
24/03/2025
১৩ বছরের ছেলে জেমি তারই এক নারী সহপাঠীকে খুন করেছে- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে তার বাসায় পুলিশের অভিযান দৃশ্যের মাধ্যমেই শুরু হয় নেটফ্লিক্সে এই মুহুর্তে সবচেয়ে আলোচিত সিরিজ Adolescence এর প্রথম পর্বের।
মাত্র চার পর্বের সিরিজ, প্রতিটি পর্ব এক ঘন্টা বা ৫০ মিনিটের মত আর প্রতিটি পর্বই এক টেকে ধারণ করা হয়েছে অর্থাৎ কোন কাট নেই৷ ক্যামেরা চলছে তো চলছেই, একদম জীবনের মত বহমান৷ দ্বিতীয় এপিসোডের দৃশ্যধারণ কীভাবে করলো, এটা ভেবে এখনও মাথা চুলকে যাচ্ছি। জেমির স্কুলের সহপাঠীদের পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ; তাও আবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, এরপরে বেশ বড় একটা চেজিং সিন, এরপরে স্কুলের কম্পাউন্ড থেকে ক্যামেরা উড়ে গিয়ে আরেক জায়গায় যাওয়া- সিম্পলি মাস্টারপিস।
ডিওপি থেকে শুরু করে ফোকাস পুলার আর পুরো টিম কী পরিমাণ পরিশ্রম করলে, কী পরিমাণ রিহার্সেল করলে এই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব সেটা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে সিনেমার সাথে জড়িত মানুষ আর বিজ্ঞ দর্শক একটু ভেবে দেখলে শ্রদ্ধায় আপনাআপনি মাথা নত করে ফেলবেন৷ তার প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি অনলাইনে অনুরাগ কাশ্যাপ, শেখর কাপুর, হানসাল মেহেতাদের মত পরিচালকদের এই সিরিজের ব্যাপারে টুইটারে প্রশংসাবাণীতে।
এই সিরিজ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলাপ হয়ে গেছে, আমি অন্য একটি আলাপ করতে চাই। এই সিরিজের এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার ১০ জন, তাদের মাঝে একজন ব্র্যাড পিট। জি হ্যাঁ, হলিউড সুপারস্টার দি ব্র্যাড পিট। ২০০১ সালে 'প্ল্যান বি প্রোডাকশন' নামে একটি প্রোডাকশন হাউজ খোলেন ব্র্যাড পিট তার সাবেক স্ত্রী জেনিফার অ্যানিস্টনের সাথে মিলে। সাথে ব্র্যাড গ্রে নামের আরেকজন ব্যক্তিও ছিলেন।
স্ত্রী সাথে থাকেন নি, ব্র্যাড গ্রেও পরবর্তীতে প্যারামাউন্ট পিকচার্সের সিইও হিসেবে যোগদান করেন কিন্তু ব্র্যাড পিটের সাথে ঠিকই থেকে যায় প্ল্যান বি প্রোডাকশন হাউজ। দি ডিপার্টেড, টুয়েলভ ইয়ার্স এ স্লেইভ, মুনলাইটের মত প্রশংসিত সিনেমার প্রোডিউসার হল এই প্ল্যান বি প্রোডাকশন হাউজ৷ শুধুমাত্র নামের আগে সুপারস্টার ট্যাগ না লাগিয়ে যে ইন্ডাস্ট্রি আপনাকে সুপারস্টার বানিয়েছে, সেই ইন্ডাস্ট্রিতে ইনভেস্ট করেই যে রিয়েল সুপারস্টার হওয়া সম্ভব; তার উদাহরণ হচ্ছেন ব্র্যাড পিটের মত মানুষেরা। অ্যাডোলেসেন্সের মত মর্ডান মাস্টারপিসে এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার হিসেবে থেকেও ব্র্যাড পিটকে দেখবেন না ক্যামেরার সামনে এসে এই ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করতে কিংবা আত্মপ্রশংসায় উচ্চকিত হতে। শেখার শেষ নেই এদের কাছ থেকে।
ব্রিটিশ সিরিজ খুব কম সময়েই হতাশ করেছে। যেকোনো ব্রিটিশ সিরিজের সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিবার তারা স্টোরিটেলিং এ নতুন কিছু না কিছু যোগ করবেই। সেটা পিকি ব্লাইন্ডার্স হোক, ব্ল্যাক মিরর হোক বা শার্লক হোক বা রিসেন্ট অ্যাডোলেসেন্স।
সিরিজে জেমির বাবার চরিত্রে অভিনয়কারী স্টিফেন গ্রাহাম এই সিরিজের কো রাইটারও বটে। একই সাথে ব্র্যাড পিটের সাথে তার সম্পর্কটাও বেশ পুরনো। Sn**ch সিনেমাটা যারা দেখেছেন, তাদের মনে থাকার কথা। মনে করানোর জন্য ছবিতে স্ন্যাচ সিনেমার একটি দৃশ্য দিলাম যেখানে ব্র্যাড পিটের পাশেই তাকে দেখা যাচ্ছে।
কেট নামের একটা মেয়ের মা*র্ডার হয়েছে ঠিকই এই সিরিজে, কিন্তু এই সিরিজ কিন্তু কোন ক্রাইম থ্রিলার নয়। একজন ১৩ বছরের টিনএজারের মন, তার বেড়ে ওঠা, এই সময়, এই সমাজ নিয়েই এই সিরিজ। কেটের মৃতদেহ পর্যন্ত দেখানো হয় না এই সিরিজে, পরিচালকের আসনে বসে এই লোভ সামলানো বিশাল ব্যাপার।
অনেক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন নির্মাতা এই সিরিজে, সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ারও চেষ্টা করেন নাই নির্মাতা৷ একটা টিনএজার ছেলে যে খুন করলো, এর পেছনে দায়ী কে? বাব-মা’র শিক্ষা? স্কুলের শিক্ষকদের নিস্পৃহতা? সোশ্যাল মিডিয়ায় ইনসেল কালচার আর মিসোজিনির উপস্থিতি? একাকিত্ব না অবসাদ? বাবা-মার শিক্ষায় সমস্যা হলে একই বাসায় বেড়ে ওঠা জেমির বোন লিসার ক্ষেত্রে কেন কোন ধরনের সমস্যা হল না?
একটি দৃশ্যে আমরা জানতে পারি, ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে না পারায় জেমি বাবার চোখে ভীষণ লজ্জা দেখতে পেরেছিল। সেই লজ্জা আর অপমানের দাগ হয়তো এতটাই গাঢ় ছিল যে, জেমি পরবর্তীতে নিজেকে আর কখনও ডিফেন্ড করতে শেখেনি; শিখেছে শুধুমাত্র ভেতরে রাগ পুষে রাখতে। হয়তো সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই ১৩ বছরের জেমির হাতে ঘটে যায় এত বড় দুর্ঘটনা।
তার চেয়ে ফুটবল খেলতে না পারায় জেমির বাবা যদি বলতো, 'না পারলে সমস্যা নাই, ইটস ওকে'- তাহলেই হয়তো জেমি আর জেমির বয়সী ছেলেরা একটি ভরসার জায়গা খুঁজে পেতো, যে ভরসার খোঁজে আমাদের অনুসন্ধান চলে আজীবন।
লেখা: সৈয়দ নাজমুস সাকিব