23/07/2025
মুরগির রান কার থালায় পড়ত, এই প্রশ্নেই মা হঠাৎ থমকে যায়। বড় আপা মুচকি হেসে বলে ফেলল, “মা, ছোটবেলায় তো ভাইয়েদেরই দিতেন সব রান।” মায়ের চোখ ভিজে আসে, গলার স্বর কেঁপে ওঠে, “সত্যি তো… তোদের কখনো দেইনি… রান তো সব ছেলেদেরই দিতাম…”
মাকে আর কিছু বলতে দিই না, আস্তে করে বলি, “মা, চলো এবার ঘুমাও।” মা আমার হাত ধরে বলে, “তুই জানিস তো, আমি এখন খুব ভালো বোধ করছি। দেশে নিয়ে যা, তোদেরও তো সংসার আছে…” আমি চুপচাপ মায়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিই।
আমরা ছয় ভাইবোন। দুই ভাই, চার বোন। আমরা বোনরাই কলেজে পড়াই, ছোট বোন সরকারি চাকরিতে, দুই ভাইও প্রতিষ্ঠিত—একজন কলেজের প্রিন্সিপাল, আরেকজন ব্যাংকে। মায়ের ক্যা%&নসার ধরা পড়ার পরও ভাইয়েরা দূরে, আর আমরা চার বোন মিলে চেন্নাই পর্যন্ত টেনেছি মাকে। ওখানে তিনমাস চিকিৎসা হয়েছে। মাকে ভালো রাখতে রাত-দিন এক করেছি।
ভাইদের জন্য মায়ের একরাশ টান, লজ্জা আর না বলা কষ্ট এখনো তাকে পুরনো দিনে নিয়ে যায়। ভাইরা ঢাকায় পড়ত, তখন মা যত্ন করে মুরগি পালত, মাছ আনাত, কিন্তু সবই ভাইদের জন্য। বড় ভাই আসলেই রান্না হতো স্পেশাল। আমরা বোনেরা চেয়ে থাকতাম, কিন্তু মুরগির রান, বড় মাছের পিস—সব ভাইদের। আমাদের জন্য থাকত শুধু পাখনা বা গলার হা&%ড়। তখন ছোট বোন রাগ করে বলত, “আমরা কি আপনার সন্তান না?” মা বলত, “তোর ভাইরা তো হোস্টেলে থাকে, কষ্ট পায়…” মন ভরত না, তবু চুপ করে মেনে নিতাম।
বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, বেশি কথা বলতেন না, আমাদের দিকে আলাদা করে তাকাতেনও না। তখন মনে হতো, মেয়েরা যেন এই বাড়ির গল্পের বাইরের চরিত্র, শুধু ভাইরাই মূল। মায়ের কাছে যত আবদার করতাম, শেষে দেখতাম, ভাইদেরই অগ্রাধিকার।
কিন্তু পড়াশোনা থামাইনি। আমরা বোনেরা ভালই পড়তাম, তাই মা কিছু বলত না। তবে একবার ছোট বোন প্রেমে জড়িয়ে পড়ল, মা এমন বকা দিল যে ও জ্ব%%রে পড়ল। আমি মাকে বলেছিলাম, “বড় ভাই তো প্রেম করেছে, তাকে তো কিছু বলেননি!” মা বলেছিল, “ছেলে আর মেয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।” সেই কথা মনে করে আজও কষ্ট হয়।
বাবা মা&%রা গেলে ভাইরা মায়ের ভাগের সম্পত্তিটুকু নিয়ে নিল। মায়ের মুখে তখনও হাসি, “ওরা ভাল থাকবে তাতে আমি খুশি।” কিন্তু ধীরে ধীরে ভাই-ভাবিদের অবহেলায় মা ভেঙে যেতে লাগল। আমরা বোনেরা আর চুপ থাকতে পারিনি, মাকে চিকিৎসার জন্য চেন্নাই নিয়ে গেলাম। মায়ের সাথে কাটানো সেই রাতগুলোতে, মায়ের চোখের ভেতর কত দুঃখ, কৃতজ্ঞতা আর অনুশোচনা দেখেছি!
একদিন পাশের কেবিনের এক আন্টির সঙ্গে দেখা করালাম মাকে। আন্টির পাঁচ ছেলে, সবাই প্রতিষ্ঠিত, অথচ আন্টি একা, কি&%ডনির রোগে ভুগছেন। আন্টির চোখ ভিজে বললেন, “তোমরা কেমন ভাগ্যবতী, মেয়েরা মায়ের সঙ্গে আছে…” মায়ের চোখও ভিজে গেল।
দেশে ফিরে মাকে আমাদের সাথেই রাখতে চাইলাম। মা বলল, “না, আমি বাবার করা বাড়িতেই থাকব।” তবু প্রতিদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে মা গেটে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ ভিজে বলে, “আজ মুরগির রান রেখেছি তোর জন্য…” আমার বুকের ভেতর কেমন হাহাকার ওঠে—শুধু মনে হয়, ছোটবেলার সেই এক টুকরো মুরগির রানের স্বাদ, আর পাওয়া হবে না…
আমরা বোনেরা আজও ঠিকই আছি, সুখে-দুঃখে মায়ের পাশে। আর মা? মায়ের চোখে আজও সেই আফসোস—ছেলেমেয়ের মধ্যে যে বিভাজন ছিল, তা মুছে ফেলতে চায়… মা ভুল করেছে, আমরা তবু তাকে ক্ষমা করে ভালোবাসতে শিখেছি।
সংগৃহীত।