28/06/2023
একান্নবর্তী পরিবার ছিল আমাদের। ছোট্ট থেকে দেখতাম, ঈদের দিন ফুফুরাও আমাদের সাথে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করতো। নিজেদের ঘর সংসার রেখে, ঈদের দিন নারীদের বাবার বাড়ি আসা, খুব কম পরিবারই ভাল চোখে দেখে। আমাদের পরিবারেও তা হতো। দেখা যেতো, ঈদের দিন, কোনো না কোনো ছুঁতোয়, বিকেলে বা সন্ধ্যায়, ফুফুরা আসতেন, খানিকক্ষণ থেকে আবার চলে যেতেন। ওই খানিকক্ষণ সময়ে দাদির কী যে হতো! দাদির চেহারা দেখলে মনে হতো ছোট বাচ্চা, পছন্দের খেলনা পেয়ে উচ্ছ্বসিত। চোখেমুখে আনন্দ। ফুফুদের চোখেও আনন্দ খেলা করতো। একবার বিকেলে সেজফুফু একদম লুকিয়ে চলে এলেন, আধঘন্টা থেকে চলে যান। এই আধঘন্টার কারণে তার ওপর ঝড় বয়ে গিয়েছিল। কেন ঈদের দিন বাবার বাড়ি যেতেই হবে, তা নিয়ে! ফুফুরা আসতেন, দাদির ব্যস্ততা, চোখেমুখে খুশির ঝলকের মাঝে কখনো খেয়াল করিনি, মা-চাচিরা মন খারাপ করছেন কিনা। কিন্তু, ঈদের দ্বিতীয়-পঞ্চম দিনেও মা-চাচিরা যখন সাংসারিক ব্যস্ততা সরিয়ে, নিজেদের বাবার বাড়ি যেতে পারতেন না, দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতাম। মায়ের নানুকে বলা মিথ্যা আশ্বাস শুনতাম, এই তো মা! এই সপ্তাহেই আসব। খুব খেয়াল করতাম, মা-চাচিদের যাওয়া হতো না। উদাস হয়ে থাকতেন তারা।
পরে, অনেক বছর পরে বুঝেছি, এইযে ঈদ, চারিদিকে উৎসব, এত কাজ, খাটনি, এত মুখরোচক পদ তৈরি করা...
সবকিছুই নারীদের বিস্বাদ লাগে। ছটফট করতে করতে নারীরা স্বাদ খোঁজে। এত মজার রান্না, সবাই কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছে, তবুও তার জিহ্বায় স্বাদ লাগে না, গলা দিয়ে খাবার নামে না। কেমন কেমন লাগে। গলা ছেড়ে কাঁদতে মন চায়। মাকে বলতে ইচ্ছে করে, মাগো! খুব নাকি মজা হয়েছে, তবুও আপনার রান্নার মত হয়নি কেন? আমি স্বাদ পাই না কেন মা?
আসলেই নারীজীবন অদ্ভুত! বছরের পর বছর দায়িত্বের আঞ্জাম দিতে দিতে অতৃপ্ত হৃদয়ের হাহাকার লুকিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া কোনো সহজ বিষয় না। বিশেষ দিনগুলোতে, চল্লিশোর্ধ নারীর মনও বাচ্চা হয়ে যায়। মন চায়, মায়ের বকুনি খেতে খেতে খাবার খেতে। বাবার সাথে একগাল হাসাহাসি করে, আড্ডা দিয়ে ঘর জমিয়ে রাখতে। ভাইবোনদের সাথে একত্রিত হয়ে মাকে জ্বালাতন করতে। স্বামী সংসারের দায়িত্ব, সন্তানাদি, সব একপাশে রেখে, কিছুটা সময় বাচ্চা হয়ে বাবামা, ভাইবোনের আদর খেয়ে কাটিয়ে দিতে মন চায়।
আচ্ছা, ঈদের দিন, ঘরের এককোণে, আপনাদের আনন্দের আঞ্জাম দিতে দিতে কোনো নারী চোখ মুছছে না তো? তার যত্ন নিন। ঈদের দিন না হোক, দুদিন পর হলেও তাকে বাচ্চা হয়ে যাওয়ার সুযোগ দিন। এই মায়ার জগতে, যে পরিবারটায় বিয়ের আগ পর্যন্ত জীবন কাটিয়েছে, অন্তত কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও, সেখানে নিয়ে যান। জানেন, সে পরিবারের দুজোড়া চোখ তার জন্য অশ্রু টলমল নেত্রে চেয়ে থাকে। অপেক্ষায় থাকে, কখন আসবে খুকি! কখন বুড়োবুড়ির মন জুড়োবে...