কর রিটার্ন জমা দিলে সেখানে তার প্রকৃত আয়ের হিসাব এবং সম্পদ বিবরণী দিবে । কোন ভাবেই অসত্য বা ভুল তথ্য জমা করা যাবে না। কর সীমা অনুযায়ী শূন্য কর সীমার মধ্যে আয় থাকলেও, করদাতাকে তা সঠিকভাবে প্রকৃত তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করতে হবে। যদি কোন সম্পদ বা আয় বাদ থাকে বা প্রদর্শন না করা হয় তাহলে উক্ত অপ্রদর্শিত আয় বা সম্পদ হিসাবে আইনানুগ জটিল প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা করতে হবে।
ভুল তথ্যের জটিলতা
"জিরো রিটার্ন" জমা দেওয়ার সময় করদাতারা সাধারণত নিজের প্রকৃত তথ্য গোপন করেন। এর ফলে নিচের সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে:
১.আইনের লঙ্ঘন:
আয়ের তথ্য গোপন করার জন্য আয়কর আইন ২০২৩ এর ধারা ২৭২ অনুযায়ী আয়, সম্পদ, ব্যয়, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমবেত পূর্ব্ববর্ত্তী সময়ে মিথ্যা তথ্যের তদন্ত সহকারে সম্পূর্ণ হিসাব করে জরিমানা সুদ সহ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।
২. সম্পদ বিবরণীর অসামঞ্জস্য:
পরবর্তীতে, যখন করদাতার সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তখন কর কর্তৃপক্ষ পূর্বের রিটার্নের সঙ্গে অসামঞ্জস্য খুঁজে বের করতে পারে। এতে করদাতা নিজেই নিজের বিরুদ্ধে প্রমাণ তৈরি করেন। বিশেষ করে সরকারি চাকুরীজীবিদের সম্পদের তথ্য প্রদানে ট্যাক্স রিটার্ন এর অসামঞ্জস্য থাকলে মহা বিপদ।
৩.সার্টিফিকেট এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা:
ভুল তথ্য দিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দিলে করদাতা ভবিষ্যতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN)-এর মাধ্যমে ব্যাংক লোন, ব্যবসায়িক নিবন্ধন, বা অন্যান্য সরকারি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন।
৪. ভবিষ্যত ঝুঁকি:
আপনার ট্যাক্স রিটার্ন এ গাফিলতির কারনে ভবিষ্যতে আপনার সন্তানদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় বিদেশ যাত্রা ছাড়াও তাদের ট্যাক্স রিটার্ন এ উত্তরাধিকার সূত্রের রেফারেন্স প্রদর্শনে জটিলতায় পরতে হবে।
সঠিক কর রিটার্ন জমার প্রক্রিয়া:
# জিরো রিটার্নের ধারণা বাদ দিয়ে সঠিকভাবে কর রিটার্ন জমা দিন।
# নিজের আয় সঠিকভাবে প্রদর্শন করুন
# আয় না থাকলে তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করুন এবং প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিন।
# সম্পদ বিবরণীর মিল নিশ্চিত করুন মনে রাখবেন আপনার যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পদ আপনার আয়কর রিটার্নের তথ্যর সাথে মিল থাকতে হবে।
আপনি জানেন কি? ১৮ কোটি মানুষ থেকে মাত্র ৪০ লাখ মানুষ ট্যাক্স রিটার্ন জমা করেন তাই আপনি আমজনতা হলে আপনার ভিন্ন একটি পরিচয় আপনি একজন করদাতা ১৮ কোটির মধ্যে ৪০ লাখ এর আপনি একজন। আপনি একজন সচেতন এবং দায়িত্বশীল করদাতা। তাই দায়িত্ব নিয়ে ট্যাক্স রিটার্ন জমা করুন।
জিরো রিটার্ন বলতে আয়কর আইনে কিছু নেই
জিরো রিটার্ন এর ধারণা মানুষকে বিভ্রান্ত করে
জিরো রিটার্ন একটি গুজামিল
জিরো রিটার্ন ভবিষ্যতের বিপদ
আসুন আমরা এই ভুল ধারণা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখি অন্যদেরকেও এই ভুল ধারণা থেকে মুক্ত থাকতে এই পোস্ট বেশি বেশি শেয়ার করি।
একজন সচেতন করদাতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার একজন সরাসরি অংশীদার হিসেবে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা এবং স্যালুট ।
আমান উল্লাহ সরকার
কর আইনজীবী