02/10/2025
(মুখ বন্ধ)
রাত আনুমানিক ৯টা। পুরোনো বাইকটি নিয়ে বের হলাম আমিশাপাড়া বাজারের উদ্দেশ্যে। রাস্তা পিচঢালা হলেও বড় বড় গর্তে ভরা। আমার বাইকের সামনের হেডলাইটও খুব একটা আলো দেয় না, নিভু নিভু করে জ্বলে। এ বাইকটিই আমাকে প্রায় ১ যুগেরও বেশি সঙ্গ দিয়েছে।
হেডলাইটের দুর্বল আলো আর রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কারণে ধীরে ধীরে চলতে হচ্ছিল।
আমাদের দেশে সড়ক নির্মাণ ও মেরামতে যে খরচ দেখানো হয় তার তিনগুণ বেশি বাজেট ধরা হয়, অথচ বাস্তবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো সেই বাজেটের অল্প অংশও খরচ করে! ফলে এই দেশের রক্ষকরাই হয়ে যায় ভক্ষক।
যাই হোক, মূল কথায় আসি—
বাইক নিয়ে আমিশাপাড়ার দিকে যাচ্ছি। গ্রামীণ রাস্তায় তখন তেমন লোকজন নেই। হঠাৎ মাঝপথে একজন হাত তুলে আমাকে থামালেন। তাঁর মুখমণ্ডল গোল, মুখভর্তি কাঁচা দাড়ি, চোখেমুখে আকুতির ছাপ। তিনি বললেন—
“ভাই, আপনি কি আমিশাপাড়া যাচ্ছেন? সেখানে মাহফিল হচ্ছে, আমিও যেতে চাই। যদি আমাকে সঙ্গে নিতেন।”
আমি তাঁকে বাইকে তুলে নিলাম। যেতে যেতে আলাপ শুরু করলাম। জানতে চাইলাম, তিনি কোথায় থাকেন?
লোকটি জানালেন, তিনি এখানকার এক মসজিদের মুয়াজ্জিন, সকালবেলা শিশুদের মক্তবে পড়ান।
আমি বললাম, “এত রাতে মাহফিলে যাচ্ছেন, ফিরবেন কীভাবে?”
তিনি হেসে বললেন, “আপনি এখন নিয়ে যাচ্ছেন, ফেরার ব্যবস্থা হয়তো আল্লাহ করে দেবেন।”
আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, বেতন কত পান?
তিনি জানালেন, মাস শেষে তাঁকে ৪ হাজার টাকা দেওয়ার কথা।
“খাওয়া-দাওয়া কোথায় করেন?”— আমি আবার জানতে চাই।
তিনি হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আসলে খাওয়াদাওয়ায় খুবই কষ্ট হয় ভাই। এখানে কেউ খুব একটা খাওয়াতে চায় না। ধাক্কাধাক্কি করে থাকতে হয়। গত দুই-তিন দিন নাশতাও করতে পারিনি, অনেক সময় না খেয়েও থাকতে হয়।”
আমি অবাক হলাম। কারণ আমাদের এই অঞ্চলটি ধনাট্য এলাকা। বিদেশ কর্মরত মানুষের সংখ্যাও কম নয়। মসজিদগুলোয় দান-চাঁদার অভাব নেই— টাইলস করা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, সব কিছুতেই আধুনিকতা। তবুও মুয়াজ্জিনের মতো একজন মানুষের এই অবস্থা!
আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “আপনার কথা সত্যি তো? এখানে তো অনেক সামর্থ্যবান মানুষ আছেন!”
লোকটি উত্তর দিলেন,
“সবই ঠিক আছে ভাই, কিন্তু আমরা মুয়াজ্জিন, ইমাম— আমাদের ক্ষেত্রে সব হিসাবটাই কাটা কাটা। কেউ তেমন খোঁজ নেয় না।”
কথোপকথনে জানতে পারলাম, তাঁর বাবা আগে গাড়ি চালাতেন, কিন্তু এক দুর্ঘটনায় এখন শয্যাশায়ী। সংসারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। ভালো আয় না থাকায় দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগও হয়নি।
তিনি আরও জানালেন, আরবি মাধ্যমে মাস্টার্স শেষ করেছেন।
আমি তাঁকে সাহস দিলাম
“ধৈর্য ধরুন। হয়তো আপনি নতুন এসেছেন, তাই মানুষ এখনো ভালোভাবে চেনে না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কথা বলতে বলতে আমিশাপাড়া বাজারে পৌঁছালাম। তিনি বাইক থেকে নেমে সালাম দিয়ে চলে গেলেন।
পরিশেষে
আমাদের সমাজে কিছু মসজিদে প্রতি মাসে লাখ টাকারও বেশি দান আসে। মসজিদগুলো সাজানো-গোছানো, আধুনিক। কিন্তু যারা মসজিদের খেদমত করেন— মুয়াজ্জিন, ইমাম, মক্তবের শিক্ষক— তাঁদের খবর কি আমরা রাখি?
তাঁদের দুঃখ-কষ্টের খোঁজ নেওয়াটাই আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।
✍️ টি এ সেলিম
📞 01816142836
#মুখবন্ধ #বাস্তবকথা #মানুষেরগল্প #ইমাম #মুয়াজ্জিন #মসজিদ #সচেতনতা #মানবিকতা #সমাজপরিবর্তন #আমাদেরদায়িত্ব