24/07/2023
দি কেস অব পলিটিক্যাল মাইগ্রেসন ইন দ্যা হিল ট্র্যক্টস
- দিমিতির
জাতিগত সমস্যা/দ্বন্দ্ব (Ethnic Conflict)) বর্তমানে বিশ্ব ব্যবস্থার একটি অন্যতম রূপ। জাতি গঠন বা রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া কখনো সহজ, সরল পথে এগোয়নি। প্রথম বিশ্ব থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্ব পর্যন্ত এই সমস্যা পরিব্যপ্ত। সাম্প্রতিককালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুগোশ্লাভিয়ার ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করেছে কম্যুনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও জাতিগত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অন্যদিকে উদারনৈতিক রাজনীতির ধ্বজাধারী বৃটেনেও এ সমস্যা বিদ্যামান। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ সমস্যা আরো প্রকট। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ সমস্যা কেন ? এর প্রকৃতিই বা কি?
সামাজিক বিজ্ঞানের তত্ত্ববিদরা জাতিগত সমস্যাকে সরাসরি কতৃত্ববাদী এলিট কুশাসনের (elite misrule) সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। (১) সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সরকার সমূহের সমস্যা সম্পর্কে ভুল উপলদ্ধি এবং তৎহেতু ভ্রান্ত নীতিমালা ও পদক্ষেপ থেকে। (২) অবশ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মূল নিহিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে সহজেই ধরা পড়ে বাংলাদেশ একটি একক জাতি, সংস্কৃতি-ভাষা ভিত্তিক (mono-ethnic, culture-linguistic) রাষ্ট্র। মুজিব ১৯৭৩ সালে রাঙ্গামাটিতে-এক নির্বাচনী জনসভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের “পাহাড়িদের” নিজস্ব জাতিগত বৈশিষ্ট্য ভুলে গিয়ে ‘বাঙালি’ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ঐ জনসভায় তিনি এ হুমকিও প্রদান করেছিলেন, যদি পাহাড়িরা তার পরামর্শ গ্রহণ না করে, তাহলে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ বাঙালি ঢুকিয়ে দিয়ে তা করবেন। ১৯৭৪ সালের ২৩শে জানুয়ারী পার্লামেন্ট বাংলাদেশকে একটি "uni-cultural and uni-lingual nation-state" non-accommodative"হিসেবে ঘোষণা করে একটি বিল পাস করে। এখানে সহজেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সিস্টেমের "non-accommodative" চরিত্র চোখে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রত্যেকটি সরকারই "accommodative" নীতির পরিবর্তে "assimilationist" পলিসি অনুসরণ করেছে। এর যথাযোগ্য প্রতিফলন হচ্ছে - পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সমতল ভূমি থেকে বাঙালি পুনর্বাসন।
পূর্বের এক লেখায় পার্বত্য চট্টগ্রামে মাইগ্রেশনকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল। (১) স্বাভাবিক (natural); এবং (২) রাজনৈতিক (political)। প্রথম ধারণায় লোকজন পার্বত্য চট্টগ্রামে মাইগ্রেট করেছে ভাগ্যের সন্ধানে অর্থাৎ হয় চাকুরীর জন্য না হয় ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। কিন্তু দ্বিতীয় ধারণায়, সরকার সুপরিকল্পিতভাবে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য দেশের সমতল অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে লোক পুনর্বাসন করেছে।
১৯৪৭ সালের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে বুঝা যাবে কত দ্রুত হারে জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৪৭ সালে জেলার লোকসংখ্যার ৯৮ শতাংশেরও অধিক ছিল পাহাড়ি, আর অপাহাড়ি ছিল ২ শতাংশেরও কম। ১৯৫১ সালে জেলায় বাঙালির হার দাঁড়ায় ৯%, ৬১ সালে ১২% এবং সরকারী হিসেব মতে ১৯৮১ সালে ৪০%। বাংলাদেশের এক সাপ্তাহিক পত্রিকার মতে ১৯৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপাহাড়ি জনসংখ্যার হার ৫০% এর অধিক হয়। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে জেলায় পাহাড়ি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৭১.৭% আর বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১২৫.১%। পরিসংখ্যান থেকে একটা পরিস্কার চিত্র ফুটে উঠে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেলায় অপাহাড়ি জনসংখ্যার পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জেলার ডিমোগ্রাফিক চেহারা পাল্টে দিয়েছে।
১৯০০ সালে হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাইরের লোকদের গমনাগমন এবং বসতি স্থাপনের ব্যাপারে কিছু সুস্পষ্ট বিধি বিধান ছিল। ১৯৪৭ সালের পর এইসব বিধি বিধান উপেক্ষা করে পাকিস্তান সরকার সমতলবাসী বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনে উৎসাহ প্রদান করে। বাংলাদেশ আমলে এ প্রক্রিয়া উৎসাহ প্রদানের পরিবর্তে পৃষ্ঠপোষকতায় রূপ লাভ করে। এক সরকারী গোপন মেমোরেন্ডামে দেখা যায়, সমতলবাসী যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করবে তাদের প্রতি পরিবারকে ৫ একর হিলি জমি, ৪ একর মিশ্র জমি, ২.৫ একর ধান্য জমি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। (৪) স্বভাবতই যে প্রশ্নটা উঠে তা হচ্ছে, যে মিশ্র এবং ধান্য জমির প্রতিশ্রুটি দেয়া হচ্ছে তা কোত্থেকে আসবে ? পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পর্বতময় এলাকা, এখানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ এমনিতেই কম। তার উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে জেলার ৪০% চাষযোগ্য জমি পানিতে ডুবে যায়। সরকার সে সময়ই বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়িদের চাষযোগ্য জমির অভাবে পুনর্বাসন করতে পারেনি। কাজেই পরবর্তীকালে দেখা গেলো পাহাড়িদের ভূমির বেদখল, অধিগ্রহণ ইত্যাদি। এই সমস্ত অবিচার, বৈষম্য, অশুভ নীতির ফলেই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সৃষ্টি।
বর্তমানে আমরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিমোগ্রাফিক মানচিত্রের দিকে তাকাই, তাহলে সরকারী নীতিমালার প্রতিফলন সহজেই চোখে পড়বে। তবলছড়ি এবং রামগড় এলাকায় বর্তমানে পাহাড়ি নেই বললেই চলে, যেখানে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় বাঙালি ছিলই না। জেলার দক্ষিণাংশে নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, রুমা উপজেলাগুলোতেও এই পরিস্থিতি চোখে পড়বে। লংগদু এলাকার পরিস্থিতিও ভয়াবহ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের এসব নীতির উদ্দেশ্যে কী ?
সরকারী এ নীতিমালার মূলে রয়েছে পশ্চিমা anti-insurgency তত্ত্বগুলো। তত্ত্বগতভাবে একথা বলা হয়, যখন কোন অঞ্চলে insurgency দেখা দেয় তখন insurgent group এবং সরকারের মধ্যে জনসমর্থন নিয়ে টানাটানি হয়। জনসমর্থন ছাড়া insurgent গ্রুপগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। অন্যদিকে insurgency দমন করতে হলে সরকারের স্থানীয় অধিবাসীদের সমর্থন দরকার হয়। এই অবস্থায় সরকার যদি স্থানীয় জনসমর্থন না পায় তাহলে অন্য এলাকা থেকে নিজ বংশোদ্ভুত বা সমর্থন পেতে পারে এমন লোকজন এনে ঐ বিশেষ এলাকায় বসতি স্থাপন করায়। এতে সরকার স্থানীয় লোকদের নিজ সমর্থনপুষ্ট লোকজন দ্বারা out-number করে ঐ সমস্যা সমাধানে প্রয়াস পায়। এটা অনেকটা Demographic invasion -এরই নামান্তর। বৃটিশ সরকার Communist insurgency দমন করতে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তে এ নীতি প্রয়োগ করেছিল। ফিলিপাইনে মরোদের বিরুদ্ধে, শ্রীলংকায় তামিলদের বিরুদ্ধেও এ নীতি প্রয়োগ করা হয়। চীনারা এ নীতি প্রয়োগ করেছে তিব্বতে। আর বাংলাদেশ সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে এ নীতিরই আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব বিপন্ন প্রায়। অবশ্য অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চলছে নানাভাবে। কিন্তু শঙ্কার কারণ হল সরকারের অনুসৃত নীতি। না হয় হাজার বছর ধরে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চালানো যেত।
মূল লেখাটি The Chittagong Hill Tracts: Militarization, Oppression and the Hill Tribe (London : Anti-Slavery Society Publication, 1984) P.P. 71-73. বাংলা অনুবাদ করে রাডার লিটল ম্যাগাজিনে ১৩ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়
© N tripura