31/10/2025
দুই জেনারেলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত: সুদানের গৃহযুদ্ধ ও এল-ফাশেরে মানবতা লুণ্ঠন | ৩১ অক্টোবর. ২০২৫ | আন্তর্জাতিক সংবাদ
আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম দেশ সুদান বর্তমানে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের শিকার। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া এই সংঘাত মূলত দেশের সামরিক শাসক ও ক্ষমতাশীল দুটি প্রধান সামরিক গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই থেকে জন্ম নেয়। এই যুদ্ধ এখন এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং দারফুর অঞ্চলে গণহত্যার মতো নৃশংসতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
এই গৃহযুদ্ধের মূল কারণ হলো সুদানের সার্বভৌমত্ব পরিষদ (Sovereign Council)-এর প্রধান এবং দেশের কার্যত শাসক জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান-এর নেতৃত্বাধীন সুদানিজ আর্মড ফোর্সেস (SAF) এবং তার সহকারী মোহামেদ হামদান দাগালো (যিনি হেমেডটি নামে পরিচিত)-এর নেতৃত্বাধীন র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-এর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
যুদ্ধ শুরু হয় রাজধানী খার্তুমে, যখন RSF গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা এবং সামরিক ঘাঁটি দখল করতে শুরু করে। প্রথম দিকে খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি ও বিমান হামলা চলে, যা শহরটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। যদিও SAF পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের মতো কিছু প্রতীকী স্থান পুনরুদ্ধার করে, RSF খার্তুমের কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এখনও শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে।
সংঘাতের সবচেয়ে ভয়াবহতা দেখা যায় পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে। জাতিগত সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস থাকায়, RSF এবং তাদের সহযোগী আরব মিলিশিয়ারা অ-আরব জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন ও গণহত্যা শুরু করে। ২০২৩ সালে পশ্চিম দারফুরের রাজধানী জেনিনাতে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হন বলে অভিযোগ ওঠে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে সংঘাত তার চরম বিন্দুতে পৌঁছায়। দারফুরে সেনাবাহিনীর শেষ বড় ঘাঁটি ছিল এল-ফাশের শহর। প্রায় ১৮ মাস অবরোধের পর সম্প্রতি (অক্টোবর ২০২৫-এর শেষ নাগাদ) RSF এই শহরটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়। এই পতন একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক মোড়।
এল-ফাশের দখলের পর সেখানে ঘটে যাওয়া নৃশংসতা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করেছে: সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্ক-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ১৫০০ থেকে ২০০০-এরও বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। RSF একটি হাসপাতালে ঢুকে শত শত রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন। গণহত্যার অভিযোগের পাশাপাশি, অ-আরব জনগোষ্ঠীর উপর লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে জানা যায়।
সংঘর্ষের জেরে সুদান বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দু। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ ঘরছাড়া। এর মধ্যে ২.১ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলিতে শরণার্থী হয়েছে। প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ (দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা) তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কিছু বাস্তুচ্যুত শিবিরে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি ঘোষণা করা হয়েছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি হয় ধ্বংস হয়েছে, না হয় আক্রমণের শিকার হয়েছে। বহু স্বাস্থ্যকর্মী পালিয়ে গেছেন। |
জাতিসংঘ (UN) এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে। বিশেষ করে দারফুরে RSF-এর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলোচিত।
সৌদি আরব, মিশর, কাতার সহ অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলি অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ এল-ফাশেরের পরিস্থিতিকে "ভয়াবহ বৃদ্ধি" হিসেবে চিহ্নিত করে যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক সহায়তার পথ দ্রুত খোলার দাবি জানিয়েছে।